ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ সুমনা -আলম শামস

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৪ জুন ২০১৮

গল্প ॥ সুমনা -আলম শামস

কিছুক্ষণ আগেও ঝক ঝকে রোদ ছিল। হঠাৎ করেই অন্ধকার শুরু হয়ে আসতে লাগলো চারদিকে। শুরু হলো আকাশ জুড়ে কালো মেঘের দোড়ঝাঁপ, চোখ ধাঁধানো বিজলীর ঝটকা আর পিলে চমকানো গর্জন। আমরা তখন নদীর মাঝখানে। চাঁদপুর হতে শরীয়তপুরের নড়িয়া যাচ্ছিলাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকা তীব্র বেগে ছুটছিল। যেন বৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারা গেল না। তুমুল ঝড়বৃষ্টি আমাদের পেয়ে বসলো। আমার পাশের মেয়েটিও ভিজে একাকার। বেরসিক বৃষ্টি। নৌকায় এতো লোকের মাঝে বৃষ্টিভেজা শরীর প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠায় লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে তার মায়াবী মুখ। পাশে বসা বৃদ্ধ বাবার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। যেন নিজেকে আড়াল করতে চাচ্ছে। বাবা এক হাতে মেয়ের কাঁধ চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁট নড়ছে। নীরবে দোয়া পড়ছেন তিনি। সবাই আল্লাহ খোদার নাম স্মরণ করেন। নৌকা কুলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো মাঝি। সবার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল। অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। ঝড়ের ঝাপটায় নৌকা দুলে উঠতেই আতঙ্কে উঠেছিল কেউ কেউ। ঘণ্টাখানেক পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা ছোট থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে মিলিয়ে গেল। আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে এলো। সদ্য স্নাতা তরুণীর মতো ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চারদিক। মাঝি ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিলো। বাতাস আর রোদে গায়ের ভেজা কাপড় অনেকটাই শুকিয়ে যাওয়ায় অস্বস্তি কেটে যেতে লাগলো। সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির পালাবদল দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। আলো আঁধারীর সন্ধিক্ষণে প্রকৃতি হয়ে উঠলো রহস্যময়। চাঁদ এসে যখন রাতের আকাশ দখল করলো ঠিক সেই সময় আমরা পৌঁছিলাম নড়িয়ায়। যাত্রীরা লাইন ধরে ধীরলয়ে ঘাটে নামতে লাগলো। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পেছনে বৃদ্ধ বাবার হাত চেপে ধরে পাশের মেয়েটি। ঘাটে নেমে চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। সবকিছুতেই পরির্তনের ছোঁয়া ভালো লাগলো। বাপ-মেয়ে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। বাবা চোখে কম দেখেন বলে মেয়ের হাত ধরে আছেন। স্ট্যান্ডে গিয়ে তারা রিকশা পেল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমিও কোন রিকশা দেখলাম না। সম্ভবত আধাবেলা বৃষ্টিতে ভিজে রিকশাচালকরা সবাই বাড়ি চলে গেছে। এখন কি করি? এতো দূরের পথ এ অন্ধকার পাড়ি দিয়ে কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছবো? তুমি কোথায় যাবে বাবা? মেয়েটির চোখে চোখ হতেই তার বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন। তার কণ্ঠে ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘মুলফৎগঞ্জ’। চাচা আপনারা কোথায় যাবেন? আমরাও সেদিকেই যাবো। এখন কি করে যে যাই? আসুন সামনে এগিয়ে যাই। দেখি কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না। তিনজন ধীর পায়ে ভেজা মাটির নরম পথে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর যেতেই দূরে একটা রিকশা দেখতে পেলাম। অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে ডাকতে ডাকতে ছুটে গেলাম। এগিয়ে না এলে ফসকে যেত। কোথায় যাবে শোনে রিকশাচালক বেঁকে বসল। বৃষ্টি বাদলার দিনে এত দূর যাব না। বৃদ্ধ আর মেয়েটার অসহায়তার কথা বুঝিয়ে বলার পর অনেক গাইগুই করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে ফিরে এলাম। বৃদ্ধ চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা চলে