ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

কেন মোদি-শি শীর্ষ বৈঠকে বসলেন

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ২৩ মে ২০১৮

কেন মোদি-শি শীর্ষ বৈঠকে বসলেন

এশিয়ার দুই মহাশক্তি ভারত ও চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে নানান জটিলতা ও টানাপোড়েনে আবর্তিত। একে অপরের ভূখ-ের ওপর তাদের দাবি কয়েক দশকের পুরনো। পরস্পরের প্রতি বিরক্তি ও অস্বস্তিবোধের দীর্ঘ তালিকা আছে তাদের। একে অপরের বন্ধুদের তারা অপছন্দ করে। পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাস আছে। ফলে যতটা না দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা করার তার চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা করার ব্যাপারেই তাদের উৎসাহ বেশি। ১৯৬২ সালে দুদেশের মধ্যে অল্পদিনের সীমান্ত যুদ্ধও হয়েছে। অন্যসময় এই দুই প্রতিবেশী হিমালয়ের ওপর দিয়ে পরস্পরের প্রতি সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। এই পটভূমিতে গত ২৭ ও ২৮ এপ্রিল চীনের উত্থানে দুই দেশের নেতাদের অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়ত মাইলফলক নয় তবে নিঃসন্দেহে তা দুদেশের সম্পর্কের গতিপথ ইতিবাচক দিকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। গত দু’বছর ধরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচকতা বিরাজ করছিল তার প্রেক্ষাপটে কোন লিখিত এজেন্ডা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারমুক্ত অবস্থায় আলোচনা এক বড় ধরনের অর্জন। দীর্ঘস্থায়ী সীমান্ত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে শি জিনপিং ও মোদি সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার সার্বিক লক্ষ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতা গড়ে তোলার জন্য পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে নিজ নিজ সামরিক বাহিনীকে পথনির্দেশনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই নেতা সন্ত্রাসবাদের অভিন্ন হুমকির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এই হুমকি মোকাবেলায় পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছেন। তারা আফগানিস্তানে যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্প নিতেও রাজি হয়েছেন যা নিঃসন্দেহে পাকিস্তানকে উদ্বিগ্ন ও হতাশ করবে। ব্যাপারটা যদি সত্যি কার্যকর হয় তাহলে তা আফগানিস্তানে ও আঞ্চলিক শান্তির ক্ষেত্রে মোড় পরিবর্তনের কাজ করবে। বেজিং দিল্লীকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে আন্তঃসংযোগের মতো ইস্যুর ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে চীনের কোন মৌলিক পার্থক্য নেই তবে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ এর মতো ইস্যুতে বেজিং দিল্লীর ওপর কোন চাপ দেবে না। পাশ্চাত্যে যখন সংরক্ষণবাদী প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে তখন বৈশ্বিক পরিচালনায় চীন-ভারতের একত্রে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও শীর্ষ বৈঠকে গুরুত্ব লাভ করে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন ভারত ও চীন দুই সর্ববৃহৎ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশ। প্রত্যেকের জনসংখ্যা একশ’ কোটিরও বেশি। এই অবস্থায় দুই দেশ বিশ্বের বহু মেরুকরণের ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মেরুদ- হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে উন্মুক্ত ও বহুত্ববাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে উন্নয়ন সাধনের জন্য তাতে সকল দেশ অবাধে অংশ নিতে পারবে। এটা বিশ্বের সকল অঞ্চলে দারিদ্র্য ও অসাম্য দূরীকরণেও সাহায্য করবে। তবে শীর্ষ বৈঠক থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মৌলিক দ্বিপক্ষীয় মতপার্থক্যগুলো চীন-ভারত সম্পর্কের ওপর এখনও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। কাঠামোগত যে বিষয়গুলো গত দুবছর ধরে এই সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করেছে সেগুলো এখনও যথেষ্ট প্রভাব রাখছে এবং রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে না। যে বিষয়টি সমানভাবে স্পষ্ট তা হলো উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথে এই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতন এবং তারা এই সম্পর্ককে স্থিতিশীল করতে আগ্রহী। চীনের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কথা দিল্লী বারবার বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে। এছাড়াও শীর্ষ বৈঠকের ঠিক আগে ভারত চীনের এক অঞ্চল এক পথ এবং পাকিস্তানের পৃৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি নিজের বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেছে। অনেকে বলে যে ভারত যে এই শীর্ষ বৈঠকে দুর্বলের অবস্থান থেকে গেছে তা নয়। গত বছর দোকলাম ইস্যুতে ভারত শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রশ্নেও ভারত একই অবস্থান নিয়েছে। এইভাবে ভারত চীনকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে চীনের কঠোর শক্তির কাছে তারা মাথা নত করবে না। প্রধানত এই কারণেই চীনের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ঘরোয়া শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। এ এক বিরল ঘটনা যা সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। চীনা পণ্যের ওপর আমেরিকার শুল্ক আরোপের ফলে চীনে এক প্রতিকূল বায়ুপ্রবাহ ঘটছে। চীন যখন মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে প্রতিকূল বাতাস বইছে এবং চীন যখন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর কাজ এখনও সম্পন্ন করতে পারেনি তখন অভিন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশে নয়াদিল্লীর সঙ্গে একত্রে কাজ করা বেজিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে চীনের একত্রে কাজ করতে যাওয়া থেকে এটাই দাঁড়ায় যে বেজিং উপলব্ধি করতে পারছে যে পাশ্চাত্যের মনোভাব দ্রুত তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তার অংশীদার দরকার যারা এসব চ্যালেঞ্জের কিছু কিছু মোকাবেলা করতে পারবে। তার ঐতিহ্যবাহী অংশীদার রাশিয়া খুব একটা কাজে আসবে না কারণ দেশটি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে উঠেনি। অন্যদিকে ভারত শুধু যে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি তাই নয়, উপরন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে এক সম্ভাবনাময় শক্তিও বটে। তবে দুই দেশের অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠক থেকে অনেক কিছু ঘটে যাওয়ার প্রত্যাশা করা ঠিক। মনে রাখতে হবে যে চীন-ভারতের বৈরিতার অনেক ইস্যু আছে। সেই ইস্যুগুলো তারা কিভাবে সমাধান করার মনোভাব দেখান তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×