ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব ফুটবলের আরেক চিত্র

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২১ জুন ২০১৮

বিশ্ব ফুটবলের আরেক চিত্র

এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় দিনের খেলায় উরুগুয়ে ১-০ গোলে মিসরকে হারিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দেশটি ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি ছিল। সেই প্রতাপ এখন নেই। কিন্তু যা আছে তাও বা কম কিসে। এবারের শিরোপা জয়ে উরুগুয়েকে নবম ফেভারিট ধরা হয় এবং এমন অবস্থান নিয়ে দেশটা তৃতীয়বার বিশ্বকাপ আসরে এলো। দুই তারকা সুয়ারেজ ও ক্যাভানি ২০১০ সালের বিশ্বকাপে উরুগুয়েকে সেমিফাইনালে নিয়ে এসেছিলেন এবং ২০১১ সালে দক্ষিণ আমেরিকা কাপে রেকর্ড ১৫তম শিরোপা জয় করেছিলেন। উরুগুয়ে আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে কিছু বড়। কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র ৩৪ লাখ। অর্থাৎ বার্লিনের লোকসংখ্যার তুলনায় কম। লোক সংখ্যার দিক দিয়ে এত ছোট একটি দেশ যদি এত সফল হতে পারে, তাহলে অনেক বড় ও ধনী দেশগুলো কেন পারছে না? এই প্রশ্নটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। তিনি চীনকে ২০৫০ সালের মধ্যে ফুটবলের পরাশক্তি করতে চান। তাই বিশ্বের বৃহত্তম ফুটবল একাডেমি গোয়াংজুর একাডেমি ছাড়াও ২০ হাজার নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর পরিকল্পনা নিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোকে কিনে নিতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে তাদের কাছ থেকে শেখার আশায়। সৌদি আরব স্প্যানিশ লীগে নয়জন খেলোয়াড়কে পাঠানোর জন্য অর্থ ব্যয় করছে। হাঙ্গেরীর স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু ফুটবল স্টেডিয়াম বানিয়েছেন। কিন্তু এসব দেশ যে পরিমাণ অর্থ ফুটবলের পিছনে ব্যয় করেছে, সে তুলনায় প্রাপ্তি সামান্যই। চীন এবারের বিশ্বকাপে বাছাই পর্বেই বাদ পড়েছে। এমন কি সিরিয়ার মতো দেশের কাছে ১-০ গোলে অবমাননাকর পরাজয় বরণ করেছে, যার জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়েছে। কোন দেশ ফুটবলে কেন ভাল হয়? ফুটবলে কোন দেশের শক্তি সামর্থ্য নির্ধারণের পেছনে খেলাধুলাগত ও অর্থনৈতিক কারণগুলো কি কি? কোন দেশ প্রত্যাশার তুলনায় কেন ভাল করে এবং কেন দ্রুত উন্নতি লাভ করে? অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে শুরু করা যাক। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ শিফান জিমানস্কি দেখিয়েছেন যে, অধিকতর ধনী দেশগুলো খেলাধুলায় ভাল হয়। ফুটবলের ক্ষেত্রে দীনদরিদ্র অবস্থা থেকে ধনবান তারকা বনে যাওয়ার প্রচুর নজির আছে। তবে যারা দরিদ্র স্থানগুলোয় বেড়ে ওঠে তারাই সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হয়। সেনেগালে কোচেরা ট্রেনিং শুরু করার আগে কিছু খেলোয়াড়কে কৃমির ওষুধ খাইয়ে বেশ ভালমতো খাওয়া-দাওয়া করায়। সে দেশে মাত্র তিনটি জায়গায় ঘাসের পিচ আছে। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ফুটবল আফ্রিকার ৯০ শতাংশ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে, আমেরিকায় করে ২০ শতাংশ এবং ক্রিকেটপাগল দক্ষিণ এশিয়ায় করে মাত্র ১০ শতাংশ। ফিফার হিসেবে ২০০৬ সালে চীনে মাত্র ২ শতাংশ লোক ফুটবল খেলেছে। অন্যদিকে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ৭ শতাংশ লোক খেলেছে। চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মাঝে মধ্যে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও ১৯৯৮ সাল থেকে তাদের কেউই টুর্নামেন্টের একটি খেলায়ও জিততে পারেনি। ফুটবলে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রয়োজন সৃজনশীলতার বিকাশ, যেটা ছোট বয়স থেকে করা দরকার। উরুগুয়ে কিশোর বয়স থেকে ফুটবলের কৌশলগত দক্ষতা অর্জনে যতটা সম্ভব সহায়তা করে থাকে। চীনের প্রেসিডেন্ট ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার স্কুলে ফুটবল খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করতে চান। চীন হয়ত তরুণদের সার্বক্ষণিক ফুটবল প্রশিক্ষণের স্কিম নেবে। এমন স্কিমের কারণেই ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকে চীন পদক তালিকার শীর্ষে স্থান পেয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে, এ জাতীয় বিরামহীন প্রশিক্ষণে জিনিয়াস বা প্রতিভাধর তৈরির ধার নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানি যখন বিভক্ত ছিল, সে সময় পূর্ব জার্মানির খেলোয়াড়দের পশ্চিম জার্মানির তুলনায় অনেক কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। অথচ পূর্ব জার্মানি মাত্র একবার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। মূল বিষয়টা হলো বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোরকে ফুটবল খেলার সুযোগ দেয়াটাই বড় কথা নয়। বড় কথা তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করা। অনেক দেশে খেলোয়াড়রা নিজেরাই নিজেদের শিখিয়ে উৎকর্ষ অর্জন করে। লাইবেরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়ে একদা আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্ট্রাইকার ছিলেন। তিনি জলাভূমির বস্তি এলাকায় জীর্ণ পুরাতন ফুটবল নিয়ে খেলতে খেলতে গোল করার অসাধারণ কৌশল আয়ত্ত করেন। স্পেন-পর্তুগাল ও লাতিন আমেরিকায় সে সব অসাধারণ খেলোয়াড় হয়েছে, যেমন পেলে থেকে ম্যারাডোনা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওনেল মেসি, নেইমার, ইনিয়েস্তাÑ এদের নিখুঁত কৌশল ও মুন্সিয়ানা রপ্ত করার পেছনে কাজ করেছে ফুটবল নামে এক বিশেষ ধরনের খেলা। এই খেলার জন্য পাঁচজন খেলোয়াড়ের একটি দল লাগে এবং খেলতে হয় ছোট আকারের বল দিয়ে। এতে নৈপুণ্য বাড়ে এবং তা শাণিত হয়ে ওঠে। জিদানের মতো স্বনামধন্য খেলোয়াড়রা রাস্তায় ফুটবল খেলা শিখেছিলেন। দেখা গেছে সেরা খেলোয়াড়রা খেলার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেছেন ৬-১০ বছর বয়স থেকেই। কিছু কিছু একাডেমিও চুক্তি অনুযায়ী খেলোয়াড় তৈরি করে দেয় এবং তারা শিশু-কিশোর বয়স থেকে ঘরোয়া চর্চার পেছনে অধিক সময় ব্যয় করে। এই সুযোগগুলো ধনী দেশগুলোতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বাবামায়েরাও এখন ফুটবল খেলার জন্য সন্তানদের বাইরে যেতে দিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অনেক হাউজিং এস্টেট তাদের কংক্রিটের খাঁচায় ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক ও অস্ট্রেলিয়ায় ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ করেছেন গুস হিডিংক। তাঁর ভাষায়, রাস্তাগুলোকে ক্লাবে সংগঠিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১০ সালে রাশিয়া এ বছরের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ঘোষিত হয়। তখন থেকেই রুশ ফুটবল দলের অবস্থার উন্নতির বদলে অবনতিই ঘটেছে। দলটি ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে একটি খেলায়ও জিততে পারেনি। রাশিয়া এখন বিশ্বকাপের প্রবীণতম স্কোয়াডগুলোর অন্যতম। এ জাতীয় স্বল্পদর্শিতা আমেরিকারও ক্ষতি করেছে। আমেরিকা এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। অথচ সম্পদ, ট্রেনিং ইত্যাদির বদৌলতে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী ফুটবল দলগুলোর একটি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু খুব কমসংখ্যক খেলোয়াড়ই সিরিয়াস ধরনের কোচিং লাভ করেছে। ফুটবলে উন্নতির কোন কেন্দ্রীভূত স্কিম না থাকা এর এক কারণ। এই কেন্দ্রীভূত স্কিম ছোট ছোট দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। উরুগুয়ের প্রতিটি শিশু ফুটবল দলের ফলাফলগুলো জাতীয় ড্যাটাবেসে সংরক্ষিত। ৩৩ লাখ লোকের দেশ আইসল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অথচ এর ফুলটাইম পেশাদার খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১০০। তৃণমূল পর্যায়ের ক্লাবগুলোতে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য দেশটি ৬শরও বেশি কোচকে ট্রেনিং দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে আইসল্যান্ড ১৫৪টি ছোটখাটো ফুটবল মাঠ বানিয়েছে, যার মাটির নিচে উত্তাপের ব্যবস্থা আছে, যাতে করে প্রতিটি শিশু তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফুটবল খেলার সুযোগ পায়। আফ্রিকায় এমন সুযোগ চিন্তাও করা যায় না। তবে আফ্রিকার ফুটবল মেধার বিপুল সমারোহ আছে, যদিও তা কদাচিতই কাজে লাগানো হয়। প্রশিক্ষণের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে, তা সে কাজে ব্যয় না করে কর্মকর্তাদের পেছনে অকাতরে ব্যয় করা হয়। সীমিত সম্পদ অপচয়ে চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সেনেগাল এবার রাশিয়ায় তিন শ’ সদস্যের একটি টিম পাঠিয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকা অবশ্য ফুটবলের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে নিজেকে ভালভাবে যুক্ত করে ফেলেছে। সেই নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দু হলো পশ্চিম ইউরোপ। কেননা সবচেয়ে বিত্তবান ক্লাবগুলো আছে যেখানে- সেখানে খেলোয়াড়রা সর্বোত্তম কোচিং পায়। এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আইভরি কোস্ট। দেশটি বেলজিয়ামের একটি ক্লাব বেতেরেনএ তরুণ তারকাদের একটি প্রজন্মকে পাঠিয়েছে। তাদের অনেকেই পরে ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লীগে স্থান করে নিয়েছে। সেনেগাল ২০০২ সালে তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে একটি খেলায় হারিয়েছিল। সে সময় সেনেগলী দলটির দু’জন খেলোয়াড় বাদে আর সবাই ফ্রান্সের বিভিন্ন দলে খেলত। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বলকান অঞ্চল থেকেই সর্বাধিকসংখ্যক খেলোয়াড়কে শক্তিশালী দেশীয় লীগে খেলতে পাঠানো হয়। ৪০ লাখ লোকের দেশ ক্রোয়েশিয়া ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর তার কোন ক্লাবই ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। অথচ ক্রোয়েশীয় ক্লাবগুলো রিয়েল মাদ্রিদ, বার্সিলোনা, বেয়ার্ন মিউনিখ ও মিলান ক্লাবের কাছে প্রচুর খেলোয়াড় বিক্রি করেছে। বিদেশী ক্লাবগুলোতে খেলা এই খেলোয়াড়রাই ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিল। আবার কিছু কিছু দেশ আছে যারা এ ব্যাপারে অতটা কুশলী নয়। গত ১৫ বছরে মেক্সিকোর অনূর্ধ ১৭ বছরের ফুটবল দল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের অনুরূপ দলগুলোর চাইতে অনেক ভাল করলেও দেশটির সিনিয়র স্কোয়াডের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খেলোয়াড় দেশীয় লীগে খেলে থাকে, যেখানে অন্য দেশগুলোর দুই বা তিনজন খেলোয়াড় বাইরের লীগে খেলে। খেলোয়াড় রফতানি বিদেশের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থেকে লাভবান হওয়ার একমাত্র পথ নয়। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শিক্ষার অনেকটাই জুটেছে ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি কোচদের কাছ থেকে। আজ তো সেখানে ভূরি ভূরি আন্তর্জাতিক কোচের সমাবেশ। শুধু দক্ষিণ আমেরিকায় কেন, এশিয়া ও অন্যান্য স্থানেও। তবে দেখা গেছে মাঝারি মানের টিমগুলোর উন্নতি সাধনে খুব অল্পসংখ্যক কোচই তেমন কিছু করতে পারে। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বাইরের দলগুলো ২০ বছর আগে যেমন ছিল তার তুলনায় তেমন একটা উন্নতি করেনি। বরং দক্ষিণ কোরিয়া আগে যা ছিল ২০০২ সালের পর থেকে দেশটির খেলার মান তার থেকে সামান্য কমেছে। বিশেষজ্ঞের মতে ফুটবলের ক্ষেত্রে এই দেশগুলো এক ধরনের মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়েছে। ঠিক যেমন উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্রুত ধনী দেশগুলোর প্রযুক্তি অনুকরণ করে, কিন্তু কাঠামোগত সংস্থার বাস্তবায়ন করতে পারে না। বাইরের একজন দক্ষ কোচ খেলায় নতুন কৌশল ও নৈপুণ্য নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল খেলোয়াড়দের একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পারে না। যাই হোক, এবারের বিশ্বকাপ আসরে এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার দলগুলো দুর্বল দল হিসেবেই থাকবে। তবে ২০০২ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত অবস্থায় আসতে পারে। কোনবারই হয়নি এমন দলের এ বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২৫ শতাংশ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×