ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৪০ বছর পর শিকড়ের সন্ধান পেলেন আনোয়ারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ জুলাই ২০১৮

৪০ বছর পর শিকড়ের সন্ধান পেলেন আনোয়ারা

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও থেকে ॥ অভাবের তাড়নায় আনোয়ারাকে ৪০ বছর আগে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজনদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ইতোমধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে আগেকার বাবা-মা। বদলে গেছে তার মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু বদলে যায়নি শিকড়ের টান, মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা, মা-বাবা ও স্বজনদের প্রতি মমত্ববোধ। ২৬ বছর ধরে বাবা-মা, স্বজন ও শিকড়ের সন্ধানে তার চেষ্টা ছিল বিরামহীন। মা-বাবা গত হয়েছে বহু বছর আগেই । বাংলায় কথা বলতে না পারলেও হারানো ভাই-বোনকে ফিরে পেয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে বাবা, মা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল। আর হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়ে শত শত গ্রামবাসী ভিড় জমিয়েছে। আনোয়ারার সঙ্গে তাদের চোখও ছিল অশ্রুসজল। এ ধরনের ঘটনার অবতারণা হয় সোমবার বিকেলে গফরগাঁও উপজেলার খারুয়ামুকুন্দ গ্রামে। উপজেলার খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের ইন্তাজ আলী ও সমতা খাতুন দম্পত্তির অভাবী সংসার। ইন্তাজ আলী ও সমতা খাতুন রোগে আক্রান্ত। কাজ-কর্ম করতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তিন মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৬ জনের সংসারে খাবার যোগাড় করতে পারে না। ১৯৭৮ সালের কোন এক সকাল বেলা ইন্তাজ আলী ও সমতা বুকে পাহাড় সমান কষ্টে নিয়ে গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে রাজধানী ঢাকাগামী লোকাল ট্রেনে তুলে দেন আড়াই বছর বয়সী কন্যা শিশু মল্লিকা ও পাঁচ বছর বয়সী শিশু কন্যা মাজেদাকে। গন্তব্য অজানা। হয়তো হৃদয়বান কোন মানুষের সহযোগিতায় ক্ষুধার্ত দুই শিশুর আশ্রয় মিলে টঙ্গীর দত্তপাড়ার এক মাতৃসদনে। মাতৃসদনে মাজেদার নাম পরিবর্তিত হয় আনোয়ারা। সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে নেদারল্যান্ডের নিঃসন্তান দম্পতি এর্ভাট বেকার ও মেরিয়্যান্ট রেজল্যাগান্ট ৫ বছর বয়সী আনোয়ারাকে দত্তক নেন। আনোয়ারার ছোট বোন মল্