ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৭ জুলাই ২০১৮

 নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য

নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়Ñ এ গভীর উপলব্ধি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর নারী সমাজের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন বাহাত্তরের অনন্য সংবিধান। যা কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেনি; অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে নারী-পুরুষের মর্যাদা সমুন্নত করেছে। বর্তমান সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে চলমান দশটি কর্মসূচীর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন একটি। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা নির্ধারণে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ৪টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে নারীর সামর্থ্য উন্নীতকরণ, নারীর অর্থনৈতিক প্রাপ্তি বৃদ্ধিকরণ, নারীর মতপ্রকাশ ও মতপ্রকাশের মাধ্যম সম্প্রসারণ এবং নারী উন্নয়নে পরিবেশ সৃষ্টিকরণ। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকার এবং সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তি নারী সমাজের অগ্রযাত্রার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই অগ্রযাত্রার মাঝেও নারী উন্নয়নে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে দেশে। এখনও ঘর থেকে বের হলেই নিরাপত্তাহীন তাঁরা। তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানোর সিঁড়ি খুঁজে পাবে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। সরকারের গত ৯ বছরের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বর্তমানে দেশে নারী শিক্ষার হার ৫০ দশমিক ৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ছাত্রছাত্রীর প্রায় ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৪ শতাংশ, এইচএসসি পর্যায়ে ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ ছাত্রী। বিগত সময়ের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য ও জিপিএ-৫ অর্জনের দিক থেকেও নারীরা এগিয়ে রয়েছে। শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নারীদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে একজন নারীও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে না। শিক্ষায় নারীর অগ্রযাত্রা সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করবে এবং দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পিছিয়ে থাকা নারীরা আজ জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার। নারীশিক্ষার হার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯ নম্বরে। নারী উন্নয়নে সার্বিক সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশ ৬৪তম অবস্থানে থাকলেও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরেই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের ৩৬টি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসেবে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৫-তে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের নাম। দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৭ অনুসারে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ছিল ৪৭তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন দেশের চেয়ে ভাল অবস্থান নির্দেশ করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস চ্যুহাব নারী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টের ভূমিকায় বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের মেধাই মূল চালিকাশক্তি। যদি এই মেধার অর্ধেকই অপরিপক্ব বা অব্যবহৃত থাকে, তাহলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। এ ছাড়া, নারীর ক্ষমতায়ন একটি মৌলিক বিষয়। তাঁরাও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উপার্জন ক্ষমতা ও রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার রাখেন। প্রতিবেদন মতে, নারীশিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বজুড়ে নন্দিত। প্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিশু ভর্তির হার বিবেচনায় বিশ্বে এ দেশের অবস্থান আরও ৬২টি দেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে প্রথম। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষায় অনেক পিছিয়ে নারী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১১৯ নম্বরে। নারী উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নারী উন্নয়ন ও সমতার লক্ষ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (MDG) ও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের (NSAPR) আলোকে নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নকল্পে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। নারীবান্ধব আবাসিক/অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বৃত্তিমূলক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী দুস্থ ও অসহায় এবং শারীরিকভাবে অক্ষম মহিলাদের উন্নয়ন স্থায়িত্বের জন্য খাদ্যশস্য ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচী, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, গ্রামের দুস্থ, প্রান্তিক, দলিত, আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় গ্রামভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতায় একটি ভাউচার প্যাকেজের মাধ্যমে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত জনগোষ্ঠীকে তিনটি প্রসবপূর্ব চেকআপ, দক্ষ দাইয়ের অধীনে নিরাপদ জন্মদান, একটি প্রসব পরবর্তী চেকআপ এবং যাতায়াত খরচ প্রদান। মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গ্রহণ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কর্মসূচীর আওতায় ৭টি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার স্থাপন, দরিদ্র স্বল্পশিক্ষিত বেকার মহিলাদের আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ প্রদান, চাকরি-বিনিয়োগ তথ্য কেন্দ্র স্থাপন, ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কর্মসূচী, ডে-কেয়ার সেন্টার, ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত করে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে কিশোরীদের ক্ষমতায়ন কর্মসূচী, মহিলা, শিশু ও কিশোরীদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র, ই-সার্ভিস কর্মসূচী, জয়িতা-হালুয়াঘাট বিপণন কেন্দ্র, তৃণমূল পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, অসহায়, দুস্থ নারীদের আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, কর্মরত মহিলা গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসনের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় হোস্টেল নির্মাণ, নির্যাতিত নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য মহিলা হোস্টেল নির্মাণের মতো বহুমুখী কর্মসুচী বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়াও দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র সংগঠনের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিপণন ও বাজারজাত করণের সহায়তায় নারীবান্ধব উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াসÑ জয়িতা এবং অঙ্গনা পরিচালিত হচ্ছে। ট্রেনিং ফর ডিজএডভানটেজ ওমেন অন রেডিমেট গার্মেন্টস (আরএমজি) প্রকল্প, শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি, কম্পিউটার, টেইলরিং, ব্লক ও রুটিক, বিউটিফিকেশন, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং ট্রেডে মহিলারা প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আধুনিক