ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি সন্ত্রাসী দল ॥ কানাডার কোর্টে ফের রায়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৩ মে ২০১৮

বিএনপি সন্ত্রাসী দল ॥ কানাডার কোর্টে ফের রায়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে তৃতীয়বারের মতো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবেই রায় দিয়েছে কানাডার ফেডারেল আদালত। বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আগের দেয়া রায় আদালত বহাল রেখেছে। দেশটিতে আশ্রয়প্রার্থী বিএনপি কর্মী মোস্তফা কামালের পক্ষ থেকে করা একটি রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে আবেদনটি খারিজ করে এ রায় দিয়েছে ফেডারেল আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, তিনি (মোস্তফা কামাল) বাংলাদেশে বিএনপি নামে যে রাজনৈতিক দলের সদস্য পরিচয়ে আশ্রয় চাচ্ছেন, সেই রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যুক্ত। এ নিয়ে কানাডার আদালতে তৃতীয়বারের মতো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষিত হলো বিএনপি। প্রতিবারই বিএনপির সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তিনজন। কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী বিএনপি নেতা মোঃ মোস্তফা কামালের পক্ষ থেকে করা রিভিউ আবেদনের রায়ে পূর্বের অবস্থানে থাকার বিষয়টি ইতোমধ্যেই আদালত নিজেদের ওয়েবসাইটে জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি মোস্তফা কামালের রিভিউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন খারিজ করে এ রায় দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী হন মোঃ মোস্তফা কামাল। তার বিষয়ে কানাডার সরকার আদালতকে আগেই বলেছিল, বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাতেও দলটি চেষ্টা করছে বলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে। জানা গেছে, তৃতীয় বারের মতো দেয়া রায়ে তিন বারই বিএনপির সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তিন জন। প্রতিবারই আদালত বলেছে, বিএনপির সদস্যকে আশ্রয় দিলে সে দেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। প্রতিবার শুনানিতে বাংলাদেশে বিএনপির ডাকে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক নাশকতার কথা তুলে ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনের কাজ। তার তার সদস্যদেরকে তারা আশ্রয় দিতে পারেন না। কানাডার আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যে সংগঠন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, আছে বা ভবিষ্যতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে, তাহলে তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে সে দেশে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। সবশেষ রায়টি সোমবার ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। সেখানে কারণসহ ব্যাখ্যা দিয়ে জানানো হয়েছে, বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে তাদের দেশের মন্ত্রীর বক্তব্যকেই আবারও মেনে নিয়েছে ফেডারেল আদালত। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী হন মোস্তফা কামাল। আবেদনে তিনি নিজেকে বিএনপির সহযোগী সংগঠন য্বুদল নেতা ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। এমনকি কানাডিয়ান বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্সির (সিবিএসএ) একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সরকার উৎখাতে দলটি (বিএনপি) প্ররোচণা দিচ্ছে- এমন যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে বলেও কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে দাবি করেছিলেন দেশটির জননিরাপত্তা ও জরুরী তৎপরতা বিষয়ক মন্ত্রী। সে সময় বিএনপিকে নিয়ে কানাডা সরকারের এই বক্তব্য গ্রহণ করে মোস্তফা কামালের আবেদন খারিজ করে দেয় দেশটির আদালত। পরে তিনি দেশটির ফেডারেল আদালতে রিভিউয়ের জন্য আবেদন করেন। রায়ে বলা হয়, মোস্তফা কামালের রিভিউ আবেদনের পর ফেডারেল কোর্টের পক্ষ থেকে জননিরাপত্তা ও জরুরী তৎপরতা বিষয়ক মন্ত্রীর দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কানাডার অভিবাসন ও শরণার্থী বোর্ডের অভিবাসন বিভাগ (আইডি)-কে নির্দেশ দেন। তখন জননিরাপত্তা ও জরুরী তৎপরতা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিনিধি সিবিএসের প্রতিবেদন রেফারেন্স হিসেবে আইডির কাছে তুলে দেন। ওই প্রতিবেদনসহ সম্পূর্ণ বিষয়টি যাচাই ও পুনর্বিবেচনা করে এবং পরবর্তী শুনানিগুলোতে মন্ত্রীর যুক্তি পর্যালোচনা করে আইডি কানাডা সরকারের আগের বক্তব্যই সঠিক বলে সিদ্ধান্তে আসে। আইডির সিদ্ধান্ত অনুসারে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর যৌক্তিকতা রয়েছে উল্লেখ করে ফেডারেল আদালত মোস্তফা কামালের আপীল আবেদন খারিজ করেন। একইসঙ্গে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। আপীলের