ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

‘বাংলাদেশের কিছু লোভী লোকের কবলে পড়েছে অর্থনৈতিক সেক্টর’

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৩ জুলাই ২০১৮

‘বাংলাদেশের কিছু লোভী লোকের কবলে পড়েছে অর্থনৈতিক সেক্টর’

কাগজ খুললেই শুধু জাল-জালিয়াতির খবর, অনিয়মের খবর, দুর্নীতির খবর। আরেক দিকে আছে ফুটবলের খবর। ফুটবলের খবরের ওপর আমার কোন মন্তব্য নেই। মন্তব্য নেই কারণ খেলার ‘পাবলিসিটি’, আর সিনেমা জগতের ‘পাবলিসিটি’ দেখতে দেখতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। ইদানীং দেখা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও যথেষ্ট পাবলিসিটি পাচ্ছে। কোম্পানির খবর, কোম্পানির মুনাফার খবর, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ নানা পদের কর্মকর্তাদের ছবির পাবলিসিটিও আজকাল যথেষ্টই হচ্ছে। কেউ কেউ নানা ধরনের সাফল্যের খবরও বিশেষ মর্যাদা দিয়ে প্রকাশ করছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ইদানীং ব্যাংকিং জগত সামনে চলে এসেছে। এই জগতের দুর্নীতির সুনীতি, অনিয়ম, অবিচার, লাভ-ক্ষতি, শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ, দক্ষতা-অদক্ষতা, মালিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, মালিকদের প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি বিষয় এখন মুখে মুখে আলোচিত। এরই ফাঁকে অনেক খবর হচ্ছে জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থপাচার ইত্যাদির ওপর। ধরা যাক, জুলাই মাসের ১১ তারিখের কাগজের কথা। আমি সব কাগজের কথা বলছি না। আমি বিবেচনায় নিয়েছি শুধু তিনটি অর্থনৈতিক কাগজ ও অর্থনীতির পাতা। একটার বড় খবর বিশাল এক কোম্পানির ওপর। কোম্পানিটিকে বাজারে সবাই চেনে। আমি বলছি না। তারা চামড়ার ব্যবসা করে। ঢাকায় তাদের বড় বড় ‘শোরুম’ আছে। কাঁচা চামড়া পাকা করে। তা রফতানি করে বিচিত্র পণ্যসামগ্রী আছে তাদের। ‘সুনাম’ দৃশ্যমান। এতদিন ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি যে, এই কোম্পানির ভেতরটা এত কালো। প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ। অভিযোগ টাকা পাচারের। কত টাকা? এক হাজার ১০৪ কোটি টাকা। কীভাবে পাচার করল? পাচারের ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত পথ হচ্ছে আমদানি ও রফতানি। কৌশল? কৌশল হচ্ছে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ এবং ওভার ইনভয়েসিং। না, তাদের ক্ষেত্রে এই পথ নয়। তারা রফতানি করেছে। কিন্তু রফতানির টাকা দেশে আসেনি, যা আনা বাধ্যতামূলক। রফতানি দেখিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে দাবি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রফতানি প্রণোদনা অর্থাৎ ‘ক্যাশ সাবসিডি’ তুলে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ওই টাকা আদায় করে নিয়েছে। ব্যাংকের কতিপয় কর্মচারী-কর্মকর্তার চাকরি গেছে। এখন খবর মোতাবেক ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) এই চামড়া কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই তদন্ত করেছে। চামড়া কোম্পানির এই গর্হিত অনিয়মের পর, জালিয়াতির পর আরেক খবর পাওয়া যাচ্ছে ভ্যাট ফাঁকির। শিরোনামে বলা হয়েছে সেবাকে রফতানি দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে... হেলথকেয়ার। এই খবরের নিচেই তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের একটি খবর। কর্মকর্তারা শ্রমিক সেজে মুনাফার অংশ নিচ্ছেন। আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা গত আট বছরে ৪৫৬ কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছে। ওপরে যে খবরগুলো দিলাম বিভিন্ন কাগজ থেকে সেখানে কোম্পানি আছে। তারা অনিয়ম করছে। জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি করছে। এখন যে খবরটি দেব তা খুবই চমকপ্রদ। একটি খবরে দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আছে ১১টি কোম্পানি। তাদের শেয়ার এখন ‘ওটিসি’ কাউন্টারে বেচাকেনা হয়। কিন্তু মজা হচ্ছে এসব কোম্পানির কোন অস্তিত্বই নেই। অর্থাৎ কাগজে কোম্পানি। অথচ বাজার থেকে পুঁজি তুলেছে। ঢাকা স্টক একচেঞ্জের খবর মোতাবেক তারা বাজার থেকে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে তুলেছে ৪২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এটাই ১১টি অস্তিত্বহীন কোম্পানির মোট শেয়ারের ফেসভ্যালু। কিন্তু এদের শেয়ার সর্বশেষ যে বাজার দরে বিক্রি হয়েছে তার মূল্য ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এসব কোম্পানিতে- বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ২০০ কোটি টাকা। অথচ এই কোম্পানিগুলো অস্তিত্বহীন। যে দৈনিকটি এই প্রতিবেদনটি করেছে তারা সরেজমিন কমপক্ষে ৬টি কোম্পানির ঠিকানাতে গেছে। এসব কোম্পানির কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর অর্থ কী? দেখা যাচ্ছে যেসব কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা আছে সেখানে হচ্ছে অনিয়ম। বোঝা গেল এদের ধরা যাবে। কিন্তু ‘কোম্পানিই’ নেই অথচ বছরের পর বছর ধরে কোম্পানির শেয়ার স্টক একচেঞ্জে বেচাকেনা হচ্ছে। এর দায়িত্ব কার। কাগজে দেখলাম সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশন বলেছে, এ ব্যাপারে তাদের কোন দায়িত্ব নেই। ঢাকা স্টক একচেঞ্জ বিষয়টি দেখবে! বোঝা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির অগ্রগতির পাশাপাশি দেশে কী হচ্ছে? কোম্পানি নেই, অথচ এরা তালিকাভুক্ত কোম্পানি। কোম্পানি করতে গেলে ‘মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন’, ‘আর্টিকেলস অব এ এ্যাসোসিয়েশন’ লাগে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি যেহেতু তাদের আছে ‘সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন’ এবং ‘সার্টিফিকেট অব কমেন্সমেন্ট।’ এগুলো দেয় ‘রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস এ্যান্ড ফার্মস।’ তালিকাভুক্তির জন্য ‘সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশনের’ অনুমতি, বাজার থেকে পুঁজি আহরণের জন্য কমিশনের অনুমতি লাগে। ‘চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্সি ফার্মের’ সার্টিফিকেট লাগে। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির জন্য স্টক একচেঞ্জের অনেক আনুষ্ঠানিকতা পূরণ করতে হয়। এতসব ফাঁকি দিয়ে অস্তিত্বহীন অর্থাৎ কাগুজে কোম্পানিগুলো কীভাবে বিনিয়োগকারীদের ২০০ কোটি টাকা লোপাট করল? যারা করল এরা কারা? যেহেতু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ জড়িত তাই এদের নাম উল্লেখ করছি : আমান সি ফুড, বাংলাদেশ ইলেকট্রিসিটি মিটার (ব্যামকো), চিক টেক্স, জার্মান বাংলা জেভি ফুড, এম হোসেন গার্মেন্টস, মেটালেক্স কর্পোরেশন, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনাল, রাঙ্গামাটি ফুড প্রোডাক্টস, রাসপিট ডাটা ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড টেলিকম, রাসপিট ইনক বিভি এবং সালেহ কার্পেট মিলস। এই এগারোটি কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ২০০ কোটি টাকা লোপাট করে বাজার থেকে বিলীন হয়েছে। তার মানে কী দাঁড়াল? যে সমস্ত কোম্পানির অস্তিত্ব আছে তারা জাল-জালিয়াতি করছে, আবার যাদের কোন অস্তিত্বই নেইÑ কাগুজে কোম্পানি তারাও জাল-জালিয়াতি করছে। দৃশ্যত উদ্দেশ্য এক : টাকা বানানো, পুঁজি গঠন। টাকা বানানোর ধান্দা সারাদেশকে আজ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। নীতি-আদর্শ, আইন-বিধি-নিয়ম কিছুই কাজে লাগছে না। যে যেভাবে পারে সেভাবে টাকা বানানোর কাজে ব্যাপৃত। বাজার অর্থনীতির এই উগ্র রূপ দেশের মানুষকে ক্রমে অসহায় করে তুলছে। ভাবা যায় অস্তিত্বহীন কোম্পানির শেয়ার স্টক একচেঞ্জে বেচাকেনা হয়। কোন বিচার-আচার নেই। এটি খুঁজে বের করেছে দৈনিক কাগজ। অথচ তা ধরার কথা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। তারা বলছে, এতে তাদের কোন দায়িত্ব নেই। এই ফ্রি-ফর-অল দেখেই সম্ভবত ‘এফবিসিসিআই’-এর সাবেক একজন সভাপতি বলছেন, ‘বাংলাদেশের কিছু লোভী লোকের কবলে পড়েছে অর্থনৈতিক সেক্টর। তাদের যে কত টাকা দরকার এটি নিজেরা নির্ধারণেও সক্ষম হননি। আরও চাই, আরও চাই। সবকিছু পেতে চাই। এমন কিছু লোকের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।’ যিনি এ কথাগুলো বলেছেন তিনি এই মুহূর্তে একটা বেসরকারী ব্যাংকের বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ, তিনি এই মুহূর্তে অর্থনীতির একটা বড় রোগ ধরেছেন। এর নাম লোভ। দেশের উন্নতি হচ্ছে অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে। বছরে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু প্রাগ্রসর এই অর্থনীতি ক্রমেই লোভী, অতিলোভী লোকদের খপ্পরে পড়ছে। তারা বাজার অর্থনীতির কারণেই টিকছে, বড় হচ্ছে। অথচ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তারা বাজার অর্থনীতির সর্বনিম্ন নিয়ম-কানুনগুলো মানতে চাইছেন না। ফলে অর্থনীতি একটা বড় ধরনের সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একচেটিয়া ব্যবসার জন্ম হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত পড়েছে সঙ্কটে। ‘আমানতের’ অভাব, অথচ সমানে ঋণ দেয়া হচ্ছে। তাও যাকে-তাকে। এই মিসম্যাচ ইতোমধ্যে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। শুধু এই খাত নয়, দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী টাকা সব পাচার করে দিচ্ছে। নিবন্ধের শুরুতেই একটি চামড়া কোম্পানির কথা উল্লেখ করেছি। চোখের সামনে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দেশের এক শতাংশ লোক-প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজন আগে পাঠাচ্ছে। দেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ল, অথচ দেশের মাথা অর্থাৎ এক শতাংশ লোক দেশ ছেড়ে পালাল তাহলে এই দেশের অর্থ কী? চারদিকের এই অবস্থা দেখে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, অশান্তির সৃষ্টি হয়। লোভ, অতিলোভকে সীমার মধ্যে না আনতে পারলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×