যান, আমি দেখছি নিশ্চয়ই আরেকটা রিকশা পাওয়া যাবে। তিনি আপত্তি জানিয়ে বললেন তা কি করে হয় বাবা। এখন আর কোন রিকশা পাবে কিনা কে জানে। তোমাকে একা ফেলে আমরা যেতে পারবো না। চলো এক সঙ্গেই যাই। অগত্যা তিনজন এক রিকশায় চেপে বসলাম। আমি ওপরে আর আমার পায়ের মাঝে বৃদ্ধ চাচা। তার পাশে মেয়েটি। চাচাজির জায়গায় যদি মেয়েটি বসতো। ব্যাচেলর মনে দুষ্ট চিন্তাটা আসতেই নিজেকে বকুনি দিলাম। ছিঃ, পাকা, আধপাকা, আবার কোথাও কাঁচা পথে এগিয়ে চলছিল তিন চাকার গাড়ি। চালক বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছিল। জালাল মিয়া চিন্তা কইরো না, তুমি যে আমাদের উপকার করতেছে এই জন্য অনেক ছওয়াব পাবা। বিপদে মানুষ যদি মানুষের উপকার না করে তাহলে ইবলিশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য রইলো কই, কি বলো? ঠিকই কইছেন স্যার। প্যাডেলে জোরছে চাপ দিয়ে আমাদের কথা সায় দিলো রিকশাওয়ালা জালাল মিয়া। বাঁশঝাড়, খালপাড়, আঁকাবাঁকা সরু পথ পেরিয়ে আমরা যখন মেয়েটির বাড়ি পৌঁছালাম তখন এশার আযান ভেসে আসছিল। বাড়ির লোকজন আমাদের ঘিরে ধরলো। বাবা-মেয়ে দুজনের মুখেই আমার প্রশংসা। মেয়েটির বাবা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, একজন উপকারী মানুষ, একজন ফেরেশতার মতো। আজ এই ফেরেশতা আমাদের উদ্ধার করেছে। সবার মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। যাই হোক এবার আমার বিদায়ের পালা। এ কথা জানাতেই সমস্বরে না, না, করে উঠলো। মেহমানকে আপ্যায়ন না করে কিছুতেই যেতে দেব না। মেয়েটির কৃতজ্ঞ চোখমুখের নীরব আকুতি উপেক্ষা করতে পারলাম না। রাস্তার পাশে ছোট একটি বাড়ি। পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সাজানো-গোছানো ঘর। সব মিলিয়ে সুখের নীড়। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি আমার জন্য শুকনো কাপড় নিয়ে এলো। নিজেও আধভেজা কাপড় পাল্টে এসেছে। এই নিন তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় ছেড়ে এগুলো পড়ে নিন। হাত বাড়িয়ে কাপড় নিতে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ। কি নাম আপনার? সুমনা। সানজিদা হক সুমনা। কোন ক্লাসে পড়ছেন? এবার এইচএসসি দেবো। আপনার নাম কিন্তু এখনো বলেননি। ওহ, হো সরি সরি। আমি আহমেদ ইফতিয়াক। নামটা ছোট করে ডাকা যায় না? কেন যাবে না? আপনি কিভাবে ডাকতে চান, শুনি, ইফতি, মানে, আমি শুধু ইফতি ভাই বলে ডাকবো। আপত্তি নেই তো? না একদম না, মেদ ভুঁড়ি কারইবা ভালো লাগে। স্লিম ইজ সুইট। ঠিক তাই। সুমনার চোখে চোখ রেখে বললাম। গভীর মায়াবী চোখ জোছনার মায়াজাল। পলাশ কলি ঠোঁটের কোণে প্রশয়ের মৃদু হাসি এতো সুন্দর। কি দেখছেন? জলতরঙ্গের মতো সুমনার প্রশ্নটা কানে বাজতেই ঘোর কেটে গেল। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আগে কখনো দেখিনি কি? নরম পৃথিবীতে স্বর্গের অপ্সরা। প্রস্ফুটিত পলাশের মতো উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে সুমনা ঘরের বাইরে পা বাড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে থক মেরে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। এক্ষুণি ড্রেস চেঞ্জ করে নিন। না হলে সর্দিজ্বর লেগে যেতে পারে। আমি একটু পরেই আসছি। কিছুক্ষণ পর আমার জন্য শরবত ও নাস্তা নিয়ে এলো সুমনা, বসলো সামনের চেয়ারে। হালকা গোলাপী রঙের থ্রি-পিসে তাকে মনে হচ্ছিল যেন টবে সাজানো অর্পূব গোলাপ। মানুষ এত সুন্দর হয়। নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে কথায় কথায় জানলাম সুমনার বাবার কথা। তিনি এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। জীবনের সব সঞ্চয় ঢেলে এলাকার স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তিনি চান ইহকাল ও পরকালের শিক্ষায় অন্তত তার এলাকায় প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হবে। সবাই এ জনমেও সুন্দরভাবে কাটাবে, পরজনমের জন্যও কিছু করে যাবে। আমাদের দেশের নেতারা যদি আপনার বাবার মতো হতেন মানুষ কতো অসাধ্য সাধন করে। আর এটাতো খুবই সহজ। কেবল সুন্দর একটা মন থাকা চাই। ঠিকই বলেছেন। কিছু করতে হলে সুন্দর একটা মন থাকা চাই। আমি তেমন মনের একজন মানুষ খুঁজছি। সুমনা আমার চোখে চোখ রেখে অস্ফুট স্বরে বললো। মনে হলো, চোখের ওই গভীর সাগরে আমি ডুবে যাচ্ছি...। একজনই পারে আমাকে উদ্ধার করতে। আমরা সে কথা বলতে যাবো তখনই পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সচকিত হয়ে সুমনা বললো বাবা আসছেন। কেমন স্রেহমাখা দৃষ্টিতে তাকালেন সুমনার বাবা। সুন্দর। বিশেষ করে আপনাদের সবাইকে বেশ ভালো লেগেছে। আমি মৃদু হেসে বললাম। বাবা তুমি কি কর? আমি মাত্র মাস্টার্স শেষ করলাম। এখনো কোন কিছুতে জয়েন করিনি। চেষ্টা করছি। ভালো। কিন্তু সমস্যা কি জানো, চারদিকে এত সব মানুষ এতো প্রতিযোগিতা যে নামকা ওয়াস্তে চেষ্টা করে কিছু করা কঠিন। এজন্য অনেকেই অধৈর্য হয়ে শর্টকাট রাস্তায় টাকা কামানোর ধান্ধায় নামে। পরিস্থিতি বাধ্য করলে তো কিছু করার থাকে না, চাচা। এ পরিস্থিতি তো আমাদেরই অন্ধ দলবাজি, অনৈক্য, অদূরদর্শিতা, অসমঝোতা ও খামখেয়ালির ফসল। এ ধারা না বদলালে দেশ গোল্লায় যাবে। অবৈধ সবকিছুই অশান্তির কারণ। এটা যদি আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা ভাবতেন তাহলে এতো অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হতো না। মাছের মাথায় এই পচন তোমাদেরকেই ঠেকাতে হবে বাবা। তোমাদের মনোবল আর দেশাত্মবোধই এর প্রকৃত এন্টিবায়োটিক। তোমরা ধৈর্য হারিও না। মনে রেখ আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের অনেক পছন্দ করেন। কিন্তু চাচাজি, কিছু করতে না পারলে আমার প্রিয়জনরাই আমাকে পছন্দ করবে না। নিজাম ডাকাতের আউলিয়া হওয়ার কাহিনীটা স্মরণ করো। আর শোনো বাবা, আল্লাহ্ বলেছেন, একজন মানুষকে যে সাহায্য করলো সে যেন গোটা মানবজতিকে সাহায্য করলো। আর যে একজন মানুষকে হত্যা করলো সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করলো; সুতরাং আমরা যদি হিংসা বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করি তাহলে কিন্তু অবৈধ, অন্যায় কিছু ঘটতে পারে না। অথচ আমরা কিন্তু ইবলিশের ইশারায় একে অন্যের বিরুদ্ধে লেগেই আছি। সুমনার বাবার কথা শুনে নিজের ওপর কনফিডেন্স আরো বেড়ে গেল। যে দিকেই গিয়েছি দেখেছি শুধু পঙ্গপালের ভিড়। হাল ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। সত্যিই তো আল্লাহ্ যদি ইবলিশকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারেন, মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত, আমরা কেন তা প্রমাণ করতে পারবো না? আমাদের ঘাটতি কিসে? সদিচ্ছা থাকলেই সবই সম্ভব। আমাদের আলাপের এক পর্যায়ে রাতের খাবার নিয়ে এলো সুমনা। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম কিন্তু ঘুম এলো না। অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। ভীষণ জ্বর এসে ভর করলো শরীরে। কাকে ডাকবো? কি লজ্জা? সামান্য বৃষ্টিতে ভিজেই কুপোকাত। সুমনা দেখলে কি ভাববে? এমন নড়বড়ে স্বাস্থ্য হলে জীবন যুদ্ধে লড়বো কিভাবে? সকালে সুমনা আমাকে ডাকতে এসে তো আকাশ থেকে পড়লো। ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমার সেবায়। মাথায় পানি পট্টি দিতে লাগলো। বিব্রত বোধ করলেও বেশ ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার এলেন। চেকআপের পর তার দেয়া ওষুধ খেলাম। জ্বর কমছিল না দেখে আমাদের বাড়িতে খবর দেয়া হলো। ছোট ভাইকে নিয়ে মা ছুটে এলেন। তিন দিন যমে মানুষে লড়াই চললো মনে হচ্ছিলো, আমি যেন মরে যাচ্ছি। কে যেন আমাকে মৃত্যুর অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুমনা আমার হাত জাপটে টেনে ধরে আছে। কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না মৃত্যুপুরীতে মা ও সুমনা। বিশেষ করে সুমনার অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে উঠলাম। সুস্থ হওয়ার পর মাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। সুমনাকে ছেড়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। আমার মন যার কাছে পড়ে রইলো তাকে ছেড়ে কি করে আসি, বিদায় নিতে গিয়ে শুধু বলে এলাম আবার হবে দেখা, সুমনা। সে কিছুই বললো না, তবে তার চোখ ছলছল করে যেন বলে উঠলো, আমি অপেক্ষায় থাকবো।
×