রায়ের পর আইডির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়াগত অন্যায্যতার অভিযোগ করে সিদ্ধান্ত রিভিউয়ের আবেদন করলে এই যুক্তি মেনে নেননি আদালত। আদালত উল্টো বলেছেন, কানাডার অভিবাসন ও শরণার্থী সুরক্ষা আইন-আইআরপিএর প্রেক্ষিতে আইডির সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যৌক্তিক। এর আগে কানাডার আদালতের দুটি রায়ে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে। ২০১৭ সালের বছরের ১২ মে দেশটির ফেডারেল কোর্টের বিচারকের দেয়া রায়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপিকে এই সংগঠনের তকমা দেয়া হয়। তখন দেশটিতে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের করা রাজনৈতিক আশ্রয় নাকচ করে দেয়া রায়ে এই মন্তব্য করেন বিচারক জে ফদারগিল এই মন্তব্য করেন। কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন প্রকাশ পেলে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে আদালত ওই নেতার পরিচয় প্রকাশ করেনি। তাকে এস এ অদ্যক্ষরে পরিচয় দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। আদালতের নথি থেকে জানা যায়, ‘এস এ’ আদ্যক্ষরের ব্যক্তি ২০০৪ সালে যুবদলে যোগ দেন। ২০১২ সালে তিনি বিএনপির নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হন। ২০১৪ সালে তিনি কানাডায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন ডিভিশনের সিদ্ধান্তে বলা হয়, বিএনপি সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত আছে, সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ছিল, সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হতে পারে- এটা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে জুডিসিয়াল রিভিউর আবেদন করেন ‘এস এ’। ফেডারেল কোর্টের বিচারক জে, ফদারগিল আবেদনটি খারিজ করে দিয়ে রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি করেন। একই সঙ্গে ফেডারেল কোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগের আবেদনটিও তিনি নাকচ করে দেন। বিচারক বলেন, ‘ইমিগ্রেশন ডিভিশনের পর্যালোচনায় আমি কোন ভুল খুঁজে পাইনি। তার আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত জুডিসিয়াল রিভিউর আবেদনে ফেডারেল কোর্টের বিচারক জাস্টিস ব্রাউন বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করেন। সে সময় ঢাকার মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের এক ব্যক্তি বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীর পরিচয় দিয়ে ক্যানাডা সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন। তার স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাসের আবেদন ২০১৫ সালে প্রাথমিক অনুমোদন পেলেও গত বছরের ১৬ মে তাকে ‘ক্যানাডায় প্রবেশের অযোগ্য ঘোষণা’ করেন দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তা। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কানাডার ফেডারেল আদালতে যান জুয়েল গাজী। জুয়েল গাজী আদালতে দাবি করেন, বিএনপি সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না এবং দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করায় কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও নজির রয়েছে। কিন্তু অভিবাসন কর্মকর্তার তুলে ধরা লাগাতার হরতাল ও সহিংসতার বিবরণ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে আবেদনকারীর যুক্তি হারিয়ে যায়। প্রতিটি রায়েই বিএনপি-জামায়াতের হরতাল অবরোধের নামে নাশকতা, মানুষ হত্যার নানা তথ্য উঠে আসে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, বিএনপি নেতৃত্ব একবারই এক বাক্য সন্ত্রাসের নিন্দা করেছেন, যখন বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে সাতজন ঘুমন্ত মানুষকে হত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বিএনপি তাদের কর্মীদের সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের নিন্দা করেছে- এমন আর প্রমাণ আদালতের সামনে আসেনি। অভিবাসন কর্মকর্তার যুক্তি থেকে উদ্ধৃত করে বিচারক তার রায়ে বলেছেন, বাংলাদেশের একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে এমন একটি ভাবমূর্তি বিএনপির কাম্য হওয়ার কথা নয়, যাতে মনে হয় যে দলটি অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত ও সহিংসতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু বিএনপির লাগাতার হরতাল এবং তাতে অব্যাহত সহিংসতা এই বিশ্বাস জাগায় যে, নিজেদের কর্মীদের সহিংসতা থেকে না সরিয়ে দলটি কেবল কৌশল হিসেবে হরতালে সহিংসতার নিন্দা করেছে। ২০১৫ সালে বিএনপির তিন মাসের অবরোধ-হরতালে প্রতিদিন বহু যানবাহন নাশকতার শিকার হন। অভিবাসন কর্মকর্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে রায়ে বিচারক বলেন, ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি ‘সহিংস বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
×