ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে ॥ সরকারকে সাবধান থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৫ মে ২০১৮

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে ॥ সরকারকে সাবধান থাকতে হবে

গত মঙ্গলবার রাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি খবর শুনছিলাম সে দেশের টিভিতে। সারা ভারতে হুলস্থূল ব্যাপার। পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রায় আশি টাকা লিটার পেট্রোল। বলা হচ্ছে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এই মূল্য সর্বোচ্চ। সমস্যার গভীরতা বিচার করে শাসক দলের প্রধান আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার। ব্যবসায়ীরা বলছেনÑ এতে মূল্যস্ফীতি ঘটবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। বস্তুত পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি হবে কী-না এটা আর গবেষণা করতে হয় না, অর্থনীতিবিদদের কাছেও যেতে হয় না। বোঝাই যাচ্ছে ভারতের বর্তমান তেলের মূল্যবৃদ্ধি অহেতুক ঘটেনি। অবশ্য তারা তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে, দেশীয় বাজারের মূল্য কমিয়ে ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দেয়। আবার বাড়লে এর মূল্য বাড়ায়। এবার মনে হয় তেলের দাম বেড়েছে অনেকদিনের জন্য। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়ছে অনেকদিন থেকেই। সর্বশেষ কাগজে দেখলাম ব্যারেলপ্রতি এর দাম হয়েছে ৮০ ডলার। গত তিন-চার বছরে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে তেলের দাম প্রায় দুই-তিন গুণ হয়েছে। এবার দাম বাড়ার গতিটি একটু দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে আনবিক চুক্তি বাতিল করেছে। হুমকি দিচ্ছে কঠিন ‘অবরোধের’। এদিকে আরেক তেল উৎপাদক দেশ ভেনিজুয়েলা উৎপাদন হ্রাস করছে। ‘ওপেক’ও উৎপাদন হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে কাগজে দেখলাম। তেলের চাহিদাও একটু একটু বাড়ছে। বিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণীতে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালে বিশ্বজিডিপির প্রবৃদ্ধি একটু বেশি হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে যারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তাদের ভুল প্রমাণিত করে দুই দেশ আপোস মীমাংসার দিকে হাঁটছে বলেই দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন তাদের দেশে বেশি মাল রফতানি করে, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন বেশি মাল আমদানি করে না। ফলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির শিকার যুক্তরাষ্ট্র। তারা এই সমস্যার নিরসন চায়। বাণিজ্য ঘাটতি চীন কমাক তা চায় যুক্তরাষ্ট্র। দৃশ্যত মনে হচ্ছে চীন ঝামেলায় যেতে চায় না। তারা বাণিজ্যযুদ্ধে যেতে চায় না। কারণ চীন যত সহজে সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করেছিল তা হচ্ছে না। তার নিকট প্রতিবেশী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মালয়েশিয়ার সরকার বদল চীন সহায়ক ঘটনা নয়। নাজিব রাজাক যিনি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে চীনের সখ্য ছিল। বহু বড় বড় চুক্তি করে, জমির চুক্তি ও ব্যবসায়ী চুক্তি করে তিনি বদনামের ভাগিদার হন। অভিযোগ ওঠে নাজিব রাজাক মালয়েশিয়া বিক্রি করে দিচ্ছেন তাই ড. মাহাথির মোহাম্মদের অঙ্গীকার তিনি চীনের সঙ্গে করা সব চুক্তি পরীক্ষা করে দেখবেন। অতি মূল্যায়িত প্রকল্প বাতিল করবেন। এ আলোকে বলা যায় চীন এখন অনেকটা ‘আপোসকামী’। এর আরেকটি উদাহরণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চীন সফর। এই সফর শেষে চীন ভারতের ওষুধ আমদানির ওপর থেকে কর তুলে নিয়েছে। এসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার চীন তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাণিজ্যে কোন ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না। এর ফল অবশ্যই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য শুভ হবে। বিশ্ব জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন বাড়বে। যদি তাই হয় তাহলে তেলের চাহিদা বাড়বে। বিপরীতে তেলের সরবরাহ কমলে তেলের মূল্য অবশ্যম্ভাবীভাবে বাড়বে। এর থেকে মুক্তি নেই। ভারতের ‘নিউজ চ্যানেল’গুলোর আলোচনাতে দেখলাম ভারতীয় তেল কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া তাদের কোন গতি নেই। মজার বিষয় একই যুক্তি দেখানো হয় আমাদেরও, এবার দেখতে হবে আরও বেশি। মুশকিল হচ্ছে বাজেটের। নতুন বাজেটের আর বেশি বাকি নেই। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই নতুন অর্থবছর ২০১৮-১৯-এর বাজেট ঘোষিত হবে। কী হতে পারে আমাদের ক্ষেত্রে? ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নানা হিসাব অর্থমন্ত্রী দিয়ে যাচ্ছেন। রাজস্ব হবে এত কোটি, উন্নয়ন বাজেটের আকার হবে এত কোটি টাকা। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হবে। এ ধরনের নানা অঙ্গীকার তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ তিনি কমাবেন। কিন্তু কথা তো একখানা। তেলের মূল্য যেভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে আপনার বাজেটের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এমনিতেই পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদিতে যে ভর্তুকি দিতে হয় তাই সরকার সামলাতে পারে না। বিগত ৮-৯ বছর সরকার ছিল অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। তেলের মূল্য বাড়েনি। বিশাল স্বস্তি সরকারের জন্য। এই স্বস্তির ফল আমরা পেয়েছি। অথচ ১৯৭২-৭৫ সালে আমরা তা পাইনি। এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু এবার যে স্বস্তি আমরা পেয়েছিলাম তার সুফল কী আমরা ঘরে তুলতে পেরেছি। মাঝখানে এমন দিনও গেছে যখন বিদেশে তেলের মূল্য কম, দেশে মূল্য এক পয়সাও কমানো হয়নি। সরকার কী কোন ‘ফান্ড’ এর বিপরীতে তৈরি করেছে? এমন খবর কাগজে দেখি না। সরকারী ব্যাংক থেকে ভর্তুকির টাকা মেটানোর জন্য যে ঋণ নেয়া হয়েছিল তা কি তখন শোধ করা হয়েছে? জানি না ঠিক আছে আমরা স্বস্তির দিনে ‘ইমার্জেন্সি ফান্ড’ তৈরি করে রেখেছি, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে ওই টাকা থেকে আমরা জরুরী অবস্থা মোকাবেলা করব সেটা কী করা সম্ভব হবে? জানি না। তবে এটুকু অনুমান করা যায় সামনে তেলের মূল্যবৃদ্ধি থেকে আমাদের একটা বড় সমস্যা আসতে পারে। সরকার কী এ বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছে? সামনে নির্বাচন। ইতোমধ্যেই জিনিসপত্রের মূল্য এক দফা বেড়েছে রোজা উপলক্ষে। কোন ব্যবসায়ী সাধারণ রোজাদারকে এতটুকু স্বস্তি দেয়নি। প্রতিটি জিনিসের মূল্য তারা খোলাবাজারে বাড়িয়েছে। এমন কোন পণ্য নেই তার দাম বাড়েনি। চিংড়ি মাছের দাম বহুদিন নিচুস্তরে ছিল। রোজার বাজারে দেখলাম এর দাম বেড়েছে বেশ হারে। এবার এত ইলিশ হয়েছে যা সত্যি সত্যি প্রশংসার। কিন্তু বাজার? বাজার তো বলে না। ছোট ছোট ইলিশের দামও ৭০০-৮০০ টাকা প্রতিটি বাজেট দেয়া হবে। রাজস্ব বিভাগ নানা ‘কারিগরি’ করবে সন্দেহ নেই। কারণ তাদের টার্গেট মোতাবেক রাজস্ব আদায় করতে হবে। এই ফাঁকে দেখা যাবে ব্যবসায়ী বন্ধুরা আরেকটা সুযোগ নেবেন। বস্তুত তারা কোন অজুহাতই হাতছাড়া করেন না। এর মধ্যে যদি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনিত বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপে তাহলে দুর্ভোগের কোন শেষ থাকবে না। ইতোমধ্যে বাজার মিশ্র অবস্থানে আছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা আগের মতো নেই। এর অর্থ ব্যবসা তাদের আগের মতো নেই। এরফলে সরকারের রাজস্বও কম হবে। এদিকে বোরো ধান ফলেছে প্রচুর। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে অনেক জায়গায় অনেক কৃষক ঘরে ধান তুলতে পারেনি বলে কাগজে রিপোর্ট দেখেছি। ঢাকা শহরে এই রোজার মধ্যে বরাবরের মতো বিভিন্ন জেলা থেকে রিক্সাওয়ালারা এসেছে। প্রচুর রিক্সা এখন ঢাকায়। তারা রোজার মাসে ঢাকায় থাকবে। দুটো পয়সা রোজগার করবে। ঈদের সময় দেশে যাবে। পারলে কিছু সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি যাবে। কিন্তু দিনরাত বৃষ্টি থাকার ফলে তাদের রোজগার কম বলে মনে হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে মানুষ পারতপক্ষে ঘরের বাইরে যেতে চায় না। এ ছাড়া ঢাকা শহরে এখন অনেক উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। বহু রাস্তা কাটাছেঁড়া। ট্রাফিকের কোন গতি নেই। তাই রিক্সাওয়ালা, অটোওয়ালাদের রোজগার কম। এর অর্থ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অথচ শ্রমজীবী মানুষের রোজগার কমছে। শোনা যাচ্ছে সরকারী কর্মচারীদের বেতন না কি আবার বাড়বে। তাহলে তো আরেক সমস্যা দেখা দেবে। দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া, জবাবদিহিতা ছাড়াই বেতন বৃদ্ধি বরাবরের মতোই মূল্যস্ফীতিকে আটকে দেবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি তো রয়েছেই। ডলারে চাহিদা অনেক বেশি। অথচ রফতানি ও রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি আশাপ্রদ নয়। তার ওপর যদি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি ডলার লাগে তাহলে তো সমূহ বিপদ। শুনেছি ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ করেছে দেশী কোম্পানিগুলো। অবশ্যই বিদেশ থেকে। তাদের পরিশোধের সময় আসছে। দুই-একজন কি বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থও হয়েছে? এমতাবস্থায় ডলারের বাজার আরও গরম হতে পারে। আমার প্রশ্ন, সরকার কী এসব মাথায় রেখে এগোচ্ছে, নাকি সবকিছু ‘ঠিক’ আছে ধরে এগোচ্ছে? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×