ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৩ মে ২০১৮

নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই

ঢাকা থেকে বিএনপির রাজধানী লন্ডনে স্থানান্তরিত হওয়ার পর রোজই নানা গুজব বাজারে ছড়ানো হচ্ছে। অনেকের ধারণা, এগুলো তারেক রহমানের কীর্তি। লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে গৌরি সেনের টাকায় রাজকীয় বিলাস ব্যাসনে বাস করার সুযোগ পেয়ে এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে চেলাচামু-াদের বিলাসবহুল হোটেলের সভাকক্ষে ডেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করা এবং জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের চরিত্রে কর্দম নিক্ষেপ। এ জন্য অনেকের কাছে তার নাম হয়েছে ‘গোয়েবলসের নাতি।’ অধুনা বিএনপির শিবির থেকে যে গুজবগুলো ছড়ানো হচ্ছে, তা হলো : ক. বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিএনপির প্রস্তাবিত সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না। খ. বিএনপি নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন হবে না এবং হলেও তা পশ্চিমা কোন সরকারের স্বীকৃতি পাবে না। নির্বাচিত এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার বৈধতা পাবে না। গ. বিএনপি সহজেই জনসমর্থন নিয়ে শক্তিশালী আন্দোলন দ্বারা ‘দেশ মাতাকে’ জেল থেকে মুক্ত করবে এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনবে। ঘ. শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের অনেক সদস্যকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য বিচার করে কারাদ- দেয়া হবে। ঙ. বিএনপি আবার দেশে তাদের ‘গণতান্ত্রিক সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করবে। লন্ডনে বিএনপির এক ‘বুদ্ধিজীবী নেতার’ মুখে সম্প্রতি এই কথাগুলো শুনে তাকে মধুসূদনের কবিতার একটি লাইন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিÑ ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়... তাই ভাবি মনে।’ তাকে একটি গল্পও শুনিয়েছি। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব হওয়ার পর কুওমিং টাং সরকারের নেতা চিয়াং কাইসেক দেশ ছেড়ে সদল বলে তাইপেতে পালিয়ে মার্কিন পাহারায় বাস করতেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন প্রতিবছর নববর্ষের বাণীতে হুঙ্কার দিয়ে বলতেন, আগামী বছরেই আমরা কমিউনিস্ট শাসন উৎখাত করে মূল ভূখ-ে ফিরে যাব। এই স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। মৃত্যুর পর তাইপের মাটিতেই তাকে শেষ শয্যা গ্রহণ করতে হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদার পুত্র বাংলাদেশ থেকে এক এগারোর আমলে ‘আর রাজনীতি করব না’ মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে জামিনে লন্ডনে এসেছিলেন। তারপর মিসরের ক্ষমতাচ্যুত কিং ফারকের মতো লন্ডনে প্রায় দশ বছর ধরে বসবাস করছেন। বাজারে গুজব, মানুষ দেখলে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। নইলে নাইট ক্লাবে গিয়ে নাচতেও তার অসুবিধা হয় না। দিনের তারেক রহমান এবং রাতের তারেক রহমানের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মাথার উপরে দেশের আদালতের দশ বছরের কারাদ- ঝুলছে। কিন্তু ব্রিটিশ পাহারায় ভালই আছেন এবং হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন। কোনটাতেই সফল হতে পারছেন না। লন্ডনে বিএনপি যে গুজবগুলো ছড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের উচিত তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়া এবং দেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করা। আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের উচিত কেবল উন্নয়নের ডঙ্কা না বাজিয়ে বিএনপির নিত্যনতুন মিথ্যা প্রচারণার জবাব দেয়া। বেগম জিয়ার মুক্তি এবং তাদের প্রস্তাবিত সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে যোগ দেবে না এটা নেহায়ত দরকষাকষির কৌশল। গত নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যে ভুল করেছে এবং বিলুপ্তির পথে এগিয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা দ্বিতীয়বার এই ভুল করবে না। করলেও দলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত অথবা বিভক্ত হবে। ইসরাইলের এক সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেছেন। তাই বলে তাদের দল নির্বাচন বর্জন করেনি। জাপানের এক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তার দল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি। পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফকে দুর্নীতির দায়ে শুধু পদত্যাগ করতে হয়নি, আদালতের নির্দেশ ভবিষ্যতেও তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তার দল মুসলিম লীগ (এন) কি নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছে? বিএনপি বলছে, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হবে