ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাদক ও ভেজাল খাদ্য মুক্ত দেশ গড়তে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২৩ মে ২০১৮

মাদক ও ভেজাল খাদ্য মুক্ত দেশ গড়তে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। তিনি ইচ্ছা পোষণ করেছেন ‘মাদকমুক্ত হবে দেশ’, আর তাতেই র‌্যাবসহ দেশের সকল বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধে নেমেছে। দেশ থেকে বহু মাদক ব্যবসায়ী পালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায় সহসাই দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ হবে। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল মাদকের চেয়েও ভয়াবহ। নেশা দ্রব্যে দেশের কিয়দাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর ভেজাল খাদ্যে গোটা দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খেয়ে মানুষের শরীরে এখন নানা রোগবালাই ভর করতে শুরু করেছে। বহু মানুষ ভেজাল খাদ্য খেয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। তাই দেশ ভেজাল খাদ্যমুক্ত হওয়া জরুরী। খাদ্যে ভেজাল মানেই জীবন নিয়ে খেলা। যারা খাদ্যে বিষ দেয় তারাও জানে বিষাক্ত খাবার খেলে জটিল কঠিন রোগ হবে। ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধিতে মরবে মানুষ। তবুও জেনে শুনে এরা খাদ্যে বিষ মিশাচ্ছে; ভেজাল দিচ্ছে। মানুষের জীবন নিয়ে খেলায় মেতেছে এক শ্রেণীর অর্থলোভী মানুষ। তাদের বিচার কি হওয়া উচিত? ভেজালের ভয়াবহতা এখন এমন চরম আকার ধারণ করেছে যে, তার জন্য কঠিন এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা দরকার। প্রয়োজনে আইন করতে হবে আরও কঠোর। বিচারকার্য যেন বিলম্বিত না হয় সে জন্য দ্রুত বিচার আইনে বিচারকাজ নিষ্পত্তি করতে হবে। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেও শাস্তি দেয়ার বিধান করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাৎক্ষণিক বিচার সম্পন্ন করে দ-ের বিধান করা যেতে পারে। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না। এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এ জন্য চলমান ভেজালবিরোধী আইনকে কঠোর করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্র্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এদেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স’ ১৯৫৯ বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইন যখন হয়েছে তখন মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে জনস্বার্থে আইন সংশোধন না করে নতুন করে কঠোর আইন তৈরি করতে হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এই অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। আর এভাবে খাদ্যে ভেজাল হলে পরবর্তী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। জাতীয় স্বার্থেই সরকারে কঠোর হতে হবে। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ স্ট্র্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি শাস্তির দেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। বিএসটিআইর জন্য ‘ইকুইপমেন্ট’ ক্রয় ও ধারাবাহিকভাবে দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা দরকার। খাদ্যে বিভিন্ন ভেজাল দ্রব্য মেশানো শুরু হয় আশির দশক থেকে। নব্বই এবং তার পরবর্তীসময় থেকে এ প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে মাছ-মাংস, দুধ, শাক-সবজি যাবতীয় ফল-ফলাদি এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধে পর্যন্ত নানাবিধ বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়। ওইসব বিষাক্ত কেমিক্যালে মানবদেহের ক্ষতিসাধন হতে থাকে। খাদ্যদ্রব্যের এ অবস্থা নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে লেখালেখি ও আলাপ-আলোচনা হয়। বলাবাহুল্য, এসব খবর কার্যত প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছে। সরকার খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজাল দূর করার জন্য নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ভ্রাম্যমাণ আদালতও করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত করায় ভেজাল কর্মকা- কিছুটা কমলেও কার্যত খাদ্যে ভেজাল মেশানো বন্ধ হয় না। সুস্থ জীবন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হার্ড লাইনে অবস্থান করতে হবে সরকারকে। ভেজাল ঠেকাতে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) এটাই আমরা জানি। জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানটি অতিগুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিভাগটির সুফল আশান্বিত হবার মতো নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ভেজাল ও অননুমোদিত খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রির দায়ে বিএসটিআই মাঝে মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। আদায় করে লাখ লাখ টাকা জরিমানাও। কিন্তু তাদের এ কর্মকা- অনেকটাই লোক দেখানোর মতো। ভেজালের দায়ে অভিযুক্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই জরিমানা পরিশোধ পর সবাইকে ম্যানেজ করে আবারও সেই একই অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা এর জন্য বিএসটিআইকেই দায়ী বলে মনে করেন। ‘নিধিরাম সর্দারের’ মতো শুধু মামলা দায়ের ও জরিমানা আদায়ের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা। ফলে ভেজালের কারবারীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতদিন মাছে ফরমালিন মিশানো হতো। এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য দুধেও নির্বিচারে ফরমালিন মিশানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত প্রকাশ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে পাকানো হচ্ছে আম, কাঁঠাল ও কলা। আর শুঁটকিতে স্প্রে করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ ‘ডার্টি ডজন’ পরিবারভুক্ত কীটনাশক ডিডিটি। আইসক্রিমসহ লোভনীয় সব মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে চামড়া ও অন্যান্য শিল্পে ব্যবহৃত বিপজ্জনক রং ও রাসায়নিক। বেকারি পণ্যে মিশানো হচ্ছে গাড়ির পোড়া মবিল আর মসলায় ইটের গুঁড়া। আর বাসি ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রীর ছড়াছড়ি তো দেশের সর্বত্রই। শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূলসহ নিত্যদিনের খাবারেই রয়েছে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ঝুঁকি। পকেটের টাকা খরচ করে যা কেনা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই প্রকৃতপক্ষে বিষ। আর বিষাক্ত এ খাবার গ্রহণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে দেশবাসী। বিশেষ করে শিশুরাই এর প্রধান শিকার। খাদ্যে ভেজালের অপরাধে দেশে কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থাই ভেজালকারীদের উৎসাহিত করছে। আর এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাই মিলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনই সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সর্বতোভাবে তৎপর হতে হবে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সর্বোপরি গণমাধ্যমসহ ব্যাপক জনসচেতনতাও প্রত্যাশিত। তবেই হয়তো ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×