ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

এসডিজি অভীষ্ট ৩.৪ অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৪ জুন ২০১৮

এসডিজি অভীষ্ট ৩.৪ অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ

২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছরের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের চিন্তা সামনে রেখে গৃহীত হয় ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল যা এসডিজি নামে পরিচিত। কেউ কেউ একে ‘এজেন্ডা ২০৩০’ বলেও উল্লেখ করেন। এই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রাগুলো প্রতিটির লক্ষ্য অর্জনের সুস্পষ্ট সূচক নির্ধারণ করা আছে যেগুলো জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো অর্জনযোগ্য বলে মনে করেছে ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নিজেদের দেশের জন্য করণীয় ঠিক করে সেই মতে কাজ করছে। এসডিজি মূলত বিশ্ব উন্নয়নের একটি মহাকর্মপরিকল্পনা যা বিন্যস্ত হয়েছে ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যে। এই লক্ষ্যগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে একটি যথাযথ পর্যায়ে উন্নীত করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি সমস্যা যেমন বৈষম্য, অশান্তি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর হবে বলে আশা করা হয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনায় একটি নীতি-প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছেÑ কাউকে পেছনে না ফেলে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাবার। ডিজিটাল বাংলাদেশে এসডিজি অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ তিউনিস শীর্ষ সম্মেলনে তথ্য সমাজ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকাকে একীভূত করে একে টুলস বা অঙ্গীভূত কৌশল হিসেবে উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে ব্যবহার করার পরামর্শে সকল সদস্য-রাষ্ট্র সম্মত হয়। সেই থেকে সব দেশে উন্নয়ন কর্মকা-ে তথ্যপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে সঙ্গত কারণেই এর বিশেষত্ব তাৎপর্যময়। এসডিজির ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যের তৃতীয়টি হলো ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ (সকল বয়সী সকল মানুষের জন্যে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ)’। এই তৃতীয় অভীষ্ট অর্জনের সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা হলো ১৩টি যার অন্যতম হলো ৩.৪ যাতে উল্লেখ আছেÑ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের কারণে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা এবং মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণ নিশ্চিতে সহায়তা প্রদান করা। এই অভীষ্ট অর্জনের সূচকে (৩.৪.১) উল্লেখিত আছেÑ হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে মৃত্যুহার (কমিয়ে আনা)। স্বাস্থ্যসেবায় দুনিয়াব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার বেড়েছে যা চিকিৎসাসেবাকে সাশ্রয়ী, আধুনিক ও সহজলভ্য করেছে। উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিউটিক্যাল কূটনীতি বা ওষুধ কোম্পানিগুলোর এক ধরনের রাজনীতি আছে যা প্রযুক্তির ব্যবহারকে কোন কোন ক্ষেত্রে বিতর্কিত করার অথবা প্যাটেন্টের নামে একচেটিয়া করার কূটকৌশল আছে। এর উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক এতে কোন সন্দেহ না থাকলেও এসডিজি-৩ বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট অভীষ্ট ও সূচক নির্ধারিত থাকার ফলে দেশগুলোর ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ অনেকটাই বেড়েছে। গড় আয়ু বাড়ার ফলে ও বিশ্বব্যাপী গত কয়েক দশকে সংক্রামক ব্যাধি নিরাময়ের কার্যকরী পদক্ষেপ ও সুফলের কারণে বিশ্ব এখন মনোযোগ দিয়েছে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের দিকে। দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্য মোচনের কর্মসূচীগুলোর অন্যতম সুবিধা বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সূচক বাড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রতিবছর ৩৮ মিলিয়ন মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে যার মধ্যে ১৬ মিলিয়ন মৃত্যুই ৭০ বছরের আগেই অনাকাক্সিক্ষত বা অকাল মৃত্যু। সাধারণত আমরা এই হিসাবটা উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা রেকর্ড থেকে পেয়ে থাকি, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো চিকিৎসা রেকর্ড ব্যবস্থাপনা না থাকা বা দুর্বলতার কারণে এসব মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অসংক্রামক রোগ বিষয়ে একটি বিশ্ব ঐক্যের সমন্বিত ঘোষণা আসে। যার ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার নিজস্ব প্রচেষ্টায় হিসাব কষে দেখেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট মৃত্যু হারের ৮০ ভাগই অনাকাক্সিক্ষত, অকাল অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটছে। এই বিষয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবরের উরুগুয়ে সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছে যাতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামোকে শক্তিশালী করে অসংক্রামক ব্যাধির আগ্রাসী পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায় নতুবা উন্নয়নের সকল অগ্রগতি সূচক হুমকির মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অসংক্রামক ব্যাধি নিরাময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন বাংলদেশে উচ্চ রক্তচাপ অতি উপেক্ষণীয় একটি রোগ লক্ষণ যা হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও মস্তিষ্কের শিরা প্রবাহের রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশের অনেক মানুষ রক্তচাপ পরিমাপে অসতর্ক বলে আকস্মিক হৃদরোগ বা মস্তিষ্কের স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় যার দোষ পড়ে আইসিইউর দুর্বল ব্যবস্থাপনা বা অপ্রতুল সুযোগের প্রতি। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তে চর্বির উপস্থিতির পরীক্ষা করে তার ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড রেখে একটি ধারাবাহিক চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা চালু করেই তা মোকাবেলা করা সম্ভব। বহুজাতিকের কূটচালে গ্রামে-গ্রামে বা উপজেলায় ব্যয়বহুল আইসিইউ বা সিসিইউ সেবা চালু করা আর যাই হোক অন্তত এই মুহূর্তে আমাদের দেশে চালু করা সম্ভব নয়। কোন মানুষ এখন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে বা জ্ঞান হারালে আমরা তাকে নিকটস্থ জেলা সদরে নিয়ে যাই যেখানে এ রকম সেবার ব্যবস্থাপনা নেই। ক্রমান্বয়ে এই সেবা একদিন সব চিকিৎসা কেন্দ্রে চালু হলেও তার বিশাল খরচ এড়াতে আমরা ছোট ছোট সেবা কেন্দ্রগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ও সাশ্রয়ী করতে পারি। এর জন্য আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করে নিতে হবে ৩টি কাজের- ১. গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ও রোগীর রেকর্ড রাখতে উপযোগী সফটওয়্যার তৈরি করা যা আমাদের দেশেই সম্ভব। ২. নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও ৩. প্রশিক্ষিত জনবল। এই তিনটি কাজ করার সামর্থ্য আমাদের দেশেই আছে, এর জন্য চিকিৎসা প্রটোকল উপযোগী করা ছাড়া অন্য কোন কাজে বিদেশী সহযোগিতার দরকার হবে না। আর এই তিন কাজের মাধ্যমে আমরা এসডিজি ৩.৪-এর সূচকে বর্ণিত ক্যান্সার, মানসিক স্বাস্থ্য, কিডনি রোগের মতো তথাকথিত ব্যয়বহুল রোগের আগামবার্তা পেয়ে চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারি। বিশেষ করে প্রাথমিক নির্ণয়ের তথ্য আমাদের অনিশ্চিত মৃত্যু বা রোগে ভোগের কারণ কমাতে পারে। আমরা যদি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে চাই তাহলে সূচকগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কেমন করে তথ্যপ্রযুক্তিকে সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে কৌশলপত্র তৈরি করতে পারি। আশা করছি সরকারের নীতি নির্ধারণীমহল এই বিষয়টি গুরুত্ব অনুধাবন করবেন। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×