ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লেনিনের দেশে প্রথম বিশ্বকাপে এক ঝাঁক উদ্বাস্তুর লড়াই

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১৪ জুলাই ২০১৮

লেনিনের দেশে প্রথম বিশ্বকাপে এক ঝাঁক উদ্বাস্তুর লড়াই

অনলাইন ডেস্ক ॥ স্যামুয়েল উমতিতির গোলে যখন ফ্রান্স ফাইনালে উঠছে তখন প্রেসবক্সে বেলজিয়ামের এক সাংবাদিক তীব্র ক্ষোভে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘ক্যামেরুনের লোকটা দিদিয়ে দেঁশকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল এ বার।’’ ইংল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ চলার সময় লুঝনিকি স্টেডিয়ামের ভাসমান প্রেস সেন্টার থেকে এক ইংরেজ সাংবাদিক রেডিওতে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন নাগাড়ে। হঠাৎ তিনি বলেন ‘‘লুকা মদ্রিচ ফাইনালে তুলে দিল দলটাকে। ও দৌড়োচ্ছে ক্রোয়েশিয়া সমর্থকদের কাছে। যারা ওকে জেলে পুরতে চেয়েছিল।’’ ইংল্যান্ডের সমর্থক ওই ধারাভাষ্যকার স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় যা বলে ফেললেন সেটা তো সত্যিই। স্লাভদের গৃহযুদ্ধের সময় ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান অধিনায়ককে চুক্তিতে ভুল তথ্য দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। দিনের পর দিন আদালতে গিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করতে হত লুকা মদ্রিচকে। যা ছিল যন্ত্রণার। অপমানের। তাঁকে জেলে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল। ম্যাচের পর ইংল্যান্ডের এক সাংবাদিক প্রসঙ্গটা তুলতে গিয়েছিলেন মিক্সড জোনে। এমন কড়া চোখে তাকিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের মিডিয়ো যে, ওই সাংবাদিক চুপসে যান। অলিম্পিক্সে প্রতিযোগী দেশগুলোর বাইরেও একটা দল থাকে। সম্বলহীন আধপেটা বা দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের টিম। জাতি দাঙ্গা, দেশ বনাম দেশের যুদ্ধে প্রাণ বাঁচিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসা প্রতিভাবানদের বঞ্চিত করে না অলিম্পিক্স সংগঠকরা। সেই প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া বস্তিতে যান কোচেরা। যোগ্যদের তুলে এনে ট্রেনিং দেন। নামান বিভিন্ন ইভেন্টে। ব্রাজিলের রিয়ো অলিম্পিক্সের সময় কথা বলতে গিয়ে দেখেছি তাঁদের যন্ত্রণা। অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার জীবন-মৃত্যু ছবি। কেউ চার-পাঁচ দিন সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে ভেলায় ভাসতে ভাসতে বেঁচে ফিরেছেন। রাস্তায় হারিয়েছেন স্বামী, সন্তান বা বাবা-মাকে। কারও চোখের সামনে তাঁর বাবাকে গলা কেটে খুন করা হয়েছে। কঙ্গো, সিরিয়া, সার্বিয়া, ইজরায়েল, মায়ানমারের মতো দেশ থেকে অন্ধকারে থাকা মানুষগুলোকে অলিম্পিক্সের চোখ ধাঁধানো আলোর জগতে এসে বিব্রত, লাজুক দেখায়। বিশ্বকাপে কোনও উদ্বাস্তু দল খেলার নিয়ম চালু হয়নি এখনও। বিশ্বের সব চেয়ে ধনী ক্রীড়াসংস্থা ফিফা এখনও তা নিয়ে ভাবেনি। তাঁরা খেলেন বিভিন্ন