ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াবা চালান আটকের বদলে মার্কেটিং করছে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা!

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৪ মে ২০১৮

ইয়াবা চালান আটকের বদলে মার্কেটিং করছে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা!

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে উচ্চ, মাঝারি, স্বল্পমূল্যের যত ধরনের মাদকের ব্যবহার আছে তন্মধ্যে বর্তমান সময়ে মিয়ানমারে তৈরি ইয়াবার চাহিদা শীর্ষে। ছোট আকৃতির অর্থাৎ ট্যাবলেট সাইজের মরণনেশার ইয়াবা সেবনকারী, বহনকারী ও পাচারকারীদের হাতে হাতেই ইয়াবা মিলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলা রীতিমতো ইয়াবার গোডাউনে পরিণত হয়ে আছে। শত, হাজার, লাখ, কোটি পিস নগদ লেনদেনে মিলে যায় নিমিষেই। প্রশ্ন উঠেছে, নিষিদ্ধ এ ইয়াবার এত সহজ প্রাপ্তি ঘটছে কীভাবে? এর উত্তরে সোজাসাপ্টা যা বলা হচ্ছে তা হলো- সরষের মধ্যে থাকা ভূতের আছর। প্রশাসন অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এমনকি দেশরক্ষা, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে জড়িতদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ইয়াবা পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ প্রতিষ্ঠা করেছে। দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই প্রকৃত সত্য। এসব তথ্য অপেক্ষাকৃত প্রশাসনের সৎ কর্মকর্তাদের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসছে। এতে করে গত প্রায় আড়াই যুগ ধরে মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবার চালান নদী, সাগর ও স্থলপথে বাংলাদেশে ঢুকছে। প্রথমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম। এরপরে চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পুলিশের একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা ইয়াবার চালান আটকের বদলে মার্কেটিংই করে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রশাসনের পক্ষে যেসব কর্মকর্তা ও সদস্য মাদক চোরাচালানি দুষ্ট চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে ঘোষিত যুদ্ধে সর্বাগ্রে তাদেরই চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী। প্রশাসনের মধ্যে বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর চিহ্নিত কিছু সদস্যের স¤পৃক্ততা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইশারাতেই বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রাপ্তির লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্নীতিবাজ ওইসব কর্মকর্তা ইয়াবা চালানে সহায়তায় জড়িত থেকে বিত্তের যে পাহাড় গড়ে তুলেছে তা জনগণের জানা না থাকলেও প্রশাসনের অজানা নয়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আগে ছিল ইয়াবা পাচারকারীদের ক্যাম্প। রাখাইন থেকে লাখে লাখে সাম্প্রদায়িক সময়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা পালিয়ে আসার পর তাদের আশ্রয় শিবিরগুলো পরিণত হয়েছে ইয়াবাপল্লীতে। তবে ইয়াবার পাচার করে আনার নেপথ্যে রয়েছে বিত্তশালী কিছু গডফাদারদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিয়োগ। বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যে কারণে সরকার পক্ষে মাদকের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। এই যুদ্ধে মাদকের গডফাদার, মজুত ও পাচারকারী এমনকি সেবনকারীরা টার্গেট। কিন্তু এই অপকর্মে যারা মূল সহায়ক ভূমিকা পালন করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি সুদূর পরাহত? লক্ষণীয় যে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের চিহ্নিত কিছু থানার কর্মকর্তারা ইয়াবা চোরাচালানের নেপথ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। চিহ্নিত ওইসব থানাসমূহে বস্তা বস্তা টাকা ঢালতে হয়। আবার রীতিমতো প্রতিযোগিতা দিয়েই চলছে পোস্টিংয়ের সেই সোনার হরিণ প্রাপ্তি। চট্টগ্রাম রেঞ্জ, মেট্রো এবং কক্সবাজার জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের বশে আনা ছাড়া পোস্টিং যেন সোনার হরিণ। বিশেষ করে থানাসমূহের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদ পেতে ইন্সপেক্টরদের কোটি টাকারও বেশি স্পিডমানি বা ঘুষ দিতে হয় বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজ কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা যেখানে ইয়াবা মার্কেটিংয়ে জড়িত সেখানে এদের সর্বাগ্রে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া যুদ্ধের সফলতা কতটুকু আসবে তা ভবিস্যতই বলে দেবে। অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়া, রামু চকরিয়া, চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীর পটিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, সীতাকুন্ড, কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, আকবর শাহ, বায়েজিদসহ বিভিন্ন থানার কতিপয় পুলিশ সদস্য ইয়াবা চালান পাচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন। চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা ও সীতাকুন্ড থানা ইয়াবা পাচারের করিডর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সিএমপির কর্ণফুলী থানার অধীনে যে চেকপোস্ট রয়েছে সেখানে যে পরিমাণ ছোট বড় চালান ধরা পড়েছে তার কয়েকগুণ বেশি পাচারে সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জোরাল অভিযোগ খোদ পুলিশেরই মুখে মুখে। কর্ণফুলী থানার ওই চেকপোস্টের আওতায় ৮০ ভাগেরও বেশি মামলা ইয়াবা সংক্রান্ত। যেখানে শুধু কেরিয়াররাই আসামি। আবার কখনও কখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় চালান পাওয়া গেছে বলে জানান দেয়া হয়। এর সবই নেপথ্যের নানামুখী কৌশলের জের। আনোয়ারা, সীতাকুন্ডে সাগর পথে কখনও স্পিডবোটে আবার কখনও ইঞ্জিন চালিত বোটে বস্তাভর্তি ইয়াবার চালান খালাস হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অপরদিকে, পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বেড়ানোর নামে গিয়েও অনেকে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউসগুলোর বেশিরভাগ স্থানে ইয়াবা পাচারকারীদের আনাগোনা রয়েছে। সর্বশেষ বুধবার কক্সবাজারের কলাতলীতে সিনেমা নির্মাণের লক্ষ্যে যাওয়া একটি টিমের বেশ কয়েক সদস্যের কাছ থেকে প্রায় দেড়লাখ পিস ইয়াবার চালান আটক হয়েছে। চিত্র নায়িকা, রাজনীতিবিদদের স্ত্রী থেকে শুরু করে রোহিঙ্গাসহ মহিলাদের একটি অংশও ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ কামাচ্ছে।
×