না। হলেও পশ্চিমা কোন সরকারের বৈধতা পাবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েও বিএনপি এ কথা বলেছিল। বাস্তবে দেখা গেল বিশ্বের বহু দেশই ওই নির্বাচনের সমালোচনা করলেও সকলেই হাসিনা সরকারের বৈধতা স্বীকার করে নিয়েছে। এমনকি বিএনপির পরম বন্ধু পাকিস্তানও। বর্তমান যুগে কোন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। হয় পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও ইউরোপ আমেরিকায় শক্তিধর দেশগুলো যদি দেখে হাসিনা সরকার তাদের স্বার্থের বিরোধী নয় বরং দেশের মানুষ এই সরকারকে মেনে নিয়েছে তদুপরি দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত রয়েছে এবং দেশটিতে তাদের অর্থ বিনিয়োগ নিরাপদ। তাহলে তারা বিএনপির প্রেমে হাসিনা সরকারের বিরোধিতা করতে যাবে না, বরং আনন্দে এই সরকারকে সহযোগিতা দেবে। বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জের চক্রান্তে যুক্ত হতে যাবে না আমেরিকাও। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক শত্রুতা ও মিত্রতার দর্শন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তাহলে ব্রিটেনের লেবার পার্টি ও আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে বহু যুগের যে আদর্শিক বন্ধন ছিল সেটা ভেঙ্গে টনি ব্লেয়ারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে লেবার পার্টি চরম প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে হাত মেলাতে পারত না এবং গালাগালি করে অবৈধ গাল্ফ যুদ্ধে নামতে পারত না। মুসলমান ও ইসলামের চরম শত্রু ইসরাইলের সঙ্গে ইসলামের রক্ষক হওয়ার দাবিদার সৌদি আরব হাত মিলিয়ে আরেকটি মুসলিম দেশের (ইরান) ওপর হামলা চালানোর চক্রান্ত করতে পারত না। বিএনপি নেত্রীকে কারাদ- দেয়া হয়েছে দুর্নীতির জন্য। কোন রাজনৈতিক কারণে নয়। বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। এ জন্য তার সমর্থনে সারাদেশের মানুষ গর্জে উঠেছে। আমেরিকা ও রাশিয়াসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তার কারাদ-ের নিন্দা করেছে এবং নিরাপত্তার জন্য ইয়াহিয়া-জান্তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। দুর্নীতির দায়ে দ-িত বেগম জিয়ার জন্য দেশের মানুষই যেমন আন্দোলনে নামেনি, তেমনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দও মুখ খোলেননি। এই অবস্থায় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি গণআন্দোলন গড়ে বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করবে এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনবে এটা আরব্য রজনীয় খোয়াব। শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির দায়ে এক এগারোর সরকার মামলায় জড়িয়ে ছিল। কিন্তু সফল হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়ার ব্যাপারে তাদের আমলের উদ্যোগ সফল হয়েছে। তাই বেগম জিয়া এখন জেলে, তারেক রহমান দেশ ছাড়া এবং শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনের’ নমুনা তাদের দুই দফায় শাসনামলে দেখেছে মানুষ। জনগণ কতবার আর বেল তলায় যাবে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এত হম্বিতম্বি এবং গুজব ছড়ানো সত্ত্বেও বিএনপি তাদের উটকো দাবিগুলো ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে যাবে। নইলে দল বিভক্ত অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য দলটির সাধারণ নেতা-কর্মীরা উন্মুখ। এমনও হতে পারে দলের মুষ্টিমেয় শীর্ষ নেতা নিজেদের স্বার্থে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ বিদ্রোহী হয়ে বিএনপির ব্যানারেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেষ্টা করবে। তাহলে বিএনপির অবস্থা হবে ১৯৭০ সালের ভাসানী ন্যাপের মতো ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ সেøাগান তুলে একাত্তর সালের যুগান্তকারী নির্বাচন ভাসানী ন্যাপ বর্জন করে। তখনকার এত বড় একটি দলের নির্বাচন বর্জন সত্ত্বেও রব ওঠেনি যে, এই নির্বাচনের বৈধতা নেই। এই নির্বাচন বর্জন করে ভাসানী ন্যাপ সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং মওলানা ভাসানী জীবিত থাকার কালেই দলটি আরও বিভক্ত এবং ধীরে ধীরে নামকাওয়াস্তে দলে পরিণত হয়। বিএনপি এবারের নির্বাচন যদি বর্জন করে তাহলে বেগম জিয়া তার জীবনকালেই দেখে যাবেন ‘দেশমাতার’ দলের সন্তানেরা দলে দলে নতুন মাত্রা খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং বিএনপির ধানের শীষে পচন ধরেছে। আমার বিশ্বাস বিএনপি এই ভুলটি করবে না। বরং নির্বাচনে যোগ দিয়ে ক্ষমতায় যেতে না পারুক, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করতে পারবে। সেটা তার ভবিষ্যত ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রস্তুত করবে। অন্যথায় ভাসানী ন্যাপের নিশ্চিত পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। [লন্ডন, ২১ মে সোমবার, ২০১৮]
×