ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

দুয়ারে কড়া নাড়ছে ভোট

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৫ জুন ২০১৮

দুয়ারে কড়া নাড়ছে ভোট

ভোটের আওয়াজ ক্রমশ ভেসে আসছে জনজীবনের নিত্যদিনের যাপিত সময়ে। কিন্তু নির্বাচনী ঝড় এখনও ঘনীভূত হয়ে ওঠেনি। তথাপি দেশের কোথাও কোথাও নির্বাচনী ডঙ্কা বাজছে। এ যেন ‘ধাই কুড়কুড় ধাই কুড়কুড় ভোটের বাদ্যি বেজে ওঠা’র মতো। ভোট এলেই দেশজুড়ে এক ধরনের উন্মাদনাও তৈরি হয়। উৎসবের আমেজেও রঞ্জিত হয়ে উঠে বাঙালী জীবন। এবারের ঈদ উৎসবের মধ্যে নির্বাচনী তরঙ্গ প্রবাহিত হয়েছে গ্রামবাংলা জুড়ে। প্রার্থী হতে চাওয়াজনরা দেদার গণসংযোগ করেছেন। জনসমর্থন পাওয়ার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারেও গিয়েছেন অনেকে। জনবিচ্ছিন্নরাও সচেষ্ট ছিল জনসংযোগে। উপহার, উপঢৌকন বিলানো হয়েছে দেদারসে। কিন্তু এসব প্রাপ্তিযোগ ভোটের বাক্সে সংযুক্ত হবে কিনা তা অনিশ্চিত। ভোটারের মন ‘সখা সহস্র বছরের সাধনার ধন’ যেন। তাই ভোট কেন্দ্রে ব্যালট হাতে নেয়ার আগে ও পরে ভোটারের মন বদল হয়েও যায় কখনও সখনও। তবে রাজনৈতিক দলের সমর্থক যারা, তাদের মন সহজে বদলে যাওয়ার নয়। এবার আড়াই কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। যাদের মন এখনও অধরা। তাদের পালের হাওয়া কোনদিকে বয়ে যাবে, তার কোন নিশানা এখনও গড়ে উঠেনি। এই তরুণদের মধ্যে অনেকে নতুন ভোটার হয়েছেন। প্রথম ভোটদানের রোমাঞ্চ তাদের তাড়া করবেই। কিন্তু এই ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা নিশ্চয় আগাম তৎপরতা চালাবেন। তবে তরুণ ভোটারদের মন জয় সহজ কাজ নয়। তরুণদের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা এখনও গড়ে ওঠেনি। তাদের জন্য কোন কর্মসূচীরও দেখা মেলে না। নির্বাচনী দামামা বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্যের উত্থান ঘটতে পারে এমন ভাবনা অনেক দলের। তরুণরা এখনও নির্বাচনমুখী হয়ে ওঠেনি। অবশ্য যে কোন সময়ই তারা নির্বাচনী ডামাডোলে মিশে যেতে পারে। কারণ ভোটের দামামা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকবেই। আঠারো থেকে পঁচিশ বছর বয়সী তরুণরাই মূলত নির্ধারণ করে দেবে কারা ক্ষমতায় যাবে অথবা যাবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর ছয় মাস বাকি। এরই মধ্যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলছে। সম্প্রতি খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ এবং অবাধ নির্বাচন হয়েছে। ভোটের দিন এবং নির্বাচন পূর্বাপর সময়ে কোন হাঙ্গামা বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পেরেছেন। পরাজিত প্রার্থীরা অবশ্য যথারীতি নানা অভিযোগ এনেছেন। যদিও সে সবের পক্ষে কোন প্রমাণাদি হাজির করতে পারেননি। সেই নির্বাচনের পর আগামীকাল মঙ্গলবার ২৬ জুন হতে যাচ্ছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এরপর বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হবে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঝুলে আছে মামলার কারণে। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে মেয়রের আসনটি শূন্য রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনকে ‘ড্রেস রিহার্সেল’ মনে করা হচ্ছে। অবশ্য এই নির্বাচনগুলোতে জনমতের যে প্রতিফলন ঘটবে, তা একাদশ সংসদ নির্বাচনে কি হবে, সে সম্পর্কে যেমন একটা আগাম ধারণা করা যাবে, তেমনি এই ফল সেই নির্বাচনে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা কম নয়। ক্ষমতাসীন জোট এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো বুঝে নিতে পারবে জনমত কোন দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছে। সরকারী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে বেশ আগেভাগেই। দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের কাজও চালাচ্ছে। অন্যান্য দলগুলো হাঁটিহাঁটি পা করে নির্বাচনের পথ ধরে হাঁটছে। তবে সমস্যায় আছে গত নির্বাচনে