পদ্ধতিতে হাউস কিপিং এ্যান্ড কেয়ার গিভিং এবং বিউটিফিকেশন কোর্সে তাত্ত্বিক ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিরূপে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রশিক্ষণার্থীরা নিরাপদ আবাসন সুবিধায় হাতে কলমে নারীবান্ধব পরিবেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাগেরহাট, মহিলা হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দিনাজপুর, মা ফাতেমা (রা:) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্স, সারিয়াকান্দি, বগুড়া, মহিলা হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রাজশাহীসহ এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিরাপদ আবাসিক সুবিধায় বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের নারী সমাজকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ গ্রাম-শহরে নারীর কর্মজীবনকে দৃশ্যমান করেছে। দেশের আয়বর্ধক কর্মকা- তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী সমাজের অংশগ্রহণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে কম সুযোগ পাওয়া নারীর জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনি পরামর্শ সহজলভ্য হওয়ার কারণে নারীর জীবনযাত্রার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ৯ অক্টোবর ২০১৭ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত তথ্যানুসারে ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তির ৭ শতাংশ ছিল নারী। বর্তমানে তা বেড়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল ভিশন হলো এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে নারী ও পুরুষ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র সমান সুযোগ ও অধিকার লাভ করবে এবং সব মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে কোন ধরনের লিঙ্গ বৈষম্য থাকবে না। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দুটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করেছে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন-২০১০, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা বিধিমালা-২০১৩, ডিএনএ আইন ২০১৪ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে মাইলফলক হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণ করেছিলেন। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যার ফলে স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিল। পরবর্তীতে সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০টি উন্নীত করা হয়েছিল, যারা মূলত নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতেন। ২০০৪ সালের মে মাসে সংবিধানের (চতুর্দশ সংশোধন) আইন, ২০০৪ প্রবর্তন করে পরবর্তী দশ বছরের জন্য পঁয়তাল্লিশটি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধান করা হয়েছিল। ৩ জুলাই, ২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছিল। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ ১০ বছর। যা চলতি সংসদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে। এ জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে এই মেয়াদ আরও ২৫ বছর বৃদ্ধি করে আইন পাস করা হয়েছে। বর্তমানে সংসদে ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন, যার মধ্যে ২২ জন সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়াও প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমুহের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ১২ হাজারের বেশি নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে উদার গণতন্ত্র এবং বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এখনও কোন নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। অথচ বহু আগেই দেশ পরিচালনায় নেতৃত্বে এসেছেন বাংলাদেশের নারী সমাজ। গত ২৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে আসছেন নারী। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দলের নেতাও নারী। জাতীয় সংসদের উপনেতা, স্পিকার, একাধিক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, রাষ্ট্রদূত, বিচারক, ডিসি, ব্যাংকের এমডির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করছেন নারীরা। আমাদের সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনীতেও নারীরা অবদান রাখছেন। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদায় কাজ করছেন মোট ৭৭ জন কর্মকর্তা। শুধু প্রশাসনেই নয়, এমন কোনও খাত নেই যেখানে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন না। দেশের সবখানেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরা যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বে অন্য কোন দেশে রাজনীতিতে নারীর এত উচ্চাসন নেই। এর স্বীকৃতি ও মিলেছে বিশ্বজুড়ে। নারী উন্নয়ন ও সমতার লক্ষ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (গউএ) ও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের (ঘঝঅচজ) আলোকে নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নকল্পে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ মহিলাবিষয়ক অধিদফতরে ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ও উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য জাতীয় বাজেটে নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা বরাদ্দ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথমে চারটি মন্ত্রণালয়ের জন্য জেন্ডার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছিল, ওই বছর নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫৪ হাজার ৩০২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫৯ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, যা মোট জাতীয় বাজেটের ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার সমন্বিত বাজেট বরাদ্দসহ ১০০ কোটি টাকার প্রতীকী বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ১৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৭.৯৯ শতাংশ এবং জিডিপির ৫.০৪ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭শ’ ৪২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৯.৬৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৫.৪৩ শতাংশ। এ ছাড়াও নারীর ক্ষমতায়নসহ তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ৭৯৫ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সাত বছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ পাঁচগুণেরও বেশি বেড়েছে। যা নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সরকারের এসব কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য স্ট্যাটিসটিক্স’ তাদের প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। নারী শিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ‘দ্য গ্লোবাল সামিট অব উইমেন’ এর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ’ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে। জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের সভায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ এ্যাওয়ার্ড’Ñ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব গণমাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আজ থেকে এক শতাব্দীর বেশ কিছু আগে এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৯০৫ সালে তাঁর রচিত ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামের বইটিতে কল্পনায় তিনি এমন একটি দেশ চেয়েছিলেন, যেখানে সবকিছুর নেতৃত্বে থাকবেন নারী। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যে অনেকদূর এগিয়েছে। [email protected]
×