ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জিসান রহমান

তারুণ্যের উদ্যোগ ‘লাইটার’

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৭ জুলাই ২০১৮

  তারুণ্যের উদ্যোগ ‘লাইটার’

এই দেশকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর চেয়ে বরং আগেই ভাল ছিলাম- রাস্তায় চলতে গেলে, ঘরের যে কোন গল্প-গুজবে কিংবা পাশে বসে কাউকে নিয়ে সংবাদ দেখতে বসলে- প্রায়ই কথাগুলো শোনা যায়। প্রচণ্ড হতাশাবাদী কথাবার্তা। তবুও এ কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়েও আমাদের থমকে যেতে হয়। পত্রিকা খুললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে নেতিবাচক খবর। এসব দেখে মনে হয় আসলেই কি এই দেশকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না? এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনে চিন্তা চলে আসে চুপচাপ ঘরে বসে কি হবে? আমরা এগিয়ে আসলে তবেই না দেশ এগিয়ে যাবে! এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে একদল স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীরা গড়ে তুলেছে তাদের প্রাণের সংগঠন ‘লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’। ‘লাইটার’ শব্দটি অনেকের কাছেই নেতিবাচক। সেই তথাকথিত নেতিবাচক নাম নিয়েই লাইটারের পথচলা শুরু! কিন্তু কেন? একটি লাইটারের যেমন স্পার্ক হুইল, স্টোন, নজেল, ফুয়েল ইত্যাদি আছে, ঠিক সেভাবেই এদেশেরও আছে সেসব সম্পদ; যা দিয়ে আমরা সকল মানে-বিচারে এক আদর্শ দেশে পরিণত হতে পারি। এই চিন্তা থেকেই ২০১৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর শুরু হয় সংগঠনটির পথচলা। সদ্যপ্রসূত সংগঠনটি নিজেদের ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পারেনি তখনও। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্দাবাড়ি ইউনিয়নের জলবন্দী মানুষগুলোর বোবা আর্তনাদ যে তাদের বুকটাকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল! তাই, অনলাইন, অফলাইন সব জায়গায় সমান তালে চলতে থাকে তাদের প্রচারণা, সব শেষে শুরু হয় লাইটারের ইতিহাসের প্রথম ইভেন্ট ‘মিশন গাইবান্ধা’, যেখানে দেয়া হয়েছিল ৫০০ পরিবারের মাঝে বেঁচে থাকার উপকরণ। তারপর থেকে প্রতি বছরই বন্যায় লাইটার চেষ্টা করে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ বন্যায় লাইটার ছুটে যায় গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি, কামালেরপাড়া, কচুয়া ইউনিয়নগুলোয়। ওই এলাকাগুলোতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধের কোন ব্যবস্থা তখন অবধি ছিল না। সেখানেও ৫০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ দিয়ে লাইটার চেষ্টা করেছে সাধ্যমতো সহযোগিতা করার। ঠিক তার পরের বছর, ২০১৬ সালে বন্যা পরিস্থিতি গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশ খারাপ ছিল। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের অবস্থা তখন খুবই খারাপ, সাহায্য বলতে গেলে কিছুই পৌঁছায়নি। তাছাড়া একেবারে যমুনা নদীর তীরের জনপদ ও যমুনার বুকে জেগে উঠা বিভিন্ন চরগুলোতে থাকা মানুষগুলোর জন্য এ ত্রাণ পাওয়াটা খুবই প্রয়োজন ছিল। এজন্য লাইটার একটি পাবলিক ইভেন্ট করে ‘একটু ত্রাণ হবে, ত্রাণ?’ নামে। সেই ইভেন্টে যে টাকা উঠেছিল তা দিয়ে ৫৪২টি পরিবরাকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের বন্যায় সংগঠনটি ত্রাণ দিয়েছিল কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চরগুলোর ৫০০ পরিবারের মাঝে। পাশাপাশি দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার কমলপুর ইউনিয়নে বন্যায় ঘর হারানো ৫৪ পরিবারের মাঝে ১০০ বান (৯০০টি) টিন বিতরণ করা হয়। লাইটার বন্যাদুর্গত এলাকায় নেমেছে আরও একটি মিশনে সেটি হচ্ছে ট্যাবু ভাঙার মিশন। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে অনেক বেশি কুসংস্কার আছে, লাইটারের নারী সদস্যরা বন্যার্ত এলাকার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে পিরিয়ড যে কোন অসুস্থতা নয় বরং একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এটি বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং তাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদান করেন। শুধু বন্যার্তদের জন্যই নয়, লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশন সর্বদা চেষ্টা করছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। আলো আনার এই মিছিলে প্রতিবছর পালন করা হয় মিশন ২১, মিশন ৭১, স্বাবলম্বীকরণ প্রজেক্ট নামে কয়েকটি সিগনেচার ইভেন্ট। মিশন ৭১ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এই স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে ভাল। কিন্তু বাস্তবতা পুরোই উল্টো। এক সময় রাজাকাররা তাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে দেশ শাসন করেছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই না খেয়ে থাকতে হয়। সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে বের করেছে লাইটার, সার্ভে করেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেরিয়েছে। লাইটার দেশের সূর্যসন্তানদের সহযোগিতা করতে চায়নি, বরং তাদের স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছে। মিশন ৭১ বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত যুদ্ধকালীন ১ ও ৪নং সেক্টরের ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নপূরণ করেছে লাইটার। এর মধ্যে সাতজনকে গৃহনির্মাণ, পাঁচজনকে মুদিদোকান, একজনকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ক্রয়, একজনের মেয়ের বিয়ে এবং একজনের চিকিৎসার খরচ দিয়েছে তারা। এই বছর ৬ নং সেক্টরের আরও ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য আছে সংগঠনটির। মিশন ২১ একুশের চেতনা যেন বছরজুড়েই অক্ষুণœ থাকে, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে লাইটার এমন সব জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয় যেখানে শিশুরা পারে না শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে, ফুল দিতে। মিশন ২১ এর অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত একে রহমানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ২০১৬ তে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত আবদুল্লাহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ২০১৮ তে লাইটারের মডেল ভিলেজ প্রকল্পে আলসিয়াপাড়ায় অবস্থিত শৌলমারী আলসিয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণের পাশাপাশি বাচ্চাদের নিয়ে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং প্রতি বিভাগে বিজয়ীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের বই উপহার হিসেবে তুলে দেয়া হয়। ‘এটা শুধু আমাদের ভাষাচর্চাকে শিশুদের কাছে পৌঁছে দেয়াই নয়, বরং হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করি নিজেদের আত্মতৃপ্তি’, বলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক তানভীর হোসাইন জনী। মিশন স্বাবলম্বীকরণ একজন মানুষকে একবেলা খাবার খাইয়ে সাহায্য করার চেয়ে সে যাতে তার নিজের খাবার নিজে জোগাড় করতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করা তার জন্য বেশি প্রয়োজন। এই প্রজেক্টের আওতায় প্রথম সাহায্য করা হয় একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে। তারপর একে একে সেলাইমেশিন কিংবা দোকান করে দেয়া হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও বেশ কিছু দরিদ্র পরিবারকে। মিশন মডেল ভিলেজ লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের স্বপ্নের প্রজেক্টের নাম মডেল ভিলেজ প্রজেক্ট। ‘আমরা ভেবেছিলাম, এই যে এত এত সংগঠন, আমরা সবাই যদি একেকটি গ্রামকে একটি মডেল ভিলেজে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলেই দেশটার চেহারা বদলে যাবে। গ্রাম যদি উন্নত হয়, স্বাবলম্বী হয়, দেশটা কত দূর এগিয়ে যাবে, ভাবতে পারেন?’- বলছিলেন সংগঠনটির সভাপতি মুক্তার ইবনে রফিক। এই প্রকল্পের শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন– ‘আমাদের এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে, নীলফামারীর তিস্তার পাড়ের ৩৭টি পরিবারকে দেয়া হয় গরু, ২টি পরিবারকে মুদির দোকান এবং ১টি পরিবারকে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য মূলধন। এটি ছিল আমাদের পাইলট প্রজেক্ট। তারপর বেশকিছু দিন পর আমরা যখন তাদের দেখতে যাই আবার, প্রজেক্টের সাফল্যের হার দেখে অবাক হই। ৭০% এরও বেশি সফল ছিল আমাদের এই উদ্যোগ। তখন আমরা হাতে নেই আমাদের মডেল ভিলেজ প্রকল্প।’ এই বছর মডেল ভিলেজ প্রকল্পের শুরুতেই শীতের মৌসুমে ৫০০ পরিবারের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। পাশাপাশি শুরু হয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম। বিজয় দিবসে স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রদর্শিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মডেল ভিলেজ প্রকল্পে লাইটার শুরু করবে স্বাবলম্বীকরণ প্রজেক্ট, যার আওতায় দশটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়া আলসিয়াপাড়ায় অতি শীঘ্রই নির্মাণ করা হবে তিনটি উঁচু টিউবওয়েল এবং দশটি স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। এভাবেই ধীরে ধীরে লাইটার গড়ে তুলতে চায় এমন একটা গ্রাম যেখানে জ্বলবে শিক্ষার আলো, থাকবে লাইব্রেরি, ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রভাত ফেরিতে যাবে শিশুরা, স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে গ্রামটির মানুষ, নিজেদের সমস্যাগুলো তারা নিজেরাই মেটাতে সক্ষম হবে। আর এভাবে আলসিয়াপাড়ার অনুকরণে অন্য গ্রামগুলোও উন্নতির দিকে ধাবিত হলে সফল হবে লাইটারের স্বপ্নের মডেল ভিলেজ প্রকল্প। এ সকল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি লাইটারের আছে ব্লাড উইং, আছে যে কোন সময় দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য এ্যাডিশনাল সাপোর্ট টিম। নিয়মিত আয়োজন করা হয় মেডিক্যাল ক্যাম্প। সারা বছর ধরে ঘটে যাওয়া নানা দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় লাইটার; যেমন কড়াইল বস্তিতে আগুন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রাঙ্গামাটির ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য, খুকুমণি স্কুল ইভেন্ট, গাইবান্ধায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া লাইব্রেরিতে সংগৃহীত বই প্রদান। লাইটার বিশ্বাস করে সবাই যদি নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসে তবে একদিন আলো আসবেই।
×