দেশের হয়ে। জন্মসূত্রে আলজিরিয়ান জ়িনেদিন জ়িদান খেলেছিলেন ফ্রান্সের জার্সি গায়ে। দিদিয়ে দেশঁর যে দলটা আজ শুক্রবার মস্কো থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে অনুশীলন করল, সেই দলের তারকা ফুটলারদের বেশির ভাগেরই তো ধাত্রীগৃহ আফ্রিকার কোনও না কোনও দেশ। ২৩ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৪ জনই আফ্রিকার। কারও বাবা-মায়ের জন্ম কঙ্গো বা ক্যামেরুনের মতো কোনও দেশে। ফ্রান্সের যে দলটা সেমিফাইনালে বেলজিয়ামকে হারাল সেখানে স্ট্রাইকার আঁতোয়া গ্রিজম্যান, অলিভয়ের জিহু এবং গোলকিপার হুগো লরিস ছাড়া প্রায় সবাই অন্য কোনও না কোনও দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। গোলদাতা উমতিতির জন্ম ক্যামেরুনে, মাঝমাঠের ব্লেজ মাতুইদির বেড়ে ওঠা অ্যাঙ্গোলায়, সোনার বলের দাবিদার কিলিয়ান এমবাপ্পের বাবা ক্যামেরুনের, মা আলজিরিয়ার। পল পোগবার ফ্রান্সে জন্ম হলেও তাঁর মা-বাবা গিনির নাগরিক ছিলেন এক সময়। দেশঁর দলের মাঝমাঠের স্তম্ভ এনগোলো কঁতের জন্ম ফ্রান্সে। কিন্তু তাঁর বাবা-মা দু’জনেই মালির বাসিন্দা ছিলেন। বদলি ফুটবলার হিসাবে পরে মাঠে নামা ফ্রান্সের উসমান দেম্বেলের বাবা মালির বাসিন্দা। মা ফরাসি। ক্রোয়েশিয়ারও একই অবস্থা। ক্রোয়েশিয়ার তারকা ফুটবলার ইভান রাকিতিচের জন্ম সুইৎজারল্যান্ডে। এক উদ্বাস্তু শিবিরে। দলের অধিনায়ক লুকা মদ্রিচের জীবন তো আরও দুর্বিসহ। তাঁর ঠাকুর্দাকে প্রকাশ্যেই খুন করেছিলেন একদল দাঙ্গাবাজ। রাতারাতি ছোট্ট লুকা মদ্রিচকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন আজকের নায়কের বাবা। তাঁদের বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রেনেড মেরে। পালিয়ে এসে একটা বস্তির ঘরে ঠাঁই হয়েছিল মদ্রিচ পরিবারের। খাওয়ার জল জুটত না। আলো ছিল না বাড়িতে। লুকার বাবা একটি বস্ত্র কারখানায় মজুরের কাজ করতেন। একটা ঘরে থাকতেন সাত জনের মদ্রিচ পরিবার। অর্ধেক দিন খাবার জুটত না। যন্ত্রণার লাভাস্রোত আর বঞ্চনার জীবন নিয়ে বেড়ে ওঠা সেই লুকা এখন বিশ্ব ফুটবলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর দশ নম্বর জার্সি এখানকার ক্রোয়েশিয়ায় সমর্থকদের নব্বই শতাংশের গায়ে। জাগ্রেবের রাস্তায় মিছিল হয়েছে তাঁর ছবি নিয়ে। ফুটবলের রাজসূয় যজ্ঞে তো শুধুই আলো আর আলো। সেখানে অন্ধকারের কোনও জায়গা নেই। হার বা জিতের সরু সুতোর উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে হাসি-কান্না। আবেগ, উচ্ছ্বাস রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে কাকে ফকির করবে, কাকে আগামী চার বছরের জন্য রাজ সিংহাসনে বসাবে কেউ জানে না। কিন্তু একটা কথা বলাই যায়, জীবনযুদ্ধে জিতে আসা ফ্রান্স বা ক্রোয়েশিয়ার এক ডজন ফুটবলার লড়াইয়ের মুখ হয়ে নামবেন লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। লেনিনের দেশে প্রথম বিশ্বকাপে এক ঝাঁক উদ্বাস্তুর লড়াইয়ের ছবিটাই রাশিয়ার বড় প্রাপ্তি। যা সাধারণত ফাইনালে দেখা যায় না। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×