ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফখরুল-তারেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত এবং বিএনপির রাজনীতি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২১ জুন ২০১৮

ফখরুল-তারেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত এবং বিএনপির রাজনীতি -স্বদেশ রায়

তারেক রহমানের সঙ্গে এ ধরনের নীতিনির্ধারণী বৈঠকটি করার জন্যে রিজভী অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তবে সিনিয়রদের হস্তক্ষেপে হোক, আর তারেকের বিদেশী মুরব্বিদের কারণে হোক, ফখরুল ইসলাম আলমগীরই শেষ অবধি লন্ডন যান। বেশ নাটকীয়ভাবে, অনেকটা কমিউনিস্ট কায়দায় ফখরুল ব্যাঙ্কক হয়ে লন্ডন যান। লন্ডনের নানান সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তারেক রহমানের তিন দফা বৈঠক হয়েছে। বাস্তবে এ বৈঠকের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারে। যা হোক, এই তিন দফা বৈঠকের ভেতর দিয়ে ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তারেক রহমান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তারেক রহমান ও ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দুটি। এক, তারা দুজনেই মনে করেন, যেহেতু নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার হারিয়ে ফেলছেন, অন্যদিকে তারেক রহমান ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন- তাই এখন বিএনপির উচিত হবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়া। অর্থাৎ বিএনপি যে অবস্থায় থাকুক না কেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তারেক রহমান মনে করেন বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। দুই, নির্বাচনে যাবার আগে বিএনপি বা তাদের জোটের পক্ষ থেকে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তারা। তারেক রহমান ও ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বৈঠকের এই সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত, সেটা বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী নির্বাচনের আগে এখনও থাকছে ঘটনাবহুল আরও পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসে অনেক ঘটনা ঘটবে। যার ভেতর একটি ঘটনা বিএনপি ইতোমধ্যে বুঝতে পেরে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা ধরে নিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট নির্ধারিত ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বেগম জিয়ার হাইকোর্টের মামলা শেষ হয়ে যাবে। সেখানে নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকবে। সে হিসেবে আগস্টের ভেতর সুপ্রীমকোর্ট ও রিভিউ সবই শেষ হয়ে যাবে। তাই সেপ্টেম্বরে সারাদেশের বিএনপির কর্মীরা জেনে যাবে বেগম জিয়া কোনমতেই আর বিএনপির নেতা থাকতে পারছেন না। কারণ, তিনি ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যে কোন সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচারিক আদালতের রায় শেষ হবে। এ রায়ের ফলও বিএনপির ওপর আরেকটি ধাক্কা দেবে। এমতাবস্থায় জামায়াত ও বিএনপি প্রায় সমান কাতারে চলে আসবে। যে কারণে বিএনপি যতই গণআন্দোলনের বিষয় চিন্তা করুক না কেন, তাদের পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তারা তাদের সর্বশেষ চেষ্টা, যা কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে তৈরি করেছিল সেটাও ইতোমধ্যে ভেস্তে গেছে। কারণ, ওই আন্দোলনের নেতারা যে সব স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্র দলের নেতা ও কর্মী, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে আর মাঠে নামিয়ে কোন ফায়দা তোলা যাবে না। অবশ্য জামায়াত ও জঙ্গীরা ইতোমধ্যে এ সত্য বুঝতে পেরে, তারা আবার সেই টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছে। তবে এখানে যদি ধরে নেয়া হয়, এরা বিএনপির সেপ্টেম্বরের আন্দোলনের ওয়ার্মআপ হিসেবে এই টার্গেট কিলিং করছে, তাহলে ভুল হবে। বরং এটা তারা যে টার্গেট কিলিং ২০১২ থেকে নতুন পর্যায়ে শুরু করেছিল, তারই ধারাবাহিকতা। মাঝখানে পুলিশ প্রশাসন এটা জিরোতে নামিয়ে এনেছিল। আবার কোন কারণে কিলাররা কিছুটা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। এই অনুকূল পাওয়ার দুটো কারণ, এক. আমরা সকলে মনে করছি এটা টার্গেট