ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৫২ গডফাদারের ৩০ জনই এমপি বদির নিকটাত্মীয়

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১০ জুন ২০১৮

৫২ গডফাদারের ৩০ জনই এমপি বদির নিকটাত্মীয়

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ ইয়াবা সরবরাহের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেও কার্যত টেকনাফের গডফাদার কেউ ধরা পড়েনি এখনও। পালিয়েছে তারা। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় অসৎ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য থাকায় একাধিক গডফাদারের নামে থানায় কোন মামলাও নেই। শুধু রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা নামটি। ইতোপূর্বে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বড় বড় ইয়াবার চালান আটক করলেও অধিকাংশ সময় আসল মালিকরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবার চোরাচালানের তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের মধ্যে টেকনাফেই ৫২ গডফাদারসহ ৯১২ জন রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জনই হলেন সাংসদ বদির ৫ ভাইসহ নিকটাত্মীয়। সূত্র জানায়, ১৫ জনের একটি চক্র নাফ নদীর চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়াসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সাংসদ বদির ছোট ভাই মৌলবি মুজিবুর রহমান ওই সিন্ডিকেটের প্রধান। সাবরাং সমুদ্র উপকূলের মু-ারডেইল, নয়াপাড়া, কাটাবনিয়াপাড়ার এলাকা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত লাখ লাখ পিস ইয়াবার চালান খালাস করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওসব চালানের নেতৃত্বে রয়েছে তার ভাগিনা সাহেদুর রহমান ও মুফিজুর রহমান। আবদু শুক্কুর, সফিক, ফায়সাল ও আবদুল আমিন টেকনাফ-চট্টগ্রাম ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা বাণিজ্য। তবে এমপি বদির একাধিক ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, ওরা সবাই এমপি বদির সৎ ভাই। সূত্র মতে, বাংলাদেশকে ইয়াবা বাণিজ্যের প্রধান টার্গেট করে মিয়ানমারে স্থাপিত হয়েছে ৩৭টি কারখানা ওসব কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা বাংলাদেশে পাঠাতে ফ্যাক্টরি মালিকরা ডিলার নিয়োগ করেছে। মিয়ানমারভিত্তিক ১০ ডিলার ওই সব কারখানায় তৈরি করা ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে টেকনাফে। দেশটির লাইসেন্স প্রাপ্ত ওই ১০ ডিলারদের প্রধান হচ্ছে দেশের শীর্ষ গডফাদার সাইফুল করিমের (হাজী সাইফুল) মামা মংডুতে বসবাসকারী মোঃ ইব্রাহিম। মিয়ানমার থেকে নদী ও সাগর পথে পাঠানো ইয়াবার চালান টেকনাফের ৫২ গডফাদার (ডিলার) দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ দিয়েছে। সূত্র জানায়, টেকনাফের জাফর চেয়ারম্যান বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন দলে যোগদান করার মানেই হচ্ছে ইয়াবা কারবার করে সরকারের দুর্নাম রটানো। টেকনাফে ইয়াবা কারবার শুরু করার পেছনে জাফর চেয়ারম্যানের হাত রয়েছে বেশি। টেকনাফে ইয়াবার চালান জব্দ হলে আসামি করা না করার বিষয় নিয়ে বেশি মাতব্বরি করতেন ওই নব্য আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আহমদ চেয়ারম্যান। তার ও ইয়াবা কারবারি তিন পুত্রের দাপটে টেকনাফে কেউ মুখ খোলার সাহসও পায়নি বলে জানা গেছে। গত ২৪ মে রাতে নেত্রকোনায় পুলিশ-মাদক ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের হ্নীলার পশ্চিম সিকদারপাড়ার মোঃ ইসমাঈল ও মোঃ ওসমান, পরদিন সাবরাং ইউপি সদস্য ইয়াবা গডফাদার আক্তার কামাল ও ২৬ মে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সাবেক উপজেলা যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক নিহত হওয়ার পর পাল্টে যায় টেকনাফের ইয়াবা কারবারের দৃশ্য। আত্মগোপনে চলে যায় ইয়াবা কারবারিরা। তবে নিহত আক্তার কামালের সহোদর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা সম্রাট সাহেদ কামাল এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশ টহলদল সব সময় প্রস্তুত। যখন খবর পাই তখনই অভিযান। তবে ইয়াবা কারবারিরা কেউ ঘরে থাকে না। তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। পুলিশ এ পর্যন্ত শীর্ষ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এদিকে নুরুল হুদা ওরফে নুরা গাড়ির একজন হেলপার মাত্র। তার বাবা ছিলেন একজন জেলে। নুরার অপর ভাইয়েরা কেউ পরের জমিতে লবণ শ্রমিকের এবং কেউ নাফনদীতে জাল ফেলতেন। মাত্র ৫-৬ বছর আগে নুরুল হুদা নুরা’র হঠাৎ করে পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। ২০১৪ সালে তার ভাই নুর মোহাম্মদ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর ইয়াবার হাল ধরে নুরুল হুদা নুরা। জমি কেনা, গাড়ি ক্রয়, দালান নির্মাণ, একেক ভাইয়ের জন্য একেকটি বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি দেখে স্থানীয়রা অবাক বনে যায়। পরে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে নির্বাচন করে জিতে যান নুরা। পুলিশের রেজিস্টারে মোস্ট ওয়ান্টেড নুরুল হুদা। তবে আসামি থাকা অবস্থায়ই কোটি টাকা ব্যয় করে টাকার জোরে মেম্বার নির্বাচিত হন। এককালের সেই হেলপার নুরা বর্তমানে শতকোটি টাকার মালিক। হ্নীলা সড়কের পাশেই তাদের ছয় ভাইয়ের নামে ৬টি নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, অন্য চোরাচালানিরা অবৈধ পণ্য লুকিয়ে বিক্রি করলেও নুরুল হুদার ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। নরুল হুদা তার সহযোগীদের বলতেন খোলা বিলে ব্যবসা ভাল। প্রশাসনের লোকজন আসছে কি না সরাসরি দেখা যায়। মালও সরানো যায়। সহজে পালানোও সম্ভব। তাই হ্নীলার জাদিমুড়া থেকে খারাংখালী পর্যন্ত নাফ নদীর পাশে খোলা বিলে বসত নুরুল হুদার ইয়াবা বাজার। জাদিমোড়া, নয়াপাড়া, মোচনী, লেদা, রঙ্গীখালী, নাটমোড়া পাড়া, হ্নীলা সদর, ওয়াব্রাং ও খারাংখালী পয়েন্ট হয়ে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে খোলা বিল হয়ে নুরুল হুদার নামে ইয়াবার চালান আসত বলে তথ্য মিলেছে। সন্ধ্যার পর ওসব খোলা বিলে লোকজনের উপস্থিতি না থাকায় ইয়াবা চোরাচালানের সুবিধা নিতেন এককালের গাড়ির হেলপার বর্তমানে শত কোটি টাকার মালিক নুরা। সচেতন মহল বলেন, তার এত বিত্তবৈভবের বিষয়ে দুদকের তদন্ত শুরু হলে নুরুল হুদার আয়ের উৎস কোথায় সহজে বেরিয়ে আসবে ‘ইয়াবা’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে একবার গ্রেফতার হলেও তাকে বেশি দিন জেলখানার গানি টানতে হয়নি। ব্যাপক তদ্বির ও অঢেল টাকা খরচ করে ছাড়া পেয়ে আবার জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা কারবারে। নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার পাশে হওয়ায় এটি বড় সুযোগ ওই নুরার জন্য। ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের স্বজন যারা মিয়ানমারে ছিল, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিয়ে আসে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। তাও আবার রোহিঙ্গা নারী, শিশুদের মাধ্যমে চালান সরবরাহ করেছে চট্টগ্রামে। গাড়ির হেলপার থাকায় কিসের ভেতর যুগান করলে সহজে চালান পৌঁছানো যাবে, তা ভালই জানা ছিল নুরুল হুদার। পান-সুপারি, লবণের গাড়ি, শুঁটকি ও কাঁচামাছ ভর্তি ট্রাকের ভেতর লুকিয়ে টেকনাফ থেকে লাখ লাখ পিস ইয়াবার চালান গেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বহু মামলার পলাতক আসামি প্রশাসনের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড নুরুল হুদা মেম্বার ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে খুঁজছে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরে দিনযাপন করায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেন, নুরুল হুদা মেম্বার বেশির ভাগ সময় জঙ্গলে ও রোহিঙ্গা বস্তিতে পালিয়ে থাকেন। কতিপয় রোহিঙ্গা তাকে অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিয়ে রাখে বলে জানা গেছে। থানা সূত্র জানায়, নুরুল হুদার বিরুদ্ধে যে ১৯টি মামলা রয়েছে। স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়ের তালিকায় শীর্ষ ইয়াবা গড়ফাদারদের মধ্যে নুরুল হুদা অন্যতম। গাড়ির হেলপার থেকে নুরুল হুদা ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। নামে বেনামে একাধিক ব্যাংক একাউন্ট ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে একাধিক জায়গা জমি, ট্রলার, গাড়ি বাড়ির মালিক বনে গেছে।
×