ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাদক নির্মূল নিয়ে কিছু ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৯ জুন ২০১৮

মাদক নির্মূল নিয়ে কিছু ভাবনা

মাদকবিরোধী যেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে এটা দিয়ে মাদক নির্মূল করা অসম্ভব। কেবল সাময়িক দমন করা সম্ভব। এতে করে যা হবে তা হল আপাতত কিছুদিন মাদকের ব্যবহার কমবে আর দাম বাড়বে। এছাড়া তেমন কিছু হবে না। কারণ মাদকের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। কলম্বিয়া, মেক্সিকোতে বিশ-ত্রিশ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলেছে। আমেরিকা এই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সত্তরের দশকে। যদিও বারাক ওবামা এসে বলেছিলেন যে এটাকে ‘যুদ্ধ’ বলব না আমরা, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে আবার বলছেন সেই ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ তাই এটা নতুন কিছু নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর যেখানেই এই অভিযান চাল না করা হয়েছে সেখানে মাদকের বিস্তার সাময়িকভাবে কিছুটা দমন করা গিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন বড় কোন ফল আসেনি। কলম্বিয়াতে মাদক দমনে ২৬ বছর ধরে অভিযান চলছে। সেখানে এই অভিযানে এ পর্যন্ত ৯.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওখানে কোকেনের চাষ তো কমেইনি আরও বেড়েছে। দেশের বিরাট ভূন্ডখন্ড প্রায় ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি এখনও কোকেন সম্রাটরা দখল করে রেখেছে। আফগানিস্তানে আমেরিকার ড্রোন উপেক্ষা করে কোকেনের চাষ বেড়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে ছিল মাত্র ২০০ টন, বর্তমানে বার্ষিক উৎপাদন প্রায় দশ হাজার টন। সুতরাং শুধু সাপ্লাই সাইড নিয়ে কাজ করলে মাদক নির্মূল করা যাবে না। আমাদের এর ডিমান্ড সাইড নিয়ে কাজ করতে হবে। ডিমান্ডটা কোথায় এটা খুঁজে দেখতে হবে। আসলে মানুষ নেশা করবেই। মানুষ হাজার বছর ধরেই নেশা করে আসছে। আমাদের দাদা-দাদি নানা নানিরা তামাক, হুক্কা এসব খেতে, পানে জর্দা খেতেন। এসবও নেশা। গাজা, চরস, ভাঙ এসব নেশার ইতিহাসও হাজার বছরের। নেশা যারা করে তারা কেন করে? নেশা করার অন্যতম কারণ কাজ না থাকা। আমরা নেশা করি না কেন? কারণ আমাদের অনেক কাজ থাকে। প্রতিদিন আমরা নানা রকম কাজে ব্যস্ত থাকি। মাদক নির্মূল করতে হলে তাই বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দিকে জোর দিতে হবে। শিক্ষা ও সামাজিক সুষ্ঠু সংস্কার যদি না করা যায় তাহলে মাদক নির্মূল করা অসম্ভব। কারণ আমাদের বিনোদনের ব্যবস্থা অবশিষ্ট নেই, মাঠ নেই, লাইব্রেরি নেই। মানুষ করবে কি? ছাত্রদের ভাল নেশা ধরিয়ে দিতে হবে। বই পড়ার নেশা, খেলাধুলার নেশা। এসব ভাল নেশা যদি কোনটা ঢুকিয়ে না দেয়া হয় তাহলে তারা মাদকের নেশা তো করবেই। পুলিশি ব্যবস্থা যেটা আছে এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে মাদক নিধনে পৃথিবীব্যাপী লাখ লাখ লোক মারা গেছে এ রকম ইতিহাসও আছে। মাদকবিরোধী অভিযানে ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালে সাড়ে চার লাখ লোক মারা গেছে কেবল কলম্বিয়ায়। ২০০৩ সালে থাইল্যান্ডে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম তিন মাসেই ২৮০০ লোক মারা গেছে। মেক্সিকোতে ২০১২ সালে মারা গেছে ১২ হাজার। পরের বছর সেই সংখ্যা দাঁড়াল এক লাখ বিশ হাজার। তারপর শুরু হলো নিখোঁজ হওয়া। তবে মাদক কিন্তু থেমে নেই। তাই ভয়াবহ এই অবস্থা দমন করার জন্য এ রকম অভিযান দেশে দেশে পরিচালিত হয়েছে আমাদের দেশেও হচ্ছে। এই অভিযান পরিচালনার সময় মনে রাখতে হবে এর দ্বারা শতভাগ মাদক নির্মূল যেহেতু সম্ভব হবে না দুই চারজন মাদক ব্যবসায়ী অভিযানে ধরা না পড়লেও ক্ষতি নেই তবে একজন নিরপরাধ লোকও যেন এ অভিযান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, নিরপরাধ কারও যেন প্রাণ না যায় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি এই অভিযানের পেছনেও কারণ আছে। ছোটখাটো কেউ একবার মাদক ব্যবসা করে জেলে গেলেও সে জামিনে বেরিয়ে আসে। এবং তখন দেখা যায় তার বস হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিয়ে তার পদোন্নতি দিয়েছে। তাই ভয়াবহ এই অবস্থা দমন করার জন্য এ রকম অভিযান সাধারণত পরিচালনা করা হয়। তাই সাময়িক এই অভিযান শেষে আমাদের মাদকের ডিমান্ড সাইডের উপর নজর দিতে হবে। প্রতিদিন দুই আড়াই হাজার জেলে নৌকা নাফ নদীর ওদিকে মাছ ধরতে যায়। ওদিক থেকে লঞ্চ স্টিমার এদিকে আসে। কোথায় কি দিয়ে দিচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার সক্ষমতা আমাদের নেই। তাই আমি জোর দিয়ে বলছি শুধু পুলিশি অভিযান পরিচালনা করে কেবল কিছুটা সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও মাদক পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। পৃথিবীর কোথাও এটা নির্মূল হয়নি। এটাকে নির্মূল করতে হলে অবশ্যই মাদকের ডিমান্ড সাইড নিয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের চাহিদাকে বলা হয় ‘বাজে চাহিদা’। যে চাহিদা কোন বিজ্ঞাপন প্রচারণা ছাড়াই বাড়ে। কোনদিন কোন মাদক দ্রব্যের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। আমাদের দেশে এত বিজ্ঞাপন দিয়েও সফট ড্রিংকসের বাজার বিশ্ব বিবেচনায় অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। ইয়াবাকে বলা হয় ‘ক্রেজি ড্রাগস’। ফেনসিডিল যারা খায় এমন একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ফেনসিডিল কেন খায়? উত্তরে বলেছিল ‘উপকার হয় তাই খাই।’ কি উপকার হয় জিজ্ঞেস করলে জবাব ছিল ‘ঝিম মাইরা থাকার জন্য খাই।’ অতএব যারা ফেনসিডিল খায় তারা ‘ঝিম মাইরা থাকার জন্য খায়।’ অতএব ঝিম মাইরা থাকা হচ্ছে ‘নীড’। সেই বিবেচনায় ফেনসিডিল একটা পণ্য কারণ এটা যে খায় তার ভাষায় এটার উপকার করার ক্ষমতা আছে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় ফেনসিডিল একটা পণ্য, আর বাজারে ওই পণ্যই আসবে যার চাহিদা আছে। যদিও বাজে চাহিদা। ব্যবসায়ীদের এ নিয়ে ব্যবসা না করার পরামর্শ দিয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ী ওই পণ্যই উৎপাদন ও বিতরণ করবে বাজারে যার চাহিদা আছে। এক্ষেত্রে বাজে চাহিদা যেমন- অধিকসংখ্যক সন্তানের আকাক্সক্ষা কমানোর ক্ষেত্রে সামাজিক বাজারজাতকরণ বা সোশ্যাল মার্কেটিং যেমনটি ব্যবহার করা হচ্ছে, ইয়াবার চাহিদার মতো (যারা খায় তারা বলে ছটপট থাকার জন্য খাই) বাজে জিনিসের চাহিদা কমানোর জন্য সামাজিক বাজারজাতকরণ মতবাদ ব্যবহার করতে হবে। চাহিদার মূলে যেতে হবে। নেশার শ্বাশত ‘নীড’ কে উন্নত পরিবেশ দিয়ে পরিশালিত করতে হবে। যেমন খেলাধুলা, শরীরচর্চা, বই পড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। যুব সমাজকে ‘ইনভলভড’ রাখা গেলে বাজে চাহিদা তাকে গ্রাস করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের চেয়ে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে মাদক আসক্তি কম, ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের নেশা নেই বললেই চলে। এর জবাবে কার্ল মার্কস হয়ত বলতেন ‘ধর্ম নিজেই একটি নেশা।’ মার্কসীয় সাহিত্যে ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মার্কসের উক্তি গ্রহণ না করেও বলা যায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মাচারের নেশা যার মধ্যে ভালভাবে ঢুকেছে তার পক্ষে অন্য নেশা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধর্মভীরু লোক পরকালে শাস্তির ভয়ে অথবা পরকালে সমজাতীয় পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহের লোভে ইহকালে মাদক থেকে বিরত থাকে। অতএব বলা যায় নেশা নেশাকে ঠেকাচ্ছে। অতএব বাজারে আরও অনেক ভাল বিকল্প নেশা ছেড়ে দিলে, ভাল নেশা বাজে নেশাকে ঠেকাবে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×