ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নারীবান্ধব থাইল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৩ জুলাই ২০১৮

নারীবান্ধব থাইল্যান্ড

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ থাইল্যান্ড। সমুদ্র পরিবেষ্টিত এই দ্বীপটি যেমন প্রকৃতির অবারিত বৈভবে সমৃদ্ধ পাশাপাশি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এবং শিল্পোন্নত দেশ হিসেবেও বিশ্বসভায় নিজের স্থান মজবুত করেছে। অভ্যন্তরীণভাবে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সমান তালে এগিয়ে গেছে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেশটির অগ্রযাত্রা আজ বহুল আলোচিত, প্রশংসিত এবং সময়ের দাবি পূরণের এক অনবদ্য সম্ভাবনাময় দেশ। রাজা পুরো দেশটির কর্ণধার হলেও গণতন্ত্রের চর্চায় নির্বাচন ব্যবস্থার সুসংগঠিত রূপ বিশেষভাবে দৃশ্যমান। সবচেয়ে ভিন্নমাত্রার যে বৈশিষ্ট্য দেশটিকে ব্যতিক্রমী অবস্থানে পৌঁছে দেয় তা হলো অর্ধাংশ নারী জাতির স্বাধীনতা, অধিকার সচেতনতা সর্বোপরি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের এক অপার সম্ভাবনার চমৎকার অভিযোজন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নারী ঘনিষ্ঠ এই দেশটিতে প্রথম মহিলা ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশটির ক্রমবিবর্তনের ধারায় অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হলেও কখনও বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর কাছে পদানত হয়নি। সেই পুরাকাল থেকে স্বাধীন থাকা এই দ্বীপটি আজও নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে সব ধরনের মৌলিক অধিকার ভোগ করাই শুধু নয় একটি উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের সম্মানও মর্যাদার রোল মডেল বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। সমুদ্র এবং নদ-নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই দেশটির মধ্যম অঞ্চল উর্বর পলিমাটির দ্বারা সমৃদ্ধ সমতলভূমি। ফলে কৃষি সভ্যতার উৎকর্ষতায় দেশটিকে শস্যভা-ারের অঞ্চল হিসেবেও অভিষিক্ত করেছে। একসময় বিশ্বে চাল রফতানিকারী দেশের মধ্যে থাইল্যান্ডের স্থান ছিল একেবারে শীর্ষে। বর্তমানে সেই অবস্থান কিছুটা নেমে আসলেও কৃষিপণ্য সরবরাহের এই ধণাঢ্য দেশটি আজও খাদ্যশস্যের আঙিনায় নিজেদের আধিপত্য অবারিত করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত থাইল্যান্ডই একমাত্র দেশ যেখানে নারীরা নির্ভয়ে, নির্বিঘেœ এমনকি নিরাপদে অবস্থান করছে। অর্ধাংশ নারী জাতি কর্মক্ষেত্রেও সমান অংশীদারিত্ব বজায় রেখেছে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে থাই নারীর সম্পৃক্ততা সে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সময়োপযোগী ভূমিকা সত্যিকার অর্থে বিমুগ্ধ এবং অভিভূত হওয়ার ব্যাপার। কর্মক্ষেত্র মানে শুধু চাকরি নয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পোদ্যোক্তার ভূমিকায়ও থাই নারীরা অনেকখানিই এগিয়ে। বিমানের পাইলট, ক্রুর, স্বাগত কর্মী, এয়ার হোস্টেজ থেকে শুরু করে আধুনিক উন্নত তথ্যপ্রযুক্তিতে থাই নারীর সফল অভিগমন অভিনব এবং চমকপ্রদ। আর বড় বড় শপিংমলের বিক্রেতা থাই নারীদের কর্মোদ্দীপনার শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয় অগ্রগতির অন্যতম নিয়ামক শক্তিও বটে। ক্রেতা সাধারণের আকর্ষণ বাড়াতে তাদের যে পরিমাণ কর্মদক্ষতা, সৌজন্যবোধই শুধু নয় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও নজর কাড়ার মতো। একইভাবে বিভিন্ন অতিথি ভবন এবং আবাসিক হোটেলে ও থাই নারীদের সময়ের দাবি মেটানো সে দেশের আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর একটি প্রত্যাশিত কর্মবহুল উন্নয়ন খাত। পরিবর্তিত সময়ের দ্রুততার মিছিলে থাই নারীরা যেভাবে নিজেদের নিরলস কর্মযজ্ঞকে অবারিত করছে সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়ার সিংহভাগ দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং উত্ত্যক্তকরণের যে অপসংস্কৃতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান থাইল্যান্ডে একেবারেই বিপরীত আবহ। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের অনেক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকলেও নারীর স্বাধীনচেতা জীবন এবং কর্মপ্রবাহ দেশটির উন্নয়ন অভিযাত্রার একটি অনবদ্য, সফল সংযোজন। নিরীহ, নির্বিরোধী, শান্তিকামী জনগোষ্ঠী যে কোন দেশের অমূল্য সম্পদ। আর প্রকৃতিগতভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারীরা যদি তাদের সম্মান, মর্যাদা আর মৌলিক অধিকার নিয়ে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করতে পারে তাহলে সে দেশে অর্ধাংশ এই গোষ্ঠী কতখানি নিজেদের অধিকারকে সংরক্ষিত করে সেটা বলাইবাহুল্য। সময়ের নির্ভীক পথিক এই থাই নারীরা নিজেদের সম্পর্কে এতই সচেতন যা তাদের ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতার মূল নিয়ামক শক্তি। পুরো জনগোষ্ঠী কর্মজীবীর যে পরিসংখ্যান তাতে থাই নারীরা প্রায়ই সমান ৪৭%, যা উন্নত যে কোন বিশ্বের তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে। তবে যে সমাজে এমনতর নারী প্রগতির ক্রমবিকাশ সেখানে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনাও যে ঘটে না তা কিন্তু নয়। সমাজবহির্ভূত কিছু অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা নারীকে কেন্দ্র করে সেটাও প্রকটভাবে দৃশ্যমান। তবে এসবের পেছনে কোন জবরদস্তিমূলক ঘটনাপ্রবাহ নেই। পর্যটন শিল্পের ক্রমবিকাশমান এই দেশটিতে নারীরা স্বইচ্ছায়, নিজেদের তাগিদে ভ্রমণকারীদের মনোরঞ্জনে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এটাই এখন সে দেশের নারীদের জন্য একটি ভিন্নমাত্রার কর্মোদ্দীপনার অভিনবপন্থা। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে পরিবার থেকেও এই ধরনের কলগার্লদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ থাকে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন হোটেল, শপিংমল এবং দর্শনীয় স্থানে থাই নারীরা সেজেগুজে অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে নিজেদের আকর্ষণীয় করে পর্যটকদের মন ভোলাতে ব্যস্ত থাকে। অবস্থাপন্ন ঘরের সুন্দরী কন্যা কিংবা বধূরা কোন পাবিবারিক ঝামেলা ছাড়াই তাদের এই ধরনের বিকল্প কর্ম জীবনকে চালিয়ে নিতে পারে। যা সে দেশের পর্যটন শিল্পে বৈদেশিক আয়ের একটা বিরাট উৎস। এ নিয়ে সমাজে কোন কোলাহল নেই, হৈচৈয়েরও কোন ধরনের আভাস পাওয়া যায় না। অন্যান্য পেশার মতো স্বাভাবিক নিয়মেই এই অন্যরকম কর্মজীবনকে মেনে নেয়া হচ্ছে। তবে দেশে না হলেও অন্য দেশ থেকে এই ধরনের আপত্তিকর কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ ওঠে। তখন সরকারকে সাময়িকভাবে হলেও এর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হয়। এই ধরনের কর্মযজ্ঞের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। কিন্তু পুরো পরিস্থিতির ওপর কোন রকম প্রভাব পড়ে না। প্রাত্যহিক জীবনে যথানিয়মে যা ঘটার তার ব্যতিক্রম কিছুই হয় না। তবে বলা হয় পর্যটন খাতের এই এক অনিবার্য পরিণতি যা আইনানুগ না হয়েও অলিখিত বৈধ পেশা হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায়ও থাকে না। এর পরও সে দেশের নারীদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধি, স্মার্টনেসই শুধু নয় আধুনিক বিশ্বকে আয়ত্তে নিয়ে এসে নিজেদের যুগোপযোগী করে তোলা নতুন সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণের এক অনবদ্য প্রয়াস ভাবা যেতে পারে।
×