কিলিং। দুই. বর্তমান আইজি সাহেব মনে করছেন, যারা হত্যা করছে তারা সেলফ মোটিভেটেড। এই দুটি ভুল ধারণার কারণে তারা এ সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এগুলো দৃশ্যত টার্গেট কিলিংয়ের চরিত্র কিছুটা ধারণ করলেও মূলত এগুলো জেনোসাইডের অংশ। কারণ, তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে একদিনে নয়, ধীরে ধীরে সময় সুযোগ মতো হত্যা করছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ এই হত্যাকা-ের মাধ্যমে একদিকে যারা বাঙালী চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটান, তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে তারা; পাশাপাশি ভয় সৃষ্টির মাধ্যমে এই চিন্তা-চেতনা চর্চা বন্ধ করতে চাচ্ছে। যখন কোন একটি বিশেষ আদর্শ বা চিন্তাকে হত্যার মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চলে, তখন ওই সকল হত্যাকা- জেনোসাইডের অংশ। অথচ এ সত্যটি উপলব্ধি না করে এটা টার্গেট কিলিং ধরে সাধারণ আইনে এদের বিচার করা হচ্ছে। যার ফলে জেনোসাইডের মতো অপরাধ করেও তারা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। তাই যতক্ষণ এই প্রত্যেকটি হত্যাকান্ড বা হত্যাচেষ্টার অপরাধীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্যে নেয়া না হবে, ততদিনে এই হত্যাকান্ড থামবে না। আর তার ওপরে পুলিশ প্রধান যদি জঙ্গীদেরকে নিয়ে এই সেলফ মোটিভেটেড তত্ত্ব থেকে বের হয়ে না আসেন, তা হলে সেটা জঙ্গীদের জন্য একটা সুবিধা হিসেবে কাজ করবে। এ কারণে বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে চিন্তা করতে হবে- দেশের স্বার্থে ও স্বাধীনতার চেতনার অস্তিত্বের স্বার্থে। তবে এটা ঠিক যে, এই হত্যাকান্ড মানুষকে ভীত করলেও বিএনপিকে গণআন্দোলনে সহায়তা করবে না। তাই এখন স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে, ফখরুল-তারেক বৈঠকের ভেতর দিয়ে আগামী নির্বাচনের আগেই বিএনপি ও তার জোটের যে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হলো- এ সিদ্ধান্ত বিএনপি বাস্তবায়ন করবে কী ভাবে? বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্কের অনেকেই নির্বাচনের আগে কোন আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষপাতী নন। তারা মনে করেন, বিএনপির ওই ধরনের কোন শক্তি নেই যে তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে। বরং আন্দোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে জনগণ আরও হতাশ হবে। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, সরকার এ মুহূর্তে চাচ্ছে, বিএনপি একটি আন্দোলন করুক। তাদের মতামত হলো, খালেদা ও তারেকবিহীন বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করে ব্যর্থ হবার ভেতর দিয়ে নির্বাচনের আগেই জনগণের কাছে আরও দুর্বল ও আরও অসহায় বিএনপি হিসেবে প্রমাণিত হবে। যার ফল হবে, খালেদাবিহীন বিএনপি তাদের নিজস্ব আসন খুলনাতে মেয়র নির্বাচনে যে প্রতিযোগিতাটুকু করতে পেরেছে, সেটাও তারা তখন আর করতে পারবে না। বিএনপির এই সকল থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে, বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্য হবে দুটি। এক. দল হিসেবে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখা। দুই. সংসদে বিরোধীদলীয় স্ট্যাটাসটি অন্তত উদ্ধার করা। কারণ, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও যোগ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের খেলায় জয়লাভ করার যোগ্য কোন নেতা বিএনপিতে এখন আর নেই। তাই তাদের বাস্তবতা বুঝে ওপরে উল্লিখিত দুটো অর্জনের স্বার্থেই নির্বাচনে যেতে হবে। তবে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা ও এই থিঙ্কট্যাঙ্করা একটা ভয় পাচ্ছেন, শেষ অবধি জামায়াত তাদেরকে এ ধরনের একটি ফল পাবার নির্বাচনে যেতে দেবে কিনা? কারণ, জামায়াত ও বিএনপির উগ্র অংশের বাইরে এসে ফখরুল ইসলামদের পক্ষে কি নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব হবে? তাছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ের পরে সরকার যখন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্যে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে, তখন কি তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পক্ষে থাকবেন? [email protected]
×