ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

আবার রোলার কোস্টারে ইরানের জীবন

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২৩ মে ২০১৮

আবার রোলার কোস্টারে ইরানের জীবন

সাধারণ ইরানীদের জন্য বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল আর দশটি দিনের মতোই। সন্ধ্যায়, রাস্তায় ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। অনেকেই আবার জড়ো হয়েছিলেন পশ্চিম তেহরান স্কয়ারে। বেসবল ক্যাপ মাথায় এক তরুণ সেখানে গাইছিলেন এডেলের ‘সামওয়ান লাইক ইউ,’ পাশে তার বোন বাজাচ্ছিল কী-বোর্ড। পার হয়ে যাওয়া এক পথিকের মন্তব্য, গানের অর্থ আমি বুঝতে না পারলেও সুরটি কিন্তু চমৎকার। আন্ডারপাসের নিচে বসা দুই কিশোর। রুটি কিনে তাদের পাশ কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন একজন। তাদের কারোরই ধারণা নেই যে, হাজার মাইল দূরে কলমের এক খোঁচায় নির্ধারিত হতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্য। যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে। এমনিতেই ইরানে সাধারণ মানুষের জীবন রোলার কোস্টারে চড়ার মতো। অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের প্রভাব যেমন, তেমনি কখনও তাদের জীবন নির্ভরশীল বিদেশী নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর। নিজেদের পথ বেছে নেয়ার সুযোগ তারা খুব কমই পেয়েছেন। সৈয়দ আলী আকবরি, ৩৩ বছরের টেকনোলোজির ছাত্রের ভাষায়, ‘আমাদের কথা শোনার কেউ নেই। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দেয়া।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই চুক্তি বাতিলের ঘোষণা ইরানীদের জীবনকে ঠেলে দিল আরেক কঠিন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে। বিষয়টি যেমন মানসিকভাবে উদ্বেগের তেমনি উন্নতির পথেও অন্তরায় বলে গণ্য করছেন অনেকে। ইতোমধ্যেই দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসপ্রায় ইরানের অর্থনীতিকে মোকাবেলা করতে হবে নতুন নিষেধাজ্ঞা। পরমাণু চুক্তির ফলে কিছুটা খোলামেলা পরিবেশে সাধারণ মানুষ চেষ্টা করছিলেন মানিয়ে নিতে। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও তারা দেখছিলেন আশার আলো। সম্প্রতি ইরানজুড়ে বিক্ষোভকারী কিংবা ব্যবসায়ীদের জন্য পরিস্থিতি যে আরও কঠিন হয়ে পড়বে তাতেও নেই কোন সন্দেহ। মরুশহর খাসানের মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী নাসরীন সতদেহ। নিজে অনেকবার জেলে গিয়েছেন। সেদিন মামলা পরিচালনা করছিলেন বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এক সক্রিয় কর্মীর পক্ষে। তার মতে, পারমাণবিক চুক্তিটি আমাদের অন্তত নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। টেলিফোনে জানান, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ কট্টরপন্থীদের আরও শক্তিশালী করবে, বিস্তৃত হবে তাদের থাবা দেশজুড়ে। মানবাধিকার কর্মীদের জন্য খারাপ দিন আসছে বলেই আমার ধারণা। তেহরানের ব্যবসায়ী হামিদ রেজা ফারাজীও আঙ্গুল তুলেছেন কট্ট্রপন্থীদের দিকে। পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০১৫তে, ৩৫ বছরের ফারাজী খুলেছিলেন একটি পারফিউম শপ। আশা করছিলেন ভাল ব্যবসার। নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে ব্যবসায়। তার ভাষায়, আমি ভেবেছিলাম অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে আমার ব্যবসা বাড়বে, লোকেরা বেশি করে কিনবে পারফিউম। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। ক্রেতাদের জন্য উচ্চহারে কমিশন দিয়েও সুবিধে হয়নি ব্যবসায়। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন দোকান। তিনি বলেন, এই চুক্তি বাতিলে শেষ পর্যন্ত জিতে গেল ইরান আর আমেরিকার কট্টরপন্থীরা, আমরা প্রহর গুণছি শেষ মুহূর্তের। এখনও ইরানে সাধারণ মানুষের জীবন সেই ১৯৭৯’র ইসলামিক বিপ্লব বা আট বছর ধরে চলা ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোর মতোই। মিঃ আকবরি এমনকি ট্রাম্প কী বলেন তা জানারও তোয়াক্কা করেননি। অন্যান্য দিনের মতো তিনি ঘুম ভেঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে। আরেক সতীর্থ তাকে জানায়, এক লম্বা বক্তৃতা শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলেছেন। তার প্রতিক্রিয়া ছিল, নিষেধাজ্ঞা মানেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সামনে খারাপ দিন। তেহরানে মেট্রো স্টেশনে বাস ড্রাইভার নিত্যদিনের মতো তার কাজ করলেও তার ভাবনায় কোথাও যেন শূন্যতা বিরাজমান। ডাঃ মারজেহ মেরাজাই এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চাইছিলেন তিনি তার মেয়ের জন্য কোন ভাল কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন কি না? মেয়েটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী হয়েও একটি ফার্মেসিতে কাজ জোগাড় করতে পেরেছে যেখানে বেতন মাত্র ১৫০ ডলার। গলরিজ শপিং সেন্টারের ছোট্ট এক বুথে বসে পানির পাইপ আর জিপ্পো লাইটার বিক্রেতা ৩৬ বয়সী আমির। প্রথমে কিছুই বলতে চাননি ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বলেন, এটি খুব দুঃখজনক যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের জীবন বদলে দিতে চাইছেন। আর আমাদের নেতারা সারাক্ষণ সবার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। তিনি এই প্রতিবেদককে বিশ্ববাসীর কাছে যে বার্তা পৌঁছে দিতে বলেন তা এই, ‘আমি একটি স্বাভাবিক জীবন চাই। ইরানের আমির স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার চায়।’ গত ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে ৮০টি নগরীতে বিক্ষোভে অংশ নেয়া ইরানের সাধারণ মানুষ যে কেবল ক্ষোভের বশে রাস্তায় নেমেছিল তা নয়। তাদের ছিল পরিষ্কার লক্ষ্য। এতে অংশ নেয়া একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি প্রকাশ করেছেন তীব্র ঘৃণা অবশ্য এটাও জানাতে ভোলেননি, প্রথম সুযোগেই তিনি আবার শাসক দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবেন। পিয়ানো বাদক ২৮ বছরের শাদী আরও বলেন, ‘মানুষ এ মুহূর্তে অস্থিরতা ভয় পাচ্ছে। তারা ব্যস্ত তাদের সামান্য যা কিছু আছে তা রক্ষায়। তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। তবে আমি তৈরি আবার প্রতিবাদে অংশ নিতে।’ দমন-পীড়নের ভয়ে নিজের পুরো পরিচয় প্রকাশ না করলেও এই নারী আরও বলেন, ‘এই অবস্থায় বিক্ষোভে অংশ নিলে অনেকেই হয়ত আমাকে দেশদ্রোহী বলবে কিন্তু আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের দাবি এখনও- খাদ্য, চাকরি, স্বাধীনতা। আর এগুলোর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জাতীয় সংহতির কী সম্পর্ক?’ রাস্তায় অনেকেই আগামী দুর্দশার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নিজেদের নেতাদের দুষছিলেন। যদিও এটি সবার জানা নেপথ্যের কারিগর কে। ফাতেমা, বয়স ২২, পারিবারিক পরিচয় জানাতে অক্ষমতা প্রকাশ করে মিষ্টি হেসে বলেন, ট্রাম্পই আমাদের দুর্দশার জন্য দায়ী। দুই কন্যার এক জননীর মন্তব্য, সবাই আমাদের সর্বনাশ করছে। আরেকজনের প্রত্যুত্তর, আমরা যুদ্ধ দেখেছি; তার কাছে এই নিষেধাজ্ঞা কিছুই না। সেই নারীর জবাব, যুদ্ধ কোন মানদ- হতে পারে না। আমি চাই উন্নয়ন। কফি শপের ক্যাশ রেজিস্টারের পেছনে বসে মোহাম্মদ হোসেইনি বলেন, আমেরিকা আর ইরানের নেতাদের উচিত এক সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করা। রাস্তার ফুটপাথে ক্যাকটাস বিক্রেতা মোঃ আমির। এক বছর যতেœ লালন করা একটি ক্যাকটাস চারা দাম চেয়েছিলেন ৭০০০ তোমান। ক্রেতা ঐ দামে কিনতে রাজী না হওয়ায় দিয়ে দিতে চাইলেন বিনে পয়সায়। কথা না বাড়িয়ে ক্রেতার নীরব প্রস্থান। ৫ বছর বয়স থেকে শুনছেন পিংক ফ্লয়েড। প্রিয় গানÑ ‘হাই হোপস’। পরনেও পিংক ফ্লয়েড টি-শার্ট। তার কাছে জানতে চাওয়া, সে নিজে এই অবস্থায় কতটা আশাবাদী? তার উত্তর, না; আমি কোন আশা দেখছি না। সূত্র: নিউ ইর্য়ক টাইমস
×