ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্র ॥ দেশজ সঞ্চয় এবং জাতীয় সঞ্চয় দুটোই কেন হ্রাস পাচ্ছে?

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২২ জুন ২০১৮

 সঞ্চয়পত্র ॥ দেশজ সঞ্চয় এবং জাতীয় সঞ্চয় দুটোই কেন হ্রাস পাচ্ছে?

মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ তার মন্ত্রণালয়ের পারফর্মেন্সের জন্য নয়। এটা সর্বজনবিদিত। আমি আজকে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি সঞ্চয়পত্রের ওপর সংসদে তার বক্তব্যের জন্য। তিনি সংসদে এই বিষয়ে কী কী বলেছেন তার পুরোটা আমি জানি না। খবরের কাগজে দেখেছি তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কারণ তিনি সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর ওপর কিছু বলেননি। এ কথার পর তিনি বলেন, ‘আশা করি বাজেটের পরও অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের ওপর হাত দেবেন না। উল্লেখ্য, সারাদেশের লাখ লাখ সঞ্চয়ী, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী-বেসরকারী লোকজন, বেওয়া বিধবা, মধ্যবিত্ত, নারী, রেমিটেন্স প্রাপক, নিম্নবিত্ত, ছোট ছোট চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি শ্রেণীর লোকজন অধীর আগ্রহে ছিলেন অর্থমন্ত্রী কি বলেন সঞ্চয়পত্রের ওপর। কারণ কিছুদিন পরপরই তিনি সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হবে বলে তার মতামত দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই সবাই ছিলেন আতঙ্কিত। এই সাড়ে পাঁচ-ছয় শতাংশ মূল্যস্ফীতির দিনে অর্থমন্ত্রী কি শেষ পর্যন্ত কাঁচি চালাবেন মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর। বাজেটে, অর্থাৎ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে তিনি তা করেননি। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি বাজেটের বাইরে গিয়ে তা করবেন না। এখানেই বেগম মতিয়া চৌধুরী লাখ লাখ অসহায় মধ্যবিত্তের আকুতির কথা সংসদে বলেছেন। আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একমত হবেন। তিনি যে সঞ্চয়পত্রের পক্ষে এবং তিনি যে সঞ্চয়পত্র মধ্যবিত্তের একটা ভরসাস্থল তা বিশ্বাস করেন তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। মাঝ খানে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছিল যে, সঞ্চয়পত্র যায় যায়। সুদ হ্রাস, সঞ্চয়পত্র কেনার উর্ধসীমা হ্রাস, রেয়াতি সুবিধা বাতিল, সঞ্চয়পত্রের সংখ্যাহ্রাস, উৎসে উচ্চহারে কর কাটা ইত্যাদি আক্রমণে সন্ত্রাসীরা সন্ত্রস্ত। তখন দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী তার নিজের উদ্যোগে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ বলে একটি সঞ্চয়পত্র উদ্ভাবন করলেন। পরে এই সঞ্চয়পত্র ৬৫ বছর বয়স্ক লোকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপর থেকে সঞ্চয়পত্র আবার উজ্জীবিত হয় কিন্তু একশ্রেণীর বিশ্বব্যাংকপ্রেমী এখনও সঞ্চয়পত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের প্রয়োজনীয়তা, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা, মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের অভ্যাস, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা। সঞ্চয় অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারী প্রণোদনা এসব বিষয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। আমি আজকের লেখায় এসব আলোচনায় যাব না। শুধু দুইটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করব। একটি হচ্ছেÑ সরকারের ব্যাংক ঋণ এবং অন্যটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয়। কথা উঠলেই কিছু লোক যুক্তি দেখায় সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর বেশি সুদ কেন দেবে? ব্যাংকঋণের ওপর সুদ কম। প্রথম কথা বেসরকারী ব্যাংক সরকারকে কোন ঋণ দেয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া আত্মঘাতী বিষয়, অতএব তা পরিত্যাজ্য। বাকি রইল সরকারী ব্যাংক। সরকারী ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয় সত্য কথা। এতে তো ব্যাংকের লোকসান, এ কথাটি কী কেউ ভেবে দেখেছেন? সরকারী ব্যাংক থেকে সরকার বাণিজ্যিক হারে ঋণ নেয় না। ট্রেজারি বিল, বন্ড ইত্যাদির মারফত সরকার সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। এসব পাঁচ দশ, পনের, বছরী ঋণ। এর সুদ অত্যন্ত কম। চার-পাঁচ ছয় শতাংশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এর অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে সরকারী ব্যাংকগুলোকে ঠকানো। তাদের মুনাফা কমে। পরিণামে ভোগে আমানতকারীরা। সুদ আয় থেকেই সুদ ব্যয় হয়। সরকারকে ঋণ দেয়ার ফলে সুদ আয় কম হয়, অতএব সরকারী ব্যাংকও আমানতকারীদের সুদ কম দেয়। ফলে সরকারী ব্যাংকের নিট মুনাফাও কম হয়। এতে কী দাঁড়াল। আমনাতকারীরা ঠকল। এটা কী কাম্য/এছাড়া রয়েছে ব্যবসায়ীদের আপত্তি। সরকারী ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণে টান পড়ে। তারা প্রয়োজনমতো ঋণ পায় না। এ কারণে ব্যবসায়ীরা চায় না সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিক। দ্বিতীয় আরেকটি যুক্তি দেয়া হয়, আর সেটি হলো সুদের হারের যুক্তি। বলা হয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিলে সরকারের সুদ ব্যয় বেশি হয়। অতএব ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সরকার উপকৃত হয়। ওপরে সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রকৃত অর্থ কী সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি। দেখা যাক, সুদ ব্যয়ের যুক্তিটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য। সরকার সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি করলে বেশি সুদ দিতে হবে এ কথা তো ঠিকই। প্রথম প্রশ্ন কতটুকু বেশি? ব্যাংক থেকে নিলেও সরকারকে সুদ দিতে হতো। যেহেতু সঞ্চয়পত্রে সুদের হার এই মুহূর্তে সামান্য বেশি তাই এখন সুদ ব্যয় একটু বেশি হবে। কিন্তু কথা আছে। সঞ্চয়পত্র একটি মেয়াদী প্রোডাক্ট। তিন বছরের নিচে সঞ্চয়পত্র নেই, আর পাঁচ বছর। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে মেয়াদ যত বেশি হবে সুদের হার তত বেশি হবে। এসব সাধারণ ব্যাংকের নীতি। সবচেয়ে বড় কথা ব্যাংকের সুদের হার উঠানামা করে। এবং তা মুহূর্তে মুহূর্তে। সঞ্চয়পত্রে এই সুযোগ নেই। পাঁচ বছরী সঞ্চয়পত্র কিনলে এর মধ্যে সুদের হার পরিবর্তন হবে না। ব্যাংকের সুদের হার বিগত দিনে অনেকবার সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ছিল। তখন কিন্তু কেউ কোন কথা বলেনি। যেই ব্যাংকের সুদের হার একটু কমে তখনই শুরু হয় শোরগোল। এটা অযৌক্তিক। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে মোট সুদ ব্যয় নিয়ে। বার বার বলা হচ্ছে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি করলে সুদ ব্যয় বাড়বে। কিন্তু তা সামগ্রিক বাজেটের কত অংশ? একটি হিসাব হচ্ছে টাকার অঙ্কে। আরেকটি হিসাব হচ্ছে শতকরা হিসাব। হিসাব শাস্ত্রে ‘শতকরা’ হিসাব অনেক নির্ভরযোগ্য। তুলনার ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়। দেখা যাচ্ছে টাকার অঙ্কে সুদ ব্যয় বাড়লেও শতকরা হিসাবে মোট বাজেটে সরকারের সুদ ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। সমগ্র বাজেটে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল মোট বরাদ্দের ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। নতুন অর্থবছর হবে ২০১৮-১৯। এতে মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ০৫ শতাংশ খরচ হবে সুদ ব্যয় হিসাবে। বলাবাহুল্য, এই বছরে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হবে। তারপরও দেখা যাচ্ছে সুদ ব্যয় সরকার একটা সীমার মধ্যে রেখে চলেছে। সবচেয়ে ভাল হতো যদি সরকার ঋণ না করত। যা আয়, তাই সরকারের ব্যয়। কিন্তু এমন আদর্শ অবস্থা আমাদের ছিল না, এখনও নেই। আমাদের বাজেট বরাবরই ঘাটতি বাজেট। এই ক্ষেত্রেও দেখা যায় সরকার একটা সীমার মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সরকার ঋণ করে এবং তা দীর্ঘদিন থেকে। ঋণ না করে তার উপায় নেই। এই ঋণ ঘি খাওয়ার জন্য যদি হতো তাহলে আপত্তি তোলা যেত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঋণ করা হচ্ছে উন্নয়নের জন্য। উন্নয়নের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত টাকা নেই। রাজস্ব যতটুকু বৃদ্ধি পাওয়া দরকার তা সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অথচ খরচ বসে নেই। এমতাবস্থায় ঋণ হচ্ছে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ঋণের উৎস কয়েকটি : কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ঋণ এবং দেশের মানুষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সরকার বিলে ব্যবসায়ীরা আপত্তি করে, আমানতকারীরা ঠকে। বিদেশী ঋণের কত ‘হ্যাপা’ তা সবারই জানা। নানা শর্ত সেখানে যা অনেক সময় আমাদের স্বার্থবিরোধী। এমতাবস্থায় দেশের মানুষই হয় নির্ভরযোগ্য উৎস। তারা কোত্থেকে ঋণ দেবে সরকারকে? তাদের সঞ্চয় থেকে। সরকার এ কারণে মানুষের সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে। সঞ্চয় পরিদফতর রয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ‘দেশজ সঞ্চয়’ এবং ‘জাতীয় সঞ্চয়’ সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পূর্ববর্তী দুই বছরের তুলনায় ‘দেশজ সঞ্চয়’ হ্রাস পেয়েছে। ‘জাতীয় সঞ্চয়’ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। এর কুফল ভোগ করছে বিনিয়োগ। বেসরকারী বিনিয়োগ এক জায়গায় বহুদিন থেকে। যা হচ্ছে তা সরকারী বিনিয়োগের মাধ্যমে। এটা কাম্য পরিস্থিতি নয়। সঞ্চয় কমবে, আর আমরা বসে থাকবÑ তা হয় না। আমাদের সমাজ সঞ্চয় ছাড়া চলবে না। এটা আমেরিকার সমাজ নয়। সেখানে সঞ্চয় লাগে না। বেকার থাকলে সরকার দেখে। বৃদ্ধ বয়সে সরকার দেখে। অসুস্থ হলে সরকার দেখে। আমাদের দেশে এই অবস্থা নেই। আমাদের মধ্যবিত্তকে ঘর-সংসার চালাতে হয়। বেকার ভাই-বোনকে দেখতে হয়। বিধবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে হয়। বুড়ো বাবা-মাকে দেখতে হয়। গরিব আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে হয়। এমনকি প্রতিবেশীকেও সাহায্য সমর্থন করতে হয়। আবার বৃদ্ধ বয়সে নিজের চিকিৎসার ব্যয় নিজেকে বহন করতে হয়। বেকার হলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়। এমতাবস্থায় মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ছাড়া উপায় নেই। এটা সরকার জানে বলেই সে তার পাশে দাঁড়ায়। মধ্যবিত্ত হাত পাততে পারে না। সে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পেও নেই। অবসরপ্রাপ্তরা ভাত না খেলেও ‘ট্রাক সেলের’ লাইনে দাঁড়াতে পারে না। অথচ এই শ্রেণীর লোক সমাজে দিন দিন বাড়ছে। তাদের ভরসাস্থল সঞ্চয়পত্র শেয়ার বাজার নয়। লাখ লাখ পরিবার এর সুদ আয় থেকেই সংসার চালায়। এটা অঙ্কের বিষয় নয়। সরকারের লাভ-লোকসানের বিষয় নয়। নিতান্তই মানবিক দিক। এমতাবস্থায় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীÑ যা বলেছেন তার সঙ্গে একমত পোষণ করি। বাজেটে যা হয়নি, তা যেন বাজেটের পর না হয়। দুই দিন পর পর সুদ কমানো হবে, কমানো হবে বলে অহেতুক লাখ লাখ লোকের জন্য অশান্তি সৃষ্টি করা উচিত নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশা করি বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×