অংশ না নেয়া ও নির্বাচন ভন্ডুল করতে চাওয়া বিএনপি। দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। তবে সেখানে বসেও তিনি দলীয় কর্মকান্ড মুক্ত নন। দলের শীর্ষ নেতা ও আইনজীবীদের সঙ্গে তিনি প্রায়শই বৈঠক করছেন কারাগারে। যা অভাবনীয়, অকল্পনীয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে লন্ডনে পলাতক জীবনযাপন করছেন। সেখান থেকে দলকে নির্দেশ দিচ্ছেন সরকার উৎখাতের আন্দোলন করার জন্য। কিন্তু সে আন্দোলন আর দানা বাঁধছে না। রমযান মাসে বিএনপি-জামায়াত জোট হুঙ্কার দিয়েছিল ঈদের পর সরকার পতনের এবং দলীয় নেত্রীর মুক্তির জন্য কঠোর আন্দোলন করার। ঈদ শেষ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। কিন্তু আন্দোলন আর হচ্ছে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ দিন দুয়েক আগে ঘোষণা দিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী দিয়ে সরকারের পতন সম্ভব নয়। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কর্মসূচী দেয়া হবে। ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর মতো আন্দোলন হবে। সেই কর্মসূচী সফল হবে বলে তিনি আশাও প্রকাশ করেছেন। এসবই অক্ষমের আত্মতৃপ্তি বলা যায়। ‘ঈদের পর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে’ বাক্যটি বেগম জিয়ার পছন্দের। কারাগারে যাওয়ার আগে গত নয় বছর ধরেই তিনি এই বাক্যটি প্রায়শই উচ্চারণ করতেন। কত ঈদ এলো-গেলো। কিন্তু আন্দোলন আর হয়নি। অবরোধ ও হরতালও ডেকেছিলেন। আর সেই কর্মসূচী পালনের নাম পেট্রোলবোমা মেরে দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা ও সহস্রাধিক নিরীহ জনগণকে দগ্ধ করেছেন। পুলিশ হত্যাও হয়েছে। কিন্তু সরকার পতন হয়নি; বরং গণরোষে সেই অবস্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই গণরোষের ভয়ে রাজপথে আন্দোলন করা দূরে থাক, মিছিল, সমাবেশও করতে পারছেন না। আসলে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাংগঠনিক ভিত্তিও দুর্বল। এই অবস্থায়ও তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নিচ্ছেন। আর সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে এখন দাবি তুলছেন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি। রাজনৈতিক কোন কারণে তিনি সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছেন, তা নয়। এতিম শিশুদের অর্থ আত্মসাত মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারাগারে রাজকীয় হালেই অবস্থান করছেন। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তরা কারাগারে যেসব সুবিধা পাওয়ার নয়, খালেদা তা পাচ্ছেন। সম্ভবত সরকারের বদান্যতার কারণে তিনি গৃহকর্মীকেও সঙ্গে রাখতে পারছেন। জেলে বসে দলও চালাচ্ছেন। যা অন্য কোন দন্ডিতের পক্ষে সম্ভব নয় কারাবিধি অনুযায়ী। বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি এমনটাও বলছে, বেগম জিয়াকে মুক্তি না দিলে তারা নির্বাচনে যাবে না। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য তারা এ কথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচনে না থাকার অন্য কোন কারণ তাদের কাছে নেই। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন ও তা ভ-ুল করার জন্য নাশকতার যে পথ তারা বেছে নিয়েছিল, তাতে হালে পানি পায়নি। এবার নির্বাচনে না এলে দলের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মনে করেন বিএনপি না এলেও নির্বাচন যথারীতি হবে। এবার বিএনপির জন্য অন্যরা অপেক্ষা করবে না। বহুদল অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অধিকার। সেজন্য নির্বাচন বন্ধ বা স্থগিত থাকতে পারে না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে যেখানে বিএনপি অংশ নিচ্ছে, সেখানে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেবার কোন কারণ নেই। কেন তারা ভয় পাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি করার জন্য বিএনপি নানা পথ ও পন্থা অবলম্বন করতেই পারে। যেমন করেছিল ২০১৪ সালে। আন্দোলনের নামে সহিংস পন্থা অবলম্বন তারা করতেই পারে। কিন্তু সে অবস্থা আর নেই। নানামুখী ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা তারা অব্যাহত রেখেছে বলা যায়। সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার যে পণ তারা নিয়েছে, তা থেকে সরেনি। নানা কলাকৌশলের আশ্রয় তারা নেবেই। বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এই পথ ও পন্থা বহাল রাখার জন্য নানা তৎপরতাও চালাচ্ছে। ভারতের কাছে নতজানুও হয়েছে। নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতা তারা চেয়েছে। কিন্তু ভারত মনে করে নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে তাদের কিছু করার নেই। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শও দিয়েছে তারা। কিন্তু সেটা ত্যাগ করা সম্ভব নয় দলটির পক্ষ থেকে। ভারত বিরোধিতা যে দলটির মূলমন্ত্র সেই তারাই সরকারের পতন এবং জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবার জন্য বিজেপির দ্বারস্থ হয়েছিল। অপরদিকে কানাডার আদালত আবারও বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে রায় দিয়েছে। বহির্বিশ্বে যার এই ভাবমূর্তি, তাদের একমাত্র সহায় হচ্ছে পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এই সংস্থাটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপিকে প্রচুর অর্থ দিয়েছিল। যা পাকিস্তানের সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিএনপির সামনে এখন শুধুই শর্ষেফুল। যেদিকে তাকায় সেদিকেই ধূ ধূ বালিয়াড়ি। মাথা উঁচু করে সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে দাঁড়াবার অবস্থাটুকু তারা হারিয়ে ফেলেছে। দুর্নীতির দায়ে মাতা-পুত্রের সাজা লাভ দলটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বাভাবিক পন্থা ছেড়ে বিএনপি যদি সংসদ নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে অরাজকতার বিস্তার ঘটাতে চায়, তবে দলটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। দলের মধ্য থেকে আরেকটি দল আত্মপ্রকাশ করতে পারে তখন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সত্তর বছরে পা রেখেছে। দলটির সাংগঠনিক অবস্থা খুব ভালো, তা নয়। দলে টাউট, বাটপার, লুটেরা, দুর্নীতিবাজের ভিড় জমেছে। রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকা লোকজন দলের নেতৃত্বে অবস্থান নিয়ে যেসব কর্মকা- চালাচ্ছেন, তাতে দলটিও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক জনপ্রতিনিধির আচার-আচরণ ও কর্মকা- এমন স্তরে যে, জনগণ তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। এদের কারণে দলের অনেক অর্জনও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলো অনেক স্থানেই নিয়ন্ত্রণহীন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শবিরোধী হয়ে এরা যা করছে, তাতে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথটি সুগম হবে বলে মনে হয় না। অনেক ধকল পোহাতে হবে, বিশেষ করে দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব। একাধিক প্রার্থীর কারণে নির্বাচন অনেক স্থানেই হবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা এসব অরাজকতা থেকে দলকে যত দ্রুত উদ্ধার করতে পারবেন, ততই মঙ্গল আসার সম্ভাবনা। বর্তমান সরকার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকছে। অক্টোবরে অর্ন্তবর্তী সরকার থাকবে ক্ষমতায়। তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। দেশবাসী প্রত্যাশা করে ক্ষমতায় যেই আসুক নির্বাচন যেন হয় স্বচ্ছ, অবাধ ও মুক্ত। নির্বিঘ্নে ভোটদান করার পরিবেশ সবার কাম্য। নির্বাচন কমিশন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করার মধ্য দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে করতে পারে সংশয়মুক্ত, অবাধ ও স্বচ্ছ। এ ক্ষেত্রে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ভোট জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
×