ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

আশাপ্রদ বাজেট ও গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২০ জুন ২০১৮

 আশাপ্রদ বাজেট ও গ্রামীণ  কৃষি অর্থনীতির রূপান্তর

৭ জুন ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এ যাবতকালের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট পেশ করেন বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী, যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রার বাংলাদেশ।’ এই প্রস্তাবিত বাজেটের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম হলো মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) পরিধি কমিয়ে এনে এর হার সমান রাখা, কর্পোরেট কর কমিয়ে আনা, সামাজিক সুরক্ষার খাত বৃদ্ধি, বেসরকারী চাকরিজীবীদের পেনশন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় দিবস ভাতা, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে অধিক বরাদ্দ, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ, বিনিয়োগ- কর্মসংস্থানে কম গুরুত্ব পাওয়া, সামাজিক সুরক্ষা খাতের পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ সরকারের এটি ১৯তম ও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ১২তম বাজেট। বাজেট অনেক বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্রের একটি আর্থিক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব বলে পরিগণিত। সেই হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ও ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির সূচকগুলো ঘোষণা করেছেন যথাক্রমেÑ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৮ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১৯৫৬ মার্কিন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগের হার ৩৩.৫৪ শতাংশ, ভ্যাটের স্তর ৯ থেকে কমিয়ে ৫-এ নামিয়ে আনা ইত্যাদি। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা আর অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা এবং জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ৮৪৯ কোটি টাকা। এবারকার বাজেটের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ, যা ৫৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী এডিপির আওতায় রয়েছে ৩৭ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, যা মূল এডিপির ২১.৮ শতাংশ। আবার অনুন্নয়ন-উন্নয়ন মিলে কেবল কৃষি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ৫.৮ শতাংশ এবং গত বছরের বাজেটের চেয়ে শতাংশ হারে ১.৩ কম, যা নিয়ে অনেক কৃষি অর্থনীতিবিদ আপত্তি করেছেন বিশেষত পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করে আছ কৃষি খাত, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তাই এই খাতের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন জড়িত, যা বাজেট বক্তৃতায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। কারণ দেশে আবাদযোগ্য জমি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ার পরও সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল ও কর্মসূচী গ্রহণের ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বেড়েছে, কৃষি ভর্তুকি, সার, বীজ, সেচ সুবিধা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, শস্য বহুমুখীকরণ ও বিপণন অব্যাহত রাখার ঘোষণা এসেছে । এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে দেশে পরিবেশবান্ধব জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার, গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং হস্তান্তর কাজ চলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খরা ও লবণাক্ত সহিষ্ণু ধান-গমের জাত উদ্ভাবনসহ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, অর্থকরী ফসল পাটের বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, বহুমুখী পাটপণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে, মৎস্য খাতে দেশ অনেক এগিয়েছে ইত্যাদি। এবারকার প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি সহায়ক যে পদক্ষেপগুলোর ঘোষণা এসেছে তার মধ্যে রয়েছে প্রথমতÑ আমদানি কর চালের দাম বাড়াতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার অর্থাৎ সব ধরনের চাল আমদানিতে শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক শতকরা ৩ ভাগ প্রযোজ্য হবে; দ্বিতীয়ত- কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে। তৃতীয়ত- স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গম ভুটা আলু ও কাসাভা থেকে উৎপাদিত স্টাচের শুল্কহার যৌক্তিকীকরণ করে আমদানি শুল্ক শতকরা ১৫ ভাগ এবং রেুগুলেটরি ডিউটি শতকরা ১০ ভাগে হারে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে; চতুর্থত-পোল্ট্রি মৎস্য ও ডেইরি ইত্যাদি কৃষির অন্যতম উপখাত দেশের মানুষের আমিষের প্রধান উৎসগুলো টেকসই উন্নয়নের ও বিকাশের লক্ষ্যে ওই খাতগুলোতে খাদ্যসামগ্রী নানাবিধ উপরকণ আমদানিতে কর ও শুল্ক ক্রমাগত হারে করা ও শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে আসছে। এসব খাতে প্রদত্ত প্রণোদনা অব্যাহতি রাখার পাশাপাশি পোল্ট্রি ফিডের প্রয়োজনীয় উপকরণ সয়াবিন ওয়েল কেক ফ্লাওয়ারের শুল্ক হ্রাসের শতকরা শূন্য ভাগ এবং রেগুলেটরি ডিউটি শতকরা ৫ ভাগ প্রস্তাব করা হয়েছে, পঞ্চমত- তামাক জাতীয় সব পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির ওপর উচ্চ হার শুল্ক আরোপিত হয়েছে; ষষ্ঠত- তামাক প্রক্রিয়াজাত পূর্ব রফতানি উৎসাহিত করতে তামাকজাত দ্রব্য পণ্যের ওপর আরোপিত শতকরা ২৫ ভাগ রফতানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে; সপ্তমত- স্থানীয় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভিন্ন শিল্প যেমন মধু, চুইংগাম ও সুপার কনফেকশনারি চকোলেট, বাদাম ইত্যাদি রক্ষার স্বার্থে এসব খাদ্য উপকরণ আমদানিতে হ্রাসকৃত শুল্কহার অব্যাহত রেখে খুরচা সামগ্রী সরাসরি বিক্রির জন্য আমদানি শুল্কহার শতকরা ২৫ ভাগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে; অষ্টমত- সামুদ্রিক মৎস্য আহরণপূর্বক রফতানির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা হয় তাই এ কাজে ব্যবহার্য বিশেষায়িত ফিশিং নেট আমদানিতে শুল্ক প্রণোদনা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন আসা যাক সরাসরি পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন খাতে। বর্তমান সরকারের শেষ বাজেটে গ্রামীণ উন্নয়নের দিকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তেমনি জনকল্যাণের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগকে, যা এডিপির ১৪.৬ শতাংশ বা টাকার অঙ্কে ২৫ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। এই বিভাগের আওতায় রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর যার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণ মেরামত ইত্যাদি তৈরি। অপরদিকে পল্লী এলাকায় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল গুণগত পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে যেমন ক্ষুদ্র ঋণের স্থলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে উৎসাহিত করতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি বাড়ি একটি খামার কার্যক্রম বাস্তবাযন করা হচ্ছে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পল্লী এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও আয়ের সংস্থান হচ্ছে। সরকার আশা করছে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ লাখ পরিবারের ৩ কোটি মানুষ স্থায়ীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হবে। দেশের গ্রামাঞ্চলে পৌর এলাকাগুলোতে রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ, গ্রোথ সেন্টার, সাইক্লোন শেল্টার, বিল উন্নয়ন, নিরাপদ পানির উৎস, ড্রেন নির্মাণ, পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে কর্মচাঞ্চল্য ধরে রাখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গ্রামাঞ্চলে সড়ক কভারেট ৩৫.২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৬.৯ শতাংশে উন্নীত করা হবে। পল্লী উন্নয়ন একটি ব্যাপক বিষয় যেখানে জীবনমান উন্নয়নের সবকিছু উপাদান থাকবে; কিন্তু বর্তমানে যে উন্নয়নটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় গ্রাম বলতে কিছুই থাকবে না, বিশেষত সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত, গ্যাসপ্রাপ্তি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পুঁজি, বিশেষত সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কর্তৃক মূলধন যোগান, ক্ষুদ্র ঋণের উপস্থিতি, গরিব মানুষের রেমিটেন্স অর্থ এতে দারিদ্র্যের হার দৃশ্যত কমেছে বিগত বছরের তুলনায় এবং দারিদ্র্য নিরসন একটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে, গ্রামীণ সমাজের সনাতন কৃষ্টিগুলো বিলুপ্ত হয়েছে, সমবায় প্রতিষ্ঠান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে রূপান্তরির হয়ে গেছে, যা এক অন্যরকম সমাজব্যবস্থা, যার সঙ্গে বাঙালী সংস্কৃতির কোন সম্পর্ক নেই। ষাটের দশকের পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (পার্ড) পূর্ব পাকিস্তানের অংশে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠান লাভ করেছিল উপমহাদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আইসিএস কর্মকর্তা ড. আকতার হামিদ খানের নেতৃত্বে, যিনি ছিলেন জন্মসূত্রে ভারতের আগ্রা জেলার মিরাটের অধিবাসী। তারই প্রায়োগিক গবেষণার ফসল দু’স্তরবিশিষ্ট সমবায়, পল্লী পূর্ত কর্মসূচী, থানা সেচ কর্মসূচী ও থানা প্রশিক্ষণ উন্নয়ন কর্মসূচী তখনকার সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কুমিল্লা মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যা বিশ্ব স্বীকৃত। পরবর্তীতে এই চারটি প্রায়োগিক গবেষণার ফসল হিসেবে চারটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম নেয়, যা পল্লী উন্নয়নের পিলার হিসেবে কাজ করেছিল। সময়ের বিবর্তনে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় কিংবা থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রের বাস্তবে কোন প্রকার অস্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর, যদিও সরকারী দফতর হিসেবে বাজেটের আওতায় টিকে আছে। আবার পল্লী উন্নয়নের সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) গ্রাম গবেষণার ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিংবা সত্তরের দশকে বিদেশী গবেষক, অধ্যাপক, প-িতদের আগমনে সরগরম থাকত যে প্রতিষ্ঠানটি তার আজ কি অবস্থা? নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা মন্ত্রণালয়ের পল্লী উনøয়ন ও সমবায় বিভাগ কি করছে? কেন সংস্থা প্রধানগণ নিয়মিত অফিসে উপস্থিত থাকেন না? কেন অনুষদ সদস্যদের গ্রাম গবেষণায় অনীহা? কেনইবা বার্ডের প্রাক্তন পরিচালক কিংবা অনুষদ সদস্যদের বার্ডের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কিংবা বার্ষিক পরিকল্পনা সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় না? অথচ তারাই ছিলেন এক সময়ে এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রধান অলঙ্কার- কি আলোচনায়, কি সঙ্গীতে, কি কবিতায়, কি নাটকে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরী। তা না হলে পল্লী উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পল্লী উন্নয়ন খাতটি গুরুত্বের বিবেচনায় পিছিয়ে পড়েছে। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য আমাকে জানালেন পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় কিংবা তার আওতাধীন সংস্থা যেমন বার্ড, আরডিএ, বিআরডিবি কিংবা সমবায় দফতর থেকে তেমন কোন সৃজনশীল নীতিনির্ধারণী গবেষণাপত্র পাওয়া যায় না, যা পরিকল্পনায় স্থান পেতে পারে। সরকার কর্তৃক প্রণীত দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) সমবায় সংগঠনের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি অথচ এক সময় সমবায়ই ছিল বৈষম্যহীন সমাজে পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার। তাই বাজার অর্থনীতির যুগে নতুন করে ভাবনার সুযোগ এসেছে কিভাবে পল্লী উন্নয়নকে বাজেটের আলোকে সাজানো যায়। কারণ সবাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়, বিষেশত পণ্যের ব্যবহার, কর্মসংস্থান, চাকরি ইত্যাদি বিবেচনায়। পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের দুটি দিক রয়েছেÑ একটি তাত্ত্বিক এবং অপরটি ব্যবহারিক। তাত্ত্বিক দিক থেকে গবেষণার নতুন নতুন মডেল তৈরি এবং ব্যবহারিক দিক থেকে এই সকল মডেলের ব্যবহারিক প্রয়োগ, যার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং প্রান্তিক পর্যায়ের দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নিরসন সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে বার্ড ও আরডিএ-এর গবেষকগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু সেটা কিভাবে? প্রথমে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে কোন বিশ্ববিদ্যালয় এফিলিয়েশন নিয়ে পিএইচডি/এমফিল/এমএস কর্মসূচী চালু করতে পারে, যেমনটি করছে ভারতের National Institution for Rural Development (NIRD) & National Institution of Bank Management (NIBM)। এতে করে গবেষণার উৎকর্ষতা বাড়বে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষার গবেষণা গাইড করার মতো পিএইচডিধারী গবেষক রয়েছেন, সুবিশাল নিরিবিলি হোস্টেল রয়েছে, রয়েছে অতি প্রাচীন অথচ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। এখন শুধু সময়ের উদ্যোগ প্রয়োজন বাজেট; দ্বিতীয়ত- কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন একটি ব্যবহারিক প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মেধাবীরা তাদের মেধার বিনিয়োগে নিবেদিত হবে এবং সেসব প্রতিষ্ঠান যেমন বার্ড, আরডিএ, বিআরডিবি, নার্স ভোক্তা প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদিতে জনবল নিয়োগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশির ভাগ লোক নিয়োগ হয়ে থাকে, যারা কম মেধাবী, সম্পূর্ণ গ্রাম গবেষণায় বিমুখ; তৃতীয়ত- সরকার নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করার জন্য বার্ড সৃষ্টি হয়েছিল ষাটের দশকে এবং বর্তমানে তা বিলীন হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ নেতৃত্বের অভাব এবং প্রধান নির্বাহীর কর্মস্থলে ক্রমাগতভাবে অনুপস্থিত থাকা। এর ফলে অধস্তন অনুষদ সদস্যরা এই কঠিন কাজ করতে আগ্রহ অনাগ্রহে জড়িয়ে ফলে কাজ কিছুই হয় না। আরও উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত ৬ বছর কোন বোর্ড মিটিংই হয়নি এবং খবর নিয়ে জানা গেছে বোর্ডের চেয়ারম্যান পল্লীমন্ত্রী সময় দেন না। এর একটি তদন্ত হওয়া উচিত। সর্বোপরি বাজেট হোক প্রয়োগধর্মী, বিশেষত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে এবং আরডিসিডি, কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে এই প্রত্যাশা রইল। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও জ্যাস্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা। [email protected]
×