ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সাহিত্য-সংস্কৃতির সূতিকাগার বিউটি বোর্ডিং

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ১৩ জুলাই ২০১৮

সাহিত্য-সংস্কৃতির সূতিকাগার বিউটি বোর্ডিং

সেদিন মে দিবসের ছুটি। ভাবলাম ছুটির দিনটাকে কাজে লাগানো যাক ঘোরাঘুরিতে। বেশ কিছু দিন ধরে কাজের চাপ গিয়েছে ভীষণ রকম শুক্র, শনিবারেও অফিসের কাজ করতে হয়েছে। তাই কোথাও ঘুরতে যেতে মন খুব চাইছিল। আর তাই মনে মনে সময় বের করার চেষ্টা করছিলাম। যান্ত্রিক জীবনে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় যে যাব তাই বের করতে পারছিলাম না। এর আগে একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রল করতে করতে একটা ভিডিও চোখে পড়ল। নিচে ক্যাপশনে ছোট্ট করে লেখা ‘বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস’। সেই সময় অফিসে খুব একটা কাজ না থাকায় চট করে দেখে ফেলেছিলাম ভিডিওটি। ভিডিওটিতে বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান মালিক তার মুখে বর্ণনা করছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ের পুরো ইতিহাস। আমার আবার ঐতিহাসিক স্থাপনাতে দেখার শখ বেশি। ইতিহাস জেনে আমার তখন একবার গিয়ে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছিল জায়গাটা। পুরান ঢাকা! এইটা তো কাছে হবে আমার অস্থায়ী ডেরা থেকে। যাত্রা পথের সন্ধান জানতে সেই দিনই ফোন দিয়েছিলাম চিন্টু কে। চিন্টুর ভাষ্য মতে খুব একটা দূরে না আমার অস্থায়ী ডেরা থেকে বিউটি বোর্ডিং। পরের সপ্তাহের শুক্রবারে প্ল্যান করছিলাম ঘুরতে যাব কিন্তু বিধিবাম অফিসের কাজ পরে যাওয়ার জন্য আর যাওয়া হলো না। শেষ পর্যন্ত মে দিবসের ছুটিতে আমরা বের হলাম গন্তব্য বিউটি বোর্ডিং ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল ১০টা বাজি বাজি। আমরা ত্রিচক্রযানে করে এগিয়ে চলছি আমাদের গন্তব্য পানে। রাস্তাঘাট আজ বেশ ফাঁকা নেই কোন যানজট। তবে আকাশের আজ মন ভাল নেই কেন জানি মন গোমরা করে রয়েছে। বাংলা বাজারে ১ নং শ্রীশদাস লেন গলিটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে বাঙালীর শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার সেই কেন্দ্রটি। আমার তখন বিশাল কিছু আবিষ্কার করে ফেলার মতো আনন্দ লাগছিল। আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী চিন্টু এগিয়ে যেতে লাগলাম বিউটি বোর্ডিংয়ের দিকে। বিউটি বোর্ডিংয়ের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ থাকায় জায়গাটির ইতিহাসের সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে গেল আমার। আমরা গলিটাতে ঢুকে এগিয়ে গেলাম ভেতরে। ছোট্ট গেইট, মাথার ওপর মাঝারি আকারের সাইনবোর্ডে লেখা বিউটি বোর্ডিংয়ের নাম। প্রথমেই চোখে পড়ল পাশের জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা বিশাল উঁচু দেয়াল। তারপর চোখ পড়ল সামনের ছোট্ট বাগানটির ওপর। দেখা পেলাম বেশ কয়েকজন প্রবীণ মিলে গল্প করছেন। তাদের কথায় অনুমেয় হলো যে তারা কোন স্কুল জীবনে বন্ধুদের একটি গ্রুপ। দেখলাম তারা বেশ আড্ডা ফুর্তিতে মেতে উঠেছেন। এদিকে আমি নতুন গন্তব্যের স্মৃতি কে ধরে রাখার জন্য একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। আমার ছবি তোলা দেখে তাদের মাঝে থেকে এগিয়ে এলেন। কোথায় থেকে এসেছি জানতে চাইলেন। আমার পরিচয় দেয়ার পর খুব খুশি হলেন। উনি ও বললেন তাঁর ও পুরনো দিনের ইতিহাস নিয়ে জানার খুব অগ্রহ। উনার নাম জানতে চাইলে বললেন আমি জাফর তামাম, আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী ইকবাল আরিফ, জাকির হোসেন, সমর। আমরা প্রতি ছুটির দিনেই চেষ্টা করি স্কুল জীবনের বন্ধুরা কিছু সময় একত্রে কাটতে। সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলোতে ফিরে যেতে হাসি ঠাট্টায় একাকার হয়ে যেতে। আমি আর চিন্টু ওনাদের সঙ্গে ছবি তুললাম। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হলো, জগন্নাথ কলেজে পড়তেন তিনি যখন প্রথম বিউটি বোর্ডিংয়ে উঠেছিলেন। এখনও যে কোন কাজে ঢাকা এলেই সব ফেলে এখানে এসে ওঠেন। জানালেন তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে পুরনো এই বোর্ডিংয়ে। আমরা যখন দোতলায় ঘুরে দেখছিলাম তখন নিচে রান্না প্রায় শেষ। খাবারের ঘ্রাণে আমাদের ইন্দ্রীয় জানান দিল ক্ষুধাটা জোরদার। তাই ছবি তোলার পাট চুকিয়ে সবাই দ্রুত নেমে গেলাম নিচে। দুপুরের খাবারের মেন্যুটা চেক করে বসে পড়লাম। বিশাল স্টিলের থালায় খাবার দেয়া হয় এখানে। আমি এত বড় থালায় এর আগে খাইনি কখনও। সবকিছু জুড়েই তাই খানিক কৌতূহল ও উত্তেজনা। আমরা খাবার নিলাম সাদা ভাত, সবজি, তিতা ডাল (বিউটি বোর্ডিংয়ের স্পেশাল মেন্যু তিতা ডাল), মাছ ভর্তা। খুব সাধারণ খাবার, তবে স্বাদের দিক থেকে ছিল অসাধারণ। বাসার বাইরে খেয়ে যেমন কিছুটা অযতœ খুঁজে পাওয়া যায় খাবারে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না এখানে, বরং মনে হয়েছে এখানের লোকজন বেশ যতœ নিয়েই রাঁধেন। খাওয়া শেষে বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান মালিক তারক সাহার সঙ্গে কথা হলো। ভিডিওটিতে তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস। তার বাবা প্রদাহ চন্দ্র সাহা বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। প্রথমে এটি ছিল একটি জমিদার বাড়ি। দেশভাগের আগে এখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় চলে যাওয়ার পর তারক সাহার বাবা ও তার এক ভাই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বোর্ডিংটি। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানী আর্মিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন প্রহাদ চন্দ্র সাহাসহ আরও ১৭ জন। সেই সময় প্রদাহ চন্দ্রের পরিবার জীবন বাঁচাতে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে প্রদাহ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা তার দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন। বর্তমানে তারা দুই ভাই মিলে চালাচ্ছেন বোর্ডিংটি। বোর্ডিংটির নাম রাখা হয় বর্তমান মালিকের চাচাতো বোন বিউটির নামে। সেই বিউটি এখনো বেঁচে আছেন শুনে আমরা তাকে দেখার জন্য আগ্রহবোধ করছিলাম, তবে কয়েক সেকেন্ড পরেই জানলাম তিনি এখানে থাকেন না। থাকেন দেশের বাইরে। বিউটি বোর্ডিং চালুর কয়েকদিন আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিউটি। সবার আদুরে সেই কন্যাটির নামেই আজকের ইতিহাস ঘেরা বিউটি বোর্ডিং। তবে আগের অনেক কিছুই নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। আগে শাকাহারিদের জন্য আলাদা রান্নার ঘর ছিল, তাদের খাওয়ার জায়গাও ছিল আলাদা। সেসব রান্না আলাদা লোকজনই করত। ছিল কফির জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আড্ডা দেয়ার জন্য আরও রমরমা আয়োজন। সেসবের কিছুই আর নেই। নতুন করে শুরু করাও হয়নি তাদের। মনে মনে ভাবছিলাম কি রমরমা আড্ডাই না হতো সে সময়ের বিকেলগুলোতে! বহু কবিতার জন্ম নিশ্চয়ই হয়েছে এখানে! চা খেতে খেতে কবিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা! নিশ্চয়ই গানের সুর ছড়িয়ে যেত গলিটায়! আমার সেসব নিজ চোখে দেখা হয়নি। তবে সেই ইতিহাস, আবেগে ভরা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল সবই যেন দেখতে পাচ্ছি খুব স্পষ্টই! যেভাবে যাবেন গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে খুব সহজেই বাস বা রিকশায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাবাজারের বইপাড়ায় চলে আসতে পারেন। এতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন হবে না আপনার। সেখানে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে বিউটি বোর্ডিং।
×