ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৩ মে ২০১৮

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

(গতকালের পর) বিল্ডিং কোডে বজ্রনিরোধক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে ক্ষতির সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায়। ভবনের সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে মাটি পর্যন্ত বৈদ্যুতিক প্রবাহের পথ তৈরি করাই বজ্র নিরোধক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। একটি দালানের বজ্র প্রতিরোধ ব্যবস্থায় থাকে একটি এয়ারটার্মিনাল বা লাইটনিং রড যা দালানের সর্বোচ্চ বিন্দু যথা-সাইলো, ছাদ বা চিমনিতে স্থাপন করা হয়। এছাড়া থাকে সংযোগ তার ও গ্রাউন্ডিং ইলেকট্রোড। দালানের প্রত্যেক কর্নারে আর্থিং সিস্টেমের সংযোগ থাকা আবশ্যক। বজ্র নিরোধ ব্যবস্থার সব কমপোনেন্ট যথা- সংযোগ তার, লাইটনিং রড এবং আর্থিং একত্রিত করে সংযোগ দিতে হবে যাতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিস্টেম তৈরি হয়। পর্যাপ্ত আর্থিং রাখার সুবিধা এই যে, বজ্র বিদ্যুৎ বিভিন্ন পথে অনায়াসে মাটিতে গমন করতে পারে। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে হলে যোগ্যতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর পরামর্শ ও তদারকিতে দালানে উপযুক্ত বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। প্রাক মৌসুমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয়। এর সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটা সহায়ক গুণকের ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে মৌসুমি ঋতুতে ভূমির উচ্চতা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে যখন আর্দ্র বাতাস উচ্চতায় চলে যাওয়াসহ উচ্চ নিয়ামকসমূহ রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, রাজবাড়ী, সাতক্ষীরা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাত সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া এই ঋতুতে বায়ুম-লীয় পরিচলন দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে স্থানান্তর করে, ফলে বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হয়। পোস্ট-মৌসুমী সময়ে আক্রান্তীয় অভিসৃতি জোনের (ওঞঈত) পশ্চাৎপসরণ এবং বৃহদায়তন প্রচলন সংশ্লিষ্ট বায়ুম-লীয় পরিচলনের কারণে পার্বত্য জেলায়, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। শীতকালে পশ্চিমা গোলযোগের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে তাজা আর্দ্রতার সরবরাহ এবং স্থানীয় বায়ুম-লীয় পরিচলনের প্রভাবে বাগেরহাট, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট, খুলনা, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলায় বজ্রপাত হয়। তবে অন্যান্য ঋতুর তুলনায় এর প্রকোপ কম। আবার সৌরতাপের তীব্রতা শীতকালে কম থাকায় বায়ুম-লীয় অস্থিরতা হ্রাস পায় বলে বজ্রপাতের সংখ্যাও অনেক কমে যায়। কালবৈশাখী ঝড় ও ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোন অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভাল। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভাল হয়, যদি কোন দালানের নিচে আশ্রয় নেয়া যায়। উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ, উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। খোলা জায়গায় কোন গাছ থাকলে তা থেকে অন্তত ৪ মিটার দূরে থাকতে হবে। এ ছাড়া ফাঁকা জায়গায় কোন যাত্রী ছাউনি বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। ঘরে থাকলে বজ্রপাতের সময় জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। জানালা বন্ধ রাখতে হবে। ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ না করার পরামর্শ দেয়া হয়। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখা ভাল। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন। বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার চেষ্টা করতে হবে। প্রচ- বজ্রপাত ও বৃষ্টি হলে গাড়ি নিকটস্থ ছাউনি বা দালানের নিচে পার্ক করতে হবে। এ সময় গাড়ির কাচে হাত দেয়া বিপজ্জনক হতে পারে। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বেরোতেই হয় তাহলে পা ঢাকা জুতা পরে বের হতে হবে। রবারের গামবুট এক্ষেত্রে সব থেকে ভাল কাজ করবে। খোলা জায়গায় বা ফসলের মাঠে কাজ করা অবস্থায় আশ্রয়ের জায়গা না থাকলে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে গুটিশুটি মেরে বসে পড়তে হবে। কোন অবস্থাতেই মাটিতে শোয়া যাবে না। জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। নৌকায় থাকলে ছইয়ের নিচে থাকতে হবে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে বন্যা, ঝড় বা সিডরের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায়, কিংবা ভূমিকম্প পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যেই স্থাপিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ও দুর্যোগ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সুযোগ এনে দেবে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের গতিবিধি আগাম আরও নিখুঁতভাবে জানা যাবে। উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারায় গত পাঁচ বছরে ঘূর্ণিঝড়গুলো আগের মতো ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা যাবে। দুর্যোগের সময় দুর্গত এলাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রাখবে এই স্যাটেলাইট। বিভিন্ন এ্যাপ ব্যবহার করে দুর্যোগকবলিত মানুষ উদ্ধার কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে এবং উদ্ধারকর্মীরা সহজে ভুক্তভোগীকে খুঁজে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারবে। ঝড়ের আগের ছবি, পরের ছবির বিস্তারিত তুলনা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। ঠিক কোন অঞ্চলে কী ধরনের সহায়তা দরকার তা দ্রুত বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। উপগ্রহের ছবির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দুর্ঘটনা এড়ানো সহজ হবে বা দুর্ঘটনার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। ভূ-প্রকৃতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন যেমন : খাল-বিলে পানির উচ্চতা, নদীর নাব্যের তথ্য আরও নিখুঁতভাবে পাওয়া যাবে। এসব তথ্য ব্যবহার করে বন্যার ব্যাপ্তি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি, বন্যাপরবর্তী সময়ে কোন্ জমি কবে নাগাদ ফসলের জন্য আবার উপযোগী হবে, তা নির্ধারণ করা সহজ ও বাস্তবসম্মত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশের কোন ধরনের পরিবর্তন ঘটছে উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে সহজে বের করা যাবে। রাস্তাঘাটের নিপুণ ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি এবং সেই মানচিত্র মোবাইলে ব্যবহার করে যোগাযোগ দ্রুত এবং নিরাপদ করা সম্ভব হবে। এতদিন উপগ্রহের সেবা ব্যবহার শুধু মোবাইলে কথা বলা ও সামান্য ইন্টারনেটের ব্যবহারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজেদের উপগ্রহ হওয়ায় একে দুর্যোগ মোকাবেলা, যোগাযোগ ও কার্যকর গবেষণার অনেক কাজে ব্যবহার করা যাবে। উপগ্রহ এত দিন হাতেগোনা কিছু বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারত। এখন পদ্ধতি মেনে সাধারণ মানুষও উপগ্রহ থেকে তাৎক্ষণিক ছবি ও তথ্য পেতে পারবে। দেশে বজ্রঝড় উৎপন্ন হবার স্থান ও সময়, তার গতিপ্রকৃতি, বিস্তৃতি, জীবনকাল ইত্যাদি নিয়ে গভীর পর্যালোচনার জন্য ভূমিতে নির্মিত বজ্রপাত পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক এবং অপটিক্যাল ট্রান্সিয়েন্ট ডিটেক্টর (ঙঞউ) বা লাইটনিং ইমেজিং সেন্সর (খওঝ)-এর মতো স্যাটেলাইট যন্ত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ ও বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাহাড়, সমুদ্র, পরিবেশ বিজয়ের পর বাংলাদেশ জয় করল মহাকাশ। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পৌঁছে গিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়। বজ্রপাতসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে। এতে দুর্যোগ মোকাবেলা ও প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে, ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ এখন যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং এ জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। কিভাবে জনগণসহ অবকাঠামো দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে সে দিকে লক্ষ্য রেখে টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বজ্রপাত প্রকৃতির ভয়ংকর দুর্যোগ যা প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে অনেক মানুষের জীবন। প্রকৃতির নিষ্ঠুর থাবা থেকে মানুষকে বাঁচানোর আধুনিক কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। জীবনহানি রোধে এখনই যথার্থ সময় স্যাটেলাইট সুবিধা কাজে লাগিয়ে বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে প্রযুক্তিনির্ভর কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×