ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুশ্চিন্তায় কাটবে ফুটবলের দুঃখী রাজকুমারের জন্মদিন...

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৩ জুন ২০১৮

  দুশ্চিন্তায় কাটবে ফুটবলের দুঃখী রাজকুমারের জন্মদিন...

রুমেল খান ॥ ‘কখনও কখনও বড় একা হয়ে যাই/কখনও কখনও নিঝুম প্রাতে/চোখ মেলেই বিষণœ হয়ে যাই!/ভালো লাগে না আলো, নিষ্ঠুর লাগে/নাগরিক চৈতন্যের নিত্য শ্রুত শব্দ!/আত্মার গভীরে জেগে ওঠে/ ঘুমিয়ে থাকা শব্দহীন নির্বিবাদী সমঝোতা;/বুক ধড়াসে মনে পড়ে যায়-/আমি একা, বড় একা!’ লিওনেল আন্দ্রেস মেসির মানসিক অবস্থাটা এখন অনেকটা এই কবিতার মতোই। তবে অনেকেই আপত্তি করতে পারেন আরেকটি কবিতার এই পংক্তিগুলো বলে, ‘বিধাতাই তো মানুষকে বানিয়েছেন একাকী/এ মর্ত্যলোকে পাঠিয়েছেন একাকী/জীবনযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন একাকী/আবার ফিরিয়েও নেন একাকী’... তাদের কথা এক অর্থে ঠিকই আছে। তবে কবিতার ওই ‘জীবনযুদ্ধ’ শব্দের জায়গায় যদি ‘ফুটবলযুদ্ধ’ শব্দটি বসিয়ে নেন, তাহলে নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন বাস্তব প্রেক্ষাপটটা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। চলমান রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ফুটবল ম্যাচগুলোতে মেসিকে বড়ই একা একা লাগছে। ফুটবল হচ্ছে দলীয় খেলা। দলীয় সাফল্যের জন্য প্রয়োজন দলীয় সংহতি, আত্মবিশ্বাস, জাদুকরি নৈপুণ্য আর ভাগ্যদেবীর কৃপা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত এগুলোর কোনটিই দেখা যায়নি ‘এলএম টেন’ বাহিনীর। আগামী ২৪ জুন মেসি পা রাখবেন ৩১-এ। জন্মদিনটা এবার নির্ভার হয়ে পালন করা হচ্ছে না। বরং এই দিনটা কাটবে অনেক দুশ্চিন্তা আর চাপ নিয়ে। ভেবেছিলেন গ্রুপ পর্যায়ে প্রথম দুই ম্যাচেই জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে নাম লেখানোটা নিশ্চিত করে ফেলবে ‘লা আলবিসেলেস্তে’ খ্যাত আর্জেন্টিনা। এটাই হতে পারতো তার জন্মদিনের সেরা উপহার। কিন্তু সেটা আর হলো কই? প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের সঙ্গে দুর্ভাগ্যের ড্র। নিজে মিস করলেন পেনাল্টি। পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। ওই ম্যাচে নিজে ছিলেন পুরোপুরি নিষ্প্রভ। বিশ্বকাপে এখনও অবশ্য টিকে আছে দু’বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, তবে তাদের ভাগ্য এখন অন্যের হাতে। ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারার পর থেকেই আর্জেন্টিনা যতটা না সমালোচিত হচ্ছেন, তারচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন মেসি। ‘মেসি ইচ্ছে করেই বাজে খেলেছে’, ‘মেসি খাম্বার মতো স্থির ছিলেন’ ... এরকম অনেক তীক্ষè বাক্যবাণই এখন ছোড়া হচ্ছে মেসির দিকে। এ জন্যই তিনি একা। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ম্যাচেই কি মেসিকে একা-বিধ্বস্ত মনে হয়নি? ড্রেসিং রুম থেকে মাঠে যাবার আগ পর্যন্ত টিভি ক্যামেরায় মেসিকে যতবারই দেখা গেছে, ততবারই খটকা লেগেছে। মেসির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। অনেক স্নায়ুচাপে আছেন। মুখটা শুকনো, মলিন এবং মুখের মাংসপেশিও শক্ত-স্থির। সতীর্থরা আশেপাশে ছিলেন। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললেও মেসি ছিলেন একেবারেই চুপচাপ। এখানেই শেষ নয়। খেলা শুরুর আগে যখন আর্জেন্টিনার জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল, তখন টিভি ক্যামেরায় যখন মেসির চেহারাটা দেখানো হলো, তখন আরও বিস্ময়ের মাত্রাটা বেড়ে গেল বহুগুণে। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা নয়, মাথা নিচু করে নিজের কপাল টিপে ধরছিলেন মেসি। তখনই বোঝা গেলÑ সামথিং ইজ রং। খেলা শুরুর আগেই মানসিকভাবে হেরে গিয়েছিলেন মেসি। পরে মাঠে খেলার সময় সেটারই প্রভাব পড়েছিল। যশ, খ্যাতি, সাফল্য, কৃতিত্বের পরিচায়ক কার্যাবলী... সবকিছু মিলিয়েই একজন মানুষ পরিণত হন কীর্তিমানে। স্প্যানিশ ক্লাব বার্সিলোনার হয়ে অনেক আগেই কীর্তিমান পুরুষে পরিণত হয়েছেন লিওনেল মেসি। বর্তমান ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার, যিনি স্প্যানিশ ক্লাব বার্সার হয়ে জিতেছেন ৩২টি শিরোপা। সেই সঙ্গে ৫ বার ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাবপ্রাপ্তি। তারপরও মেসিকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে একটি অপবাদ। তা হলো, ‘বার্সার জার্সিতে যতটা উজ্জ্বল, আর্জেন্টিনার জার্সিতে ততটাই অনুজ্জ্বল মেসি। জাতীয় দলের হয়ে কোন সাফল্য নেই তার।’ অথচ তারা কিন্তু ভুলে গেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে যুব বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের শিরোপা জিতেছেন মেসি। আসলে বিশ্বকাপ না জেতার কারণেই এই সমালোচনা (মেসি অবশ্য জেতেননি কোপা আমেরিকা এবং কনফেডারেশন্স কাপের শিরোপাও)। পৃথিবীর অনেক গ্রেট ফুটবলারই আছেন, যারা কখনও বিশ্বকাপ জেতেননি। যেমন আর্জেন্টিনার আলফ্রেড ডি স্টেফানো, আয়ারল্যান্ডের জর্জ বেস্ট, হল্যান্ডের ইয়োহান ক্রুইফ, রুড গুলিট, পর্তুগালের ইউসেবিও, হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস, ব্রাজিলের লিওনিদাস, জিকো, ইতালির মালদিনি, ফ্রান্সের জঁ পিয়েরে পাঁপাঁ, জার্মানির মাইকেল বালাকসহ আরও অনেকে। তারা বিশ্বকাপ না জিতলেও ‘গ্রেট’ ফুটবলার। কিন্তু ‘বেস্ট’ ফুটবলার নন। ওই মর্যাদাটি বহু বছর ধরেই দু’জন ফুটবলারের জন্য সংরক্ষিত হয়ে আসছে। একজন ব্রাজিলের পেলে। অন্যজন? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কীর্তি ও পরিসংখ্যানের বিচারে অনেক ক্ষেত্রেই গুরু ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে গেছেন তার যোগ্য ভাবশিষ্য মেসি। জাতীয় দলের হয়ে গোলসংখ্যায়ও অনেক আগেই পেছনে ফেলে বনে গেছেন আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা (১২৬ ম্যাচে ৬৪ গোল)। অনেকেই বলেছেন, বিশ্বকাপ জিততে পারলেই ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের তালিকায় উঠে যাবে মেসির নাম। গত ২০১৪ আসরে লক্ষ্য পূরণের অনেক কাছাকাছি গিয়ে পারেননি। আর এবার তো সেই সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। আর সে জন্যই এবারের জন্মদিনটা একরাশ হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটবে ফুটবলের এই দুঃখী রাজকুমারের।
×