ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উৎসব, শান্তি ও মানুষের জীবন

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৯ জুন ২০১৮

 সিডনির মেলব্যাগ ॥ উৎসব, শান্তি ও মানুষের জীবন

শান্তিপূণভাবে শেষ হয়েছে ঈদ উৎসব। জনগণকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। সঙ্গে সরকারকেও। প্রশাসন কঠোর না হলে শান্তি থাকত না। শেখ হাসিনার সরকারের এটাই দৃঢ়তা। অন্যদিকে বেগম জিয়ার ঈদ কেটেছে কারাগারে। মীর্জা ফখরুল এই ইস্যুতে চেষ্টা করেও সহানুভূতি জাগাতে পারেননি। খালেদা জিয়া জেলে ঈদ উদযাপন করুক এমন চাওয়া আমাদের না থাকলেও নানা কারণে তা হয়েছে। সে কারণগুলো এবং প্রতিকার না ভেবে দোষারোপের রাজনীতি কোন কাজে আসবে না। এই সত্য বুঝতে পারছে না বিএনপি। তাদের ছলচাতুরি কাজে না আসলেও মায়াকান্না চলছে সমানে। মানুষ কর্ণপাত করেনি। তার চেয়েও ভয়াবহ ইস্যু ছিল ঈদের ঠিক আগে আগে সুমন জাহিদের মৃত্যু। সুমনের মৃত্যু আত্মহত্যা বললেও সেটি আসলে আত্মহনন না খুন এ প্রশ্নের জবাব জরুরী। কারণ, সুমন ছিলেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র সন্তান। শহীদ জননীর সন্তান সুমন মায়ের নামে ঢাকায় একটি সড়ক করার জন্য একা লড়ে সেটি করতে পেরেছিলেন। যা এক ধরনের রাজনীতি পছন্দ করে না। সুমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের জবান দিয়েছিলেন। সেটিও কারণ হতে পারে। এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। ফলে এই কলঙ্কমোচন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানুষের জন্য দেশ। মানুষের জন্য সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের মানুষদের এভাবে শেষ করে ফেললে ইতিহাস আমাদের মাফ করবে না। জীবনের চাইতে মূল্যবান আর কিছু নেই। ধর্ম প্রকৃতি বিজ্ঞান যাই বলি না কেন সবার ওপরে মানুষের জীবনকে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। বলা হয় বহু পুণ্য ও ভালবাসার ফল এই মানব জীবন। সে জীবন কে ঘিরে সমাজ রচিত হয় আর সমাজকে বাঁচাতে রাষ্ট্র। রাজনীতি বিজ্ঞান পড়েছি কিছু সময়। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি এসব বিজ্ঞান বা শাস্ত্রের মূল কথা একটাই কিভাবে মানব সমাজকে নিরাপদ রাখা যায়। রাজনীতি বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক লাস্কি বলতেন, সব পাওয়ার গেমই ভয়াবহ। আর একতরফা কিংবা পাওয়ার ফুল পাওয়ার গেম হচ্ছে সর্বনাশা। এও বলতেন, All power corrupts absolute power corrupts absolutely. বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় এর আসল চেহারা দেখছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবন এখন কত সস্তা। একটা সময় আমরা সামরিক শাসনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছি লম্বা সময়। মূলত তখনকার বাংলাদেশ ছিল সামরিক জান্তার দেশ। এক যায় তো আর এক আসে। এই আসা যাওয়ার কাল তাড়াতে আমাদের অগ্রজরা নিজের জীবনবাজি রাখতেন। আর আমরা? সময়ই পাইনি নিজের যৌবন ও জীবন উপভোগের। সবসময় ভয় আর তাড়িয়ে বেড়ানোর কাল গিয়েছিল রক্তপাতের ফলাফলে। কিন্তু কত রক্ত পেলে মাটি তৃপ্ত হয়? আর কত প্রাণ গেলে দেশ ও সমাজ শান্ত হবে? যেসব প্রজন্ম বড় হচ্ছে বা যাদের এখন যৌবন কিংবা কিশোরবেলা কি দেখছে তারা? যা দেখছে যা জানছে যা শুনছে তাতে সমাজকে ভালবাসার আদৌ কোন কারণ আছে? আমাদের পাশের বাংলাটিকেও দেখছি আমরা। সাতচল্লিশে ভাগাভাগির পর তাদের জীবনে সমস্যা কম আসেনি। একাত্তরে বায়াত্তরে এমনকি সত্তর দশকের প্রায় পুরোটাই সেখানে নকশাল আন্দোলনের যে আগুন আজ তা ছাই। কি গেছে কি পেয়েছে সে তর্কে যাব না। ভুল সবারই ছিল। কিন্তু যেটা দেখেছি যখন শেষ তো সব শেষ। সে আগুন ধিকিধিকি জ্বললেও তাতে এখন আর জান যায় না কারও। আমাদের দেশ যখন স্বাধীন হয় আমরা তখন বালক। ধরে নিয়েছিলাম পাঞ্জাবিরা গেছে পাক হানাদার যখন গেছে আর কে মারবে আমাদের? আমরা আমরাই কি পারব নিজেদের বুকে গুলি চালাতে? ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন শুনি ঢাকার বুকে গুলি চলেছে। ছাত্র ইউনিয়নের দুজন কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। একজনের নাম ছিল পরাগ আর একজনের নাম মনে নেই। তখন চমকে উঠেছিলাম, এও হতে পারে? খুব বেশিদিন যায়নি। একদিন দুপুর বেলা বাড়িতে ভাত খাবার সময় হকারের দেয়া ঢাকার কাগজ পড়ে মাথা ঘুরিয়ে যাবার মতো হয়েছিল অবস্থা। পত্রিকাজুড়ে সাত খুনের ছবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছিল এই নৃশংস হত্যাকা-। আর কখনও থামেনি এই রক্তপাত। কিছুদিন পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘটানো হলো ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য হত্যাকা-। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারবর্গ গেলেন। আরও কিছুদিন পর জেলখানার মতো নিরাপদ জায়গায় হত্যা করা হলো তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীর মতো নেতাদের। রক্ত আর রক্তে ভাসতে থাকল দেশ। এরপর জিয়াউর রহমান, মন্জুর, তাহের আরও কত নাম। মূলত এসব হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় সমাজ আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এগুলো নিয়ে এত আলাপ হয়েছে আর বলার সুযোগ নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে বীজই গাছের জন্মসূত্র। হিংসা আর বিভেদের রাজনীতি আজ বিষবৃক্ষ। এর বিষফলে সমাজ আজ ধুঁকছে। মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র বানিয়েছে নিরাপদ বসবাসের জন্য। আমরা পেয়েছি বহু ত্যাগের বিনিময়ে। সে শুধু ভাষণে আর কাগজে থাকলেই হবে? এই যে গত ক’দিন ধরে মাদক নির্মূলের যুদ্ধে বিগত প্রাণ আর তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এ কি প্রমাণ করে আমরা কোন সভ্য সমাজের নাগরিক? বা দেশের মানুষ কোন সভ্য সমাজে বসবাস করছে? অনেকে বলেন ষোল কোটি মানুষের দেশে এমন হতেই পারে। এমন যদি হতেই পারে একদিন এভাবে আপনার মৃত্যু ও জায়েজ বলে ধরে নিন। আর যদি তা না মানেন তাহলে এখনই সময় আপনার অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ে মুখ খোলার। এ কথা একবারও বলি না যে, মাদকবিরোধী যুদ্ধ হবে না। হবে এবং কঠিনভাবেই হবে। মাদক একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ দুনিয়ার বহু দেশে আছে। এর সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ভালমন্দ জড়িয়ে। দেশে এখন এমন এক পরিবেশ মাদক এমন এক ভয়াবহ পরিবেশের জন্ম দিয়েছে যেখানে মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্ক আছে ঝুঁকিতে। কোন স্বাভাবিক মানুষের হাতে মা-বাবা খুন হতে পারে না। আত্মীয়-স্বজন রক্ত ও নাড়ির সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয়া মাদক নির্মূল করতেই হবে। কিন্তু কোথা থেকে আসছে, কারা আনছে কারা এর পেছনে এসব কি আমাদের অজানা? সরকার বা প্রশাসন সব জানে। আর জানে বলেই আমরা তাদের কাছ থেকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি এ্যাকশন কামনা করি। বলে রাখা উচিত শেখ হাসিনার অবদান আর সাহসে দেশ আজ উন্নতির রথে। তিনি যখন যেটা ধরেন বা করেন সেটার শেষ দেখে ছাড়েন। মাদকের চাইতে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধীচক্রের বিচার করেছেন তিনি। ফলে তাঁর প্রটি আস্থা রাখবই। এটাও জানি সবকিছু তিনি জানেন না। তাঁকে জানানো হয় না। এই না জানানোর ফাঁকেই চলে আসছে নানা অনিয়ম আর অনাচার। যখন তিনি জানেন তখন হয়তা অনেক দেরি হয়ে গেছে নয়ত যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এবার ও যদি তা হয় বা হতে থাকে ফলাফলে সরকারই হবে দায়ী, দলের ও সরকারের জনপ্রিয়তা নামবে আরও নিচে। উন্নয়ন বা অগ্রগতির সবকিছু মানুষ মনে রাখবে না। কারণ সবার আগে নিরাপত্তা আর জীবন। সময় এসেছে বিষয় ও এ্যাকশন নিয়ে ভাবার। মানুষ সবুর করছে কিভাবে মাদক নির্মূল হয় তা দেখার জন্য। এবং যেভাবেই হোক এটা হলে সুফল যাবে সরকারের ঘরে। জীবন বাঁচাতে আর নিজেদের পরিবার বাঁচাতে মানুষ সাহায্যও করবে। করছেও। কিন্তু রাজনীতি এখানে বাধা। আর দশটা বিষয়ের মতো দল দলবাজি দল উপদলের বিভক্তি দুশমনি মিলে পরিবেশ ভয়াবহ। সুমন জাহিদের অপমৃত্যু মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন রেখে গেছে তার মীমাংসা দরকার। মাদক নির্মূলের পাশাপাশি মৃত্যুর বিষয়টিও মানুষকে বুঝিবে দিতে হবে। সমানে নির্বাচন। সরকার যদি এখন এসব বিষয়ে স্বচ্ছ না হয় তো মানুষের মনে সন্দেহ থেকে যাবে। শেখ হাসিনা লড়ছেন। তিনি যখন সিডনি এসেছিলেন এখানে আওয়ামী লীগের এতগুলো শাখা উপশাখা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। বিরক্তও হয়েছিলেন। দেশেও তাই। এত লীগ আর এত দল উপদল আগে কেউ দেখেনি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মানুষগুলো আওয়ামী তথা প্রগতিশীলতার মানুষগুলো খুন হলে কেউ কিছু করে না। এই বাস্তবতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আশা করি মানুষের জীবনের মতো অমূল্য সম্পদকে মূল্য দেবে সবাই। সুমন জাহিদ বা এমন যে কোন অপমৃত্যু রুখে দিতে চাই সকলের মনোযোগ আর রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছি। তিনিই পারবেন সমাধান বাতলে দিতে। [email protected]
×