ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৭ জুলাই ২০১৮

 ঢাকার দিনরাত

ঢাকা স্বাগত জানায়নি শ্রাবণকে; পঞ্জিকায় শ্রাবণ চলে এলেও ঢাকার আবহাওয়া দেখে যে কেউই বলবেন এখন শ্রাবণ নয়। বরং বলা চলে আগাম ভাদ্রই যেন এসে পড়েছে। ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই, তার বদলে রয়েছে দিনভর ছত্রিশ ডিগ্রী তাপমাত্রার অসহনীয় আগ্রাসন। যা হোক, প্রথমে বিশিষ্ট অতিথি সংবাদ দিয়ে লেখা শুরু করছি। ঢাকায় এসেছিলেন রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ইউরি বরিসভ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করেন। অন্যদিকে সত্তরের দশকে বিশ্বে ঝড় তোলা গানের গ্রুপ বনি এম এসেছিল ঢাকায়। উচ্চমূল্যের একটি টিকেটও অবিক্রীত ছিল না। তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পী আলিফ আলাউদ্দীন। গানপিপাসুদের জন্য বনিএম-এর ঢাকা সফর অব্যশই বিশেষ ঘটনা। দুটি দুঃখজনক অভাবিত এবং অনভিপ্রেত ঘটনার কথা বলা যাক। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করে এক রিকশাচালকের মৃত্য হয়েছে। তার নাম সোহরাব হোসেন। শনিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনা হলো গত সপ্তাহেই জানা গেল গত মাসে ঢাকার ওয়ারীতে পনেরো লাখ টাকা ছিনতাইয়ের যে ঘটনা ঘটেছিল তার পেছনে ছিল আপন ভাইয়েরই কারসাজি। এনামুল হক নামের এক যুবক তার ভাই নাজমুল হাসানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পনেরো লাখ টাকা ছিনতাই করিয়েছিল ভাড়াটে ছিনতাইকারীদের দিয়ে। পারিবারিক মূল্যবোধ আজ কোন রসাতলে গেছে তারই নমুনা এটি। . রাইড শেয়ারিংয়ে অনিয়ম যানজটের শহর ঢাকার বহু মানুষ এখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য মোটর বাইক কোম্পানির সার্ভিস নিচ্ছেন। ফলে ঢাকার রাস্তায় মোটরবাইকের দাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ট্রাফিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর উদাহরণও বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকে যাত্রীরা কতটুকু নিরাপদ? রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর এ্যাপে পাওয়া মোটরসাইকেলে প্রাইভেট কার, বাস, সিএনজির ফাঁকফোকর দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে। তাই চলতি বছরে যানজটের ঢাকায় স্মার্ট নগরবাসী উবার, পাঠাওয়ের মতো মোটরসাইকেল সেবার দিকে ঝুঁকছে। পাল্লা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতাধীন মোটরসাইকেল ও চালকের সংখ্যাও বাড়ছে। একই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের দিক থেকে মোটরসাইকেল সেবা নিয়ে অভিযোগ-অসন্তুষ্টিও বেড়ে চলেছে। বহু বেকার যুবকই এই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন এবং সাধারণ চাকরির তুলনায় অনেক বেশি টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। শুধু পাঠাও কোম্পানিতেই গত এক বছরে নাম নিবন্ধন করেছেন দেড় লাখ মোটর বাইক চালক। রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রী থাকা অবস্থায় ৪ জুলাই এয়ারপোর্ট রোডে মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ফুয়াদ নামে এক যুবক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন চালক। এরকম ঘটনা আগে ঘটলেও সেবা ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, চালক এবং রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রী নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। বেশিরভাগ মোটরসাইকেল রাইডার নিজে হেলমেট পরলেও যাত্রীর জন্য হেলমেট রাখছেন না। অনেক চালক নামেমাত্র হেলমেট রাখলেও সেটা আর পরার যোগ্য থাকছে না। মোটামুটি মোটরসাইকেল চালাতে পারে এমন রাইডারও পাওয়া যাচ্ছে। অদক্ষ ও বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অনেকে। উবার, পাঠাও ব্যবহারকারীদের মোটরসাইকেল সেবা নেয়ার অভিজ্ঞতা জানতে ফেসবুকে সক্রিয় ‘উবার ইউজার্স অব বাংলাদেশ’ এবং ‘পাঠাও ইউজার্স অব বাংলাদেশ’ নামের দু’টি গ্রুপে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে পোস্ট করে একটি টিভি চ্যানেলের অনলাইন। উবার ব্যবহারকারীদের গ্রুপে দেয়া পোস্টে মোটরসাইকেল রাইড নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান কয়েকজন। তাদের সবাই একবাক্যে জানান পাঠাও, উবার মটোসহ অন্যান্য রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের মোটরসাইকেলে যাত্রীর জন্য হেলমেট রাখা হয় না বললেই চলে। সম্প্রতি অবশ্য যাত্রাপথে দুর্ঘটনার শিকার চালক এবং যাত্রী পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে উবার। ৬ জুন বিশ্বের নামকরা রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে উবারের গাড়ি এবং মোটরসাইকেল চালক-যাত্রীদের জন্য ইন্স্যুরেন্স পদ্ধতি চালু করার ঘোষণা দেয়। ব্যবহারকারীদের স্বার্থে উবার এই উদ্যোগ নিলেও এ ব্যাপারে পাঠাও ও ভাইসহ দেশীয় রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও নীরব। ট্রাফিক আইন সবাইকে মানতে হবে। এতে কোন ছাড় নেই। . প্রসঙ্গ ভারতীয় ভিসা যমুনা ফিউচার পার্কে সুবিশাল ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ভিসা কেন্দ্রে ভারত গমনেচ্ছু সব শ্রেণীর মানুষ ভিসার জন্য আবেদন করতে পারছেন। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ এবং বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভিসা দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তি সহজতর হওয়ার প্রেক্ষিতে অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। অর্থকথা ম্যাগাজিন সম্পাদক ও কবি সৈয়দ রানা মুস্তফীর ফেসবুক পোস্টটিতে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে সামগ্রিক চিত্র। তিনি লিখেছেন : “বাংলাদেশীদের জন্য ভারতের ভিসা পাওয়া এই সেদিনও ছিল সোনার হরিণ। অথচ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ৪র্থ প্রধান সোর্স বাংলাদেশ। এই কাগজ- সেই কাগজ, এভিডেভিট, নোটারি, নোঅবজেকশন, ইউটিলিটি বিল, বার্থ সার্টিফিকেট, ম্যারেজ ডকুমেন্ট আরও কত কি! এসব দিলেও ভিসার নিশ্চয়তা ছিল না। তারপর শুরু হতো ই-টোকেন বাণিজ্য। ই-টোকেন বাণিজ্য হতো এই ভারতীয় ভিসা নিয়ে! এ সিলসিলা চলছিল বছরের পর বছর ধরে। প্রতিশ্রুতি পাওয়া যেত ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার, ব্যস; ঐ পর্যন্তই। কিছুই সহজ হতো না, উল্টো ভোগান্তি বাড়ছিল দিনে দিন। এমন সময় বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে এলেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, হাসিখুশি কিন্তু স্বল্পভাষী তিনি। কথা না বলে কাজে দেখাতে থাকলেন ভিসা সহজ করা কাকে বলে! একে একে ভিসা পেতে নানা শর্ত উঠে যেতে থাকল, ই- টোকেন মূল্য নেমে এলো ৫শ’ টাকায়! ঢাকার একাধিক পয়েন্টসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত হলে ইন্ডিয়ান ভিসা এ্যাপ্লিকেশন সেন্টার বা ওঠঅঈ. দুর্নীতি চক্র তাঁর শক্ত হাতে দমন হলো অনেকাংশেই। এতেও মন ভরলো না তাঁর, ভরার কথাও না, স¤্রাট হর্ষবর্ধনের নামে নাম তাঁর, ফলে বিশাল কিছু না হলে কিভাবে সন্তুষ্ট হবে তাঁর হৃদয়? সেই বিশালের আকাক্সক্ষা থেকেই গত ১৪ জুলাই যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং কমপ্লেক্সে ১৮ হাজার ৫শ’ স্কয়ার ফিটের বিশাল ফ্লোরে উদ্বোধন করা হলো ওঠঅঈ-এর স্টেট অব দ্য আর্ট স্থাপনা! এই সমন্বিত ওঠঅঈ-এ ৪৮টি কাউন্টারে কোনো ই-টোকেন ছাড়াই সব ধরনের ভিসা আবেদন জমা দেয়া যাবে। ৭০০ আবেদনকারী বসে অপেক্ষা করতে পারবেন এখানে। সিরিয়াল ভেন্ডিং ম্যাশিন থেকে একটি কুপন পাবেন সময় সংকেতসহ। এছাড়াও থাকছে অসংখ্য সুবিধা। প্রতিদিন এখান থেকে প্রায় ৬ হাজার ভিসা দেয়া হবে। এই ওঠঅঈটি চালু হওয়ার কারণে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে ঢাকার আর সব ওঠঅঈ বন্ধ হয়ে যাবে। ঢাকার কূটনৈতিক মহলে হর্ষবর্ধন শ্রিংলার এই বৈপ্লবিক উদ্যোগে সাড়া পড়ে গেছে! আরেকবার প্রমাণিত হলো-মানুষই পারে, তবে যে সে মানুষ নয়, পারার জন্যে হতে হয় মানুষ-রতন। বন্ধু হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যে তেমনই একজন মানুষ-রতন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে তাঁর টেনিউরে, পৌঁছেছে ভিন্ন উচ্চতায়। হ্যাটস অফ টু হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।” . কবিদের আড্ডা কবিতার বইয়ের বিক্রি বেশ কমে গেছে। কবিতার নামে এলেবেলে শব্দচাষ হচ্ছে ফেসবুকে আর তাতে লাইক দেয়ার হিড়িকও পড়ে গেছে। তারপরও পরিচিত কোনো কবিই কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি। আর প্রতি বছরই নতুন নতুন কবিকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। এরকম বাস্তবতায় কবিতার জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে কিনা এমন একটি উদ্বেগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। গণমাধ্যম সংস্থা ঘাসফুল ‘বাংলা কবিতা কি জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছে’Ñশীর্ষক মুক্ত আলোচনা ও আড্ডার আয়োজন করেছিল শনিবার। অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের কথাকাব্য কক্ষটি নির্ধারিত সময়ের আগেই পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কোনোমতে একটি আসন জুটেছিল আমার। যদিও আমার দায়িত্ব ছিল অনুষ্ঠান সঞ্চালনার। শিক্ষিত মানুষ কেন কবিতা পড়েন? তাঁর শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যতৃষ্ণাই তাঁকে কবিতার কাছে নিয়ে যায়। কবিতা এক ধরনের আশ্রয়। মানুষ সেখানে স্বস্তি, সান্ত¦না, সমর্থন ও আনন্দ সন্ধান করে। মানুষ কবিতায় প্রতিবাদ প্রত্যাশা করে, চায় ধ্বনির যাদু, শব্দের মোহন বাজনা, এবং আরো অনেক কিছু। কবিতায় খোঁজে আবেগের অভিনব প্রকাশ, জীবনের গূঢ় সত্য এবং অপার্থিব শান্তি। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা সাহায্য করে। কিন্তু কোন কবিতা? অবশ্যই মানসম্পন্ন কবিতা, প্রকৃত কবিতা। সত্যিকারের প্রাজ্ঞ দ্রষ্টা সাধক কবির কবিতা। অনুষ্ঠানে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা বেশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। এখন ফেসবুক লাইভ বলে একটা জিনিশ চালু হয়েছে। এটিকে লাইভ টিভি অনুষ্ঠানও বলা যেতে পারে। ফেসবুকে আড্ডার লাইভ সম্প্রচার দেখে কেউ কেউ এই আড্ডায় যোগ দিতে আসেন। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলমের নাম বলা যেতে পারে। তাঁর কথাতে উঠে এলো কবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলায় আবৃত্তি সংগঠনগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার কথা। অনুষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা অবশ্য কবি নন, কথাসাহিত্যিক। তিনি আতা সরকার। তবে কবিতার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ থাকার কারণেই ঘাসফুলের বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই কবিতাকেন্দ্রীক। অনুষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। শুরুতেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন কবি শামীমা চৌধুরী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি শামসুল ফয়েজ। আলোচনায় অংশ নেন ওয়াহিদ মুরাদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, জয়নাল হোসেন, জাহিদুল হক, জুনান নাশিত, ফরিদ কবির, ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, বিলু কবির, মারুফ খান, মাহবুব সাদিক, মিলনকান্তি নাথ, মোরশেদ শফিউল হাসান, শামীম রেজা, সৈয়দ আবদুল করিম, সৈয়দ জাকির হোসাইন প্রমুখ। সব মিলিয়ে আলোচনায় বেশ কিছু পয়েন্ট উঠে এসেছিল। কবিরা স্বীকারই করতে চান না যে কবিতার জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ‘জনপ্রিয়তা’ শব্দটিকেই উপেক্ষা করে যেতে চান। কেননা কবিতা অনুধাবন করা পাঠকের সংখ্যা চিরকালই কম। আধুনিক কবিতার পাঠক হতে হলে বিশেষ যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। অন্যদিকে কবিরাও আগের মতো নিবেদিতপ্রাণ নন, তাঁদেরও কিছুটা ঘাটতি আছে- এ ধরনের বক্তব্যও উঠে এলো কারো কারো কথায়। তর্ক-বিতর্ক যাই হোক, সবার মধ্যেই কবিতার জন্যে প্রেম অগাধ, কবিতা তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আর কবিতা হলো সকল শিল্পের সেরা। তার সযত্ন পরিচর্যা প্রয়োজন, এটি অস্বীকারের নয়। ঘাসফুলকে ধন্যবাদ কবিদের উজ্জীবিত করার জন্যে। ১৫ জুলাই ২০১৮ [email protected]
×