ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন আর পূরণ হলো না, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল মুক্তামণি

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৪ মে ২০১৮

স্বপ্ন আর পূরণ হলো না, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল মুক্তামণি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘মেয়েটির স্বপ্ন ছিল সুস্থ হয়ে ছোট ভাইকে কোলে নেবে, বোনের সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে যাবে’ কিন্তু তার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল ১২ বছর বয়সী রক্তনালীর টিউমারে আক্রান্ত সাতক্ষীরার মুক্তামণি। বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামে নিজ বাড়িতে সে মারা যায়। সম্প্রতি মুক্তামণির শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়েছিল বলে জানান তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন। তার ডান হাতটি অসম্ভব আকারে ফুলে গিয়েছিল, পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল এমনকি পোকাও বেরিয়েছিল। কয়েকদিন ধরে জ্বরেও ভুগছিল সে। তবে মঙ্গলবার রাত থেকে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এরপর সকালে মুক্তামণি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মুক্তামণির বাবা জনকণ্ঠকে জানান, মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের অর্থো সার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ হাফিজ উল্লাহ দেখতে আসেন। মুক্তাকে দেখে তিনি বলেন, ‘মুক্তামণির অবস্থা খুবই খারাপ। রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। তার হাতের যে টিউমার অপারেশন করা হয়েছিল, সেটা আবার বড় আকার ধারণ করেছে। টিউমারে দুই-তিনটি ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন ওর শরীরে অনেক জ্বর ছিল। সকাল থেকে খাওয়া-দাওয়া করেনি। জ্বরের জন্য ওষুধ দিয়েছি। ওর যে অবস্থা, সাতক্ষীরাতে সেই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না। সেজন্য ঢাকায় পাঠাতে পরামর্শ দিয়েছি।’ মেয়ের মৃত্যু শোকে আচ্ছন্ন এই পিতা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত থেকে মেয়ের জ্বর ছিল। ডাক্তার দেখে যাওয়ার পর থেকে আমরা সারারাত পাশেই বসে ছিলাম। মারা যাওয়ার আগ থেকেই আমার মেয়ে মুখে কিছুই নেয়নি। সকালে একটু পানি খেতে চেয়েছিল। তখনও ওর পাশে আমি আর ওর মা বসে ছিলাম। মুক্তার দাদি পানি আনতে আনতেই সে চলে গেল। আমার মা পানি খেয়েও গেল না!’ জনকণ্ঠের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, মুক্তামণির মৃত্যুতে তার পরিবার ও এলাকাবাসীর আহাজারি যেন থামছেই না। বুধবার মুক্তাকে একনজর দেখতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। মুক্তামণির মৃত্যুর খবর শুনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন তাকে দেখতে আসেন কামারবায়সা গ্রামে। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে মুক্তামণিকে তার দাদার কবরের পাশে কামারবায়সা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এদিকে, মুক্তামণির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘জীবনে বহু রোগীর চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছি, আবার বহু রোগীর মৃত্যুও দেখেছি। কিন্তু মুক্তামণির মৃত্যু আমার জন্য হার্ট ব্রেকিং খবর। ছোট্ট এ শিশুটির ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না’। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরেই মুক্তামণির বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলে আসছিলাম। গতকালও সাতক্ষীরার সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে দুজন চিকিৎসককে তাদের বাড়িতে পাঠাই। বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসকরা জানান, মুক্তামণির শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। হাতে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মারাত্মক (হিমোগ্লোবিনের অভাব) রক্তশূন্যতায় ভুগছে। তখন মুক্তামণির বাবাকে বলি, ঢাকায় না হউক অন্তত সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু তার বাবা রাজি হননি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘স্যার, অনেক তো চেষ্টা করেছেন। ভাগ্য খারাপ- ভাল হয় নাই। এখন মেয়েটা অনেক কষ্ট পাইতাছে। আর টানাহেঁচড়া করতে চাই না। আল্লাহর হাতে ছাইড়া দিছি। মরলে বাড়িতেই মরুক।’ আর আজ বুধবার সকালেই তার মৃত্যু সংবাদ শুনতে হলো।’ ছয় মাস ১০ দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২২ ডিসেম্বর ফোলা হাত নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় মুক্তামণিকে। এ সময় চিকিৎসকরা তাকে মাসখানেক পরে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন মুক্তার বাবা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। তবে এরপর আর ঢামেকে আসতে রাজি হয়নি মুক্তামণি। তাই বাড়িতেই কোন মতে চলছিল তার চিকিৎসা। দুই বছর বয়সে মুক্তার এ রোগের সূত্রপাত এবং সাড়ে নয় বছর বয়সে দেহের চেয়ে হাত মোটা হয়ে যায়। মুক্তামণিকে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই ঢামেকের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় এটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। এরপর ২৫ জুলাই ঢামেকের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লালকে খবর দিয়ে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মুক্তামণির সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। সব শুনে প্রধানমন্ত্রী মুক্তামণিকে প্রয়োজনে বিদেশ নেয়ার নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে ওই দিনই ঢামেকের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ই-মেল করে মুক্তার বিষয়টি জানানো হয়। ২৭ জুলাই প্রায় এক ঘণ্টার ভিডিও কনফারেন্সে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা মুক্তামণিকে দেখেন। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টগুলোও দেখানো হয়। সব কিছু দেখে তারা পরে আলোচনা করে জানানোর কথা বলেন। এরপর তারা ই-মেল করে জানিয়েছেন, মুক্তামণির রোগ আরোগ্যযোগ্য বা দেহে অস্ত্রোপচার করার মতো নয়। ৩ আগস্ট ঢামেক পরিচালকের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ঝুঁঁকি হলেও সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে মুক্তামণিকে সুস্থ করার জন্য ঢামেকের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। ৫ আগস্ট বায়োপসি করা হয়। ৮ আগস্ট বায়োপসির রিপোর্ট আসে। রিপোর্ট পেয়ে চিকিৎসকরা জানান, মুক্তামণির শরীরে ক্যান্সার ছড়ায়নি। সে বিরল রোগেও আক্রান্ত নয়। মুক্তামণি রক্তনালী টিউমারে আক্রান্ত। এরপর ১২ আগস্ট তার দেহে প্রথম দফায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ঢামেকে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে তার দেহে সাত থেকে আট দফায় অস্ত্রোপচার করা।
×