ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের ছেলেবেলা আর তরুণবেলার রংটিই সব থেকে উজ্জ্বল থাকে, তাই সারা জীবন তাকে পকেটে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে। এখন হয়তো তরুণরা তাদের ঈদে আরও নতুন নতুন রং, সুর-ছন্দ মেলাচ্ছে- আমরা জানি না। আমাদের কেবল মনে হচ্ছে সেই ঈদের দিনগুলো!

সেই সব ঈদ ও গাজী শাহাবুদ্দিনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৪ জুন ২০১৮

সেই সব ঈদ ও গাজী শাহাবুদ্দিনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী -স্বদেশ রায়

মানুষ বড় বেশি সঞ্চয়ী। সব কিছু ধরে রাখতে চায়। সে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে না, পৃথিবীর পথে পথে পাথর ছড়ানো, আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- তাই তো এমন ঝরনা ঝরানো। ঝরনার জল সেই কোন পাহাড়ের উৎস থেকে বের হয়ে ছুটে চলতে চলতে কোথায় অতলান্তিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে মিশে গেছে, কেউ জানে না। সে জলও আর ফিরতে চায় না। না, এই ঝরনার জলের সঙ্গে মানুষকে এক করা যায় না। আবার শুধু সঞ্চয়ী বলেও কি মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি বলা হয়? না- মানুষ নিজেই অতলান্তিক মহাসাগর, যেখানে প্রতিদিন এসে মিশছে হাজারো ঝরনার জল। বিচিত্ররূপী এ জল যেন মানুষকে বিচিত্ররূপিণী করেছে। তাই কেউ পার্থিব সম্পদ সঞ্চয়ে আনন্দিত হয়, আর কেউবা জীবনের সময়কে ঝরনার জলের মতো সাগরের দিকে ভাসিয়ে দিয়ে কল্লোলিত হয়। সেই মহাকল্লোলে মিশে যেতে পারাও কোন কোন ক্ষুদ্র জীবনের জন্য সাগরের কূলে বসে সাগরের ঢেউয়ের নাচের সঙ্গে শরীর মিলিয়ে নিজেকে পত্র পল্লব করে তোলার মতো। সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই ছিলেন এ পৃথিবীতে যারা জীবনকে ঝরনার জলের মতো বইয়ে দিতে চায়, দিতে পারে তাদের একজন। তার চারপাশে একটা ছন্দ ছিল। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী নীরবে পালিত হলে তাই অবাক হয়নি। নিরন্তর সঞ্চয়ে উন্মাদ পৃথিবীতে- সঞ্চয়ী নয়, সন্ন্যাসী নয়, গৃহী নয়, অন্য আরেক কিছু, আরেক অন্য কেউ, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন, তাকে নিয়ে স্মরণ, এই সব সাধারণ যা ঘটে সেই নিয়মের গন্ডিতে ফেলিও বা কী করে? যিনি নিজেই ছিলেন সাধারণের কাছে অপরিচিত, কেবল ছন্নছাড়াদের আপনজন- তাঁকে নিয়ে তাই কষ্টও বা কেন? পরে নিজেই ভেবেছি, না, কোন কষ্ট নেই। কারণ, এই পৃথিবীর পথে পথে হেঁটেছি তো অনেক, সে পথে গাজী ভাইয়ের মতো জীবন্ত মানুষ তো মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন। আর ওই ক’জনই তো, সঞ্চয়ী নন, সন্ন্যাসী নন, গৃহী নন, অন্য আরেক কিছু। এম আর আখতার মুকুল ভাইয়ের ছেলেদের ভেতর কষ্ট দেখেছি, চরমপত্রের লেখক ও পাঠক হয়েও ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই নেই তাদের। ভাড়া বাড়ি থেকে মৃতদেহ বেরিয়ে গেল এম আর আখতার মুকুলের। অথচ সূর্যের আলোর চেয়ে ঝলমলে এম আর আখতার মুকুল ভাইকে কখনও বাড়ি নিয়ে ভাবতে দেখিনি। তখন কখনও কখনও মনে হতো, সব ঘরে যার ঠাঁই হয়ে যায় তাঁর মনে হয় নিজের মাথা গোঁজার বাড়ি তৈরির প্রতি কোন আকর্ষণ থাকে না। জীবনপাত্র যেখানে আপন সুধায় ভরে যায় সেটা মনে হয় আর ইট কাঠ পাথর দিয়ে ভরানোর প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ সব সময়ই কোন না কোন উৎসব করে কিছুটা সময় হলেও নিজের জীবনকে রঙিন করতে চায়। তাই তো মানুষের জীবনে কত উৎসব! নানা দিনকে নানা নামে ডেকে মানুষ উৎসব তৈরি করেছে। আবার আছে ধর্মীয় উৎসব। উৎসবে রক্তের বাঁধনে যারা বাঁধা তারা সকলে এক হতে চায়, এক জায়গায় মিলতে চায়। এ মিলনেরও একটা রং আছে, ছন্দ আছে। সে ছন্দ ওই বাঁধনহারা ঝরনার ছন্দ নয়, সে ছন্দ গভীর রাতের কোন জাজ মিউজিকের ছন্দ নয়, সে ছন্দ আবার চিরাচরিত ঘড়ায় ভরা জল নয়, এ ছন্দ হঠাৎ বিকেলের বাতাসে বাড়ির পাশে পদ্মদীঘিতে ঢেউ ওঠার মতো একটুখানি ঢেউ। তাই বা নিত্য দিনের একঘেয়েমি জীবনে কম কি? নিত্যদিনের একঘেয়েমি জীবনে একটু ছন্দÑ এ অনেক বড়। এই যে আমরা সংবাদপত্রের মানুষ। বছরে নয়টা দিন ছুটি পাই। অর্থাৎ নয়টা দিনই আমাদের জীবনের ডোবা পুকুরে কোনমতে নরম কাদার ওপর যে সামান্য জলটুকু আছে, তাতে একটু খানি ঢেউ তোলে। আর ঢেউ বেশি তোলে দুটি ঈদে। তখন আমাদের ছুটি মেলে তিন দিন করে। এখন চলাচল সহজ হয়েছে, এই তিন দিনে ছোট এক বিদেশ ট্রিপও দিয়ে আসা যায়। একটু হলেও চেঞ্জ আসে জীবনে। অথচ বিদেশ নয়, দেশে বসেই এই তিন দিনকে স্বপ্নময় করেছি আমরা গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইকে ঘিরে। ঈদের দিনের দুপুর থেকে দুপুর রাত, কখনও বা রাত গড়িয়ে সকালের দিকে চলে গেছে, গাজী ভাইয়ের বাড়ির ছাদ হয়ে উঠেছে আমাদের আলাদা এক জগত। সে ঈদের দিনগুলো আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে এখন কোনদিন হয়তো সাবমেরিনে ঘুরে ঈদ পালন করতে পারব। কারণ পৃথিবীর নানা দেশের টুরিস্ট স্পটে এখন অন্যতম এক আকর্ষণ সাবমেরিন। তবে গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইকে ঘিরে যে ঈদ ছিল আমাদের, সে ঈদ উৎসব আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আমরা তো তখন তরুণ তুর্কী। ত্রিদিব দস্তিদার দারুণ তেজী। সুশান্তদার যা বয়স তার থেকে ভারিক্কি অনেক বেশি। আবার কবি সৈয়দ হায়দার ভাই যেন কিছুটা সময় পার হতেই আমাদের সমবয়সী হয়ে যেতেন। হায়দার ভাইয়ের কথা মনে হতেই কেমন যেন মনের তারটি ছিঁড়ে গেল। গাজী ভাই চলে গেছেন, সুনীল দা (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) চলে গেছেন, কাইয়ুম স্যার চলে গেছেন, বেলাল ভাই চলে গেছেন। সবাই যে খুব অকালে চলে গেছেন তা নয়, তবে সৈয়দ হায়দার ভাই সত্যিই অকালে চলে গেছেন। ক্যান্সার সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ ভাইকেও নিয়ে গেছে, তবে বড় অকালে নিয়ে গেল সৈয়দ হায়দার ভাইকে। আর ত্রিদিব, সে জীবনটাকে হাওয়াই বাজির মতো দ্রুত পোড়ানোর জন্যই যেন জন্মেছিল। ত্রিদিব আর জয় (জয় গোস্বামী) দু’জনে তখন সমান তালে লিখছে। অন্যদিকে গাজী ভাইদের বাড়ি ভেঙ্গে তখন উঠছে বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট। গাজী ভাই উঠেছেন ৯ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর ভাড়া বাসায়। সেখানেও আমাদের নিত্য দিনের উৎসব ছিলো। ওই ফ্ল্যাটটিও ঈদের দিনে হয়ে উঠত একটা আস্ত গাজী বাড়ি। ঈদের দিনের রক্তের সম্পর্কের শত আত্মীয়স্বজনের ধকল সহ্য করেও বীথি ভাবিকে সহ্য করতে হতো আমাদের ধকল। যেমন, আমাদের আনন্দউৎসব আর খাওয়া দাওয়ার মাঝে হঠাৎ জয় গোস্বামীর চোখ পড়েছে সামনের সিদ্বেশ্বরী কালীমন্দিরের দিকে। এর পরে ত্রিদিব ও জয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা এখন কালীমন্দিরে যাবে। দু’জনে গেলেই পারে। জোর করা শুরু করল আমাকে নিয়ে। গাজী ভাই বার বার বলেন, তোমরা যাও ও থাকুক। ত্রিদিব কি আর কথা শোনে? বাধ্য হয়ে যেতে হলো। ত্রিদিব তো ঢুকেই তিন লাফে তিন দিকে যায়। জয় ভক্তিশীল। প্রণাম করে মাটি নিয়ে কপালে দেয়। আমি দর্শক মাত্র। দাঁড়িয়ে জয়কে দেখছি আর ভাবছি, গাজী ভাই কী অদ্ভুত এক সমুদ্র- এখানে ঈদ, পূঁজো সব এসে একাকার হয়ে গেছে। গাজী ভাইয়ের বাড়ির ছাদের ঈদ উৎসবের কথায় শিহাব সরকার ভাই ছিলেন অনেকখানি চুপচাপ মধ্যমণি। তবে ত্রিদিবের থেকেও মাঝে মাঝে আসরটা মাতিয়ে তুলতেন রফিক আজাদ ভাই। শামসুর রাহমান ভাই আর সুনীলদার সব থেকে বড় দিক ছিল, তারা এত বড় কবি, বয়সেও বড়, তার পরেও সবাইকে নিজের করে নিতেন। দেখতে দেখতে ঈদের তিনটি দিন কেটে যেত। এর ভেতর হয়তো একদিন ঘোরাঘুরি হতো। আর আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে নয়, অন্য কারণে মনে পড়ছে বেনজির ভাইকে। পেশার খাতিরে এই মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে এ নিয়ে চারটি লেখা লিখেছি। তিনটি ইংরেজীতে, একটি বাংলায়। ইংরেজী একটা লেখায়, বাংলাদেশের এই আজকের মাদকের ভয়াবহতা কেন, কবে থেকে ধীরে ধীরে বেড়েছে- আর এ নিয়ে আমার কিছু ক্ষুদ্র কাজ ও পড়াশোনার কথা উল্লেখ করেছি। ওই লেখাটি লিখতে গিয়ে বার বার মনে পড়েছিল বেনজির ভাইয়ের কথা। কত রকম মাদক ও নেশার বিষয় যে তিনি জানতেন! মাদক নিয়ে আমার পড়াশোনার ভেতর একটা সঞ্চয়ীর লক্ষণ ছিল। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো বিষয়টি কাজে লাগাতে, আমার প্রফেশনের কাজে লাগাতে পড়েছি। আর বেনজির ভাই মাদক নিয়ে জানতেন কেবল জানার আনন্দে। অর্থাৎ এও জীবনের আরেক ছন্দ। আমাদের তখন মনে হতো, ঢাকা শহরের সমস্ত সুর ও ছন্দ, এমনকি কলকাতারও অনেক সুর ছন্দ এসে যেন জড়ো হতো গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইকে ঘিরে। মনে হতো, আকাশ থেকে এক ফালি রং নেমে এসেছে আমাদের মাঝে। জানি না, এর থেকে ভাল কোন ঈদ উৎসব আর জীবনে পাব কিনা! বা এমনও হতে পারে মানুষের ছেলেবেলা আর তরুণবেলার রংটিই সব থেকে উজ্জ্বল থাকে, তাই সারা জীবন তাকে পকেটে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে। এখন হয়তো তরুণরা তাদের ঈদে আরও নতুন নতুন রং, সুর-ছন্দ মেলাচ্ছে- আমরা জানি না। আমাদের কেবল মনে হচ্ছে, সেই ঈদের দিনগুলো! এখানেই এক বড় প্রশ্নবোধক শব্দ এসে থমকে দাঁড়ায়, আসলে কী আছে তারুণ্যে! সব তারুণ্যেই সঞ্চয়ের বাসনা কম থাকে, তাই সেখানে রং লাগে। বাসনাতে রং লাগে না, কেবল সেখানে স্বার্থের ছোটাছুটি আর প্রাচুর্যের ভরপুর। এ কারণেই হারিয়ে যাওয়া সেই ঈদগুলোকে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। তবে আবার খুঁজতে ইচ্ছেও করে না। কারণ, যেন নিজ হাতে সাগরের জলে পাত্র উপুড় করে মদিরা ঢেলে দেয়ার মতো সমস্ত কাপড় খুলে শ্মশানে উঠিয়ে দিয়েছি মধ্যপঞ্চাশ না পেরুনো ত্রিদিবকে, নীরবে মাটির নিচে আছেন সৈয়দ হায়দার ভাই। সকলের কেন্দ্রবিন্দু গাজী ভাই আজ আকাশের তারা। এ ঈদেও অনেকের সঙ্গে কথা হবে, আবার ডাকলেও ডাক শুনবে না অনেকেই। এটাই কি জীবন? [email protected]
×