ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নদীর দুঃখ মোচনের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২২ মে ২০১৮

নদীর দুঃখ মোচনের প্রত্যাশা

ঢাকার চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ চারটি নদী অব্যাহতভাবে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে। দূষণে-দখলে জর্জরিত বুড়িগঙ্গা। শুধু তাই নয়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার পাশের চার নদীকে নিকটস্থ তিন হাজার শিল্প-কারখানার বর্জ্য দূষিত করছে মারাত্মকভাবে। অনুরূপ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী, হালাদা নদীর অবস্থাও অনুরূপ। প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনমিটার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে এসব নদীতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, একদিকে চলে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার অভিযান অন্যদিকে চলে দখল ও দূষণের মহোৎসব। এসব নদীর পানি ব্যবহার তো দূরের কথা রীতিমতো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত হয়ে আছে এসব নদীর পানি। এতে করে ঢাকা ও আশপাশে বসবাসকারী প্রায় দেড় কোটি মানুষের জীবনযাত্রা পরিবেশগত হুমকিতে রয়েছে। অনুরূপ হুমকিতে রয়েছে চট্টগ্রামের ৫০ লাখ মানুষ। অবশ্য সারা দেশের সব নদীর অবস্থায় কম বেশি প্রায় একই রকম। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে ছোট হয়ে গেছে। চার নদীর দখল ও দূষণমুক্ত করার কাজ চলছে ধীরগতিতে। নদীগুলো দখলমুক্ত করতে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযান শেষ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যরে কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। শিল্প-কারখানার বর্জ্যরে পাশাপাশি বসতবাড়ি ও হোটেল-রেস্তরাঁর উচ্ছিষ্টে ভরে যাচ্ছে নদী। শুধু কি বুড়িগঙ্গা? না, বুড়িগঙ্গাসহ তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু ঢাকাকে ঘিরে রাখা এই চার নদ-নদীর দূষণের মাত্রা বাড়ছেই। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামসহ (বিসিজেএফ) পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে চার নদ-নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সেমিনার, সভা-সমাবেশ করে আসছে, রাখছে সরকারী মহলের কাছে প্রস্তাবনা। তবে সরকারীভাবে ঢাকার পাশের ৪ নদী রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্স কাজ করছে গত ৮-৯ বছর ধরে। কিন্তু, বাস্তবে এই চার নদী রক্ষায় দৃশ্যত বড় রকমের কোন কাজ হয়নি। কাজের মধ্যে কিছু কিছু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, সীমানা চিহ্নিতকরণ অথচ এই চার নদীকেই বলা হচ্ছে ঢাকার প্রাণ। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন গণমাধ্যম ও টিভিতে হরহামেশাই চার নদীর করুণ অবস্থা নিয়ে খবর প্রকাশ হচ্ছে। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী এখন মরতে বসেছে দখল আর দূষণের কবলে। এরই মধ্যে সম্প্রতি খবর প্রকাশ হলো ‘ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চঁাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ।’ স্থানীয় মানুষের ভাষ্য- শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এই অঞ্চল অনেকটা মরুভূমিতে পরিণত হয়। আবার বর্ষায় ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে হঠাৎ ফুঁসে ওঠে পদ্মা। ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলসহ সবকিছু। তার ওপর অব্যাহত ভাঙ্গনে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে এ জেলার মানচিত্র। এমন পরিস্থিতে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও নদী তীরবর্তী মানুষদের রক্ষার্থে নদী খননের কথা বলছেন পরিবেশবিদরা। আর ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার ও ছেড়ে দেয়ার ইস্যু আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার পরামর্শ তাদের। ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঙ্খা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা। ১৯৭৫ সালে এই পাঙ্খা পয়েন্ট থেকে ২০ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। এক সময় সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই নদী ক্রমেই ভাঙতে থাকে চঁাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি, চরবাগডাঙ্গা, নারায়ণপুর, পাঁকা, উজিরপুর ও দেবিনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আর ভাঙ্গনকবলিত এসব এলাকা পরিণত হয় ধু-ধু বালুচরে। নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের কারণে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে পড়ে পদ্মা। যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য দুর্ভোগ হয়ে দাড়িয়েছে। পাঙ্খা পয়েন্ট থেকে শুরু করে রাজশাহীর গোদাগাড়ি পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪১ কিলোমিটার। আর পদ্মাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার কোন নমুনা পাওয়া যায় না। শুধু আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত মাত্র ৫ মাস পানি থাকে। বাকি সময় চারদিকে শুধু ধু-ধু বালুচর। প্রত্যক্ষভাবে এই এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফারাক্কা বাঁধের কারণে। জায়গা-জমি, বাড়িঘর সবকিছু হারাচ্ছে নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও নদী তীরবর্তী মানুষদের রক্ষার্থে পদ্মা নদী খননের কথা বলছেন পরিবেশবিদরা। বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও নদী ভাঙ্গন। এর ফলে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষ এবং ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতা এবং অসময়ে বেশি পানি প্রবাহের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে নাব্য হারিয়ে জেগে উঠছে বিশাল বিশাল চর। অথচ ‘পদ্মা পৃথিবীর বৃহৎ চারটি নদীর অন্যতম। একটি নদী শুধু পানিই সরবরাহ করে না, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পদ্মা নাব্য হারানোয় দেশী জাতের মাছ, শুশুক, ঘড়িয়ালসহ নানা মেরুদণ্ডি ও অমেরুদণ্ডি প্রাণী এবং জলজ উদ্ভিদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শুশুক ও ঘড়িয়াল এখন বিলুপ্তপ্রায়। এভাবে চলতে থাকলে এ নদী অদূর ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। মানুষের জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশের ওপর এখন বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের কারণে মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা নদী সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে, যা পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়। আর এতে পানির প্রবাহ বাধা পড়ায় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফারাক্কা ব্যারাজের বাংলাদেশ অংশে পলি পড়ে পুরোটাই চর পড়েছে। ফলে পানির গতি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় স্থানভেদে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর প্রস্থ ৪ থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আগে এর প্রস্থ ছিল দেড় থেকে ২ কিলোমিটার। এখনই পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে দুই পাড়ের ভাঙ্গনের কারণে নদীর প্রস্থ আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ভাঙ্গনও বাড়বে। পদ্মা নদীর নাব্য দিন দিন কমে যাওয়ায় গত ১০ বছরে পানির লেয়ার স্থানভেদে ২০ থেকে ৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বছরে যা গড়ে ২ ফুটেরও বেশি করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ার এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। আমাদের মনে রাখতে হবে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ অবস্থায় নদীগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা গেলে হয়ত কিছুটা হলেও পরিত্রাণ দেবে নদী, বেড়িবাঁধ, নদীতীরের বৃক্ষরাজি। আমাদের নদীগুলোকে যদি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হয় তা হলে দখল, দূষণ বন্ধ করার পাশাপাশি ড্রেজিং, নদী কূলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বৃক্ষ রোপণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। এটা করা গেলে রক্ষা পাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, কৃষিনির্ভর জীবন-জীবিকা, নদীকেন্দ্রিক যাতায়াত, অর্থনৈতিক কর্মকা-, মাছের উৎপাদন, সেচ-সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে অন্যতম ক্রীড়নক হবে এসব নদ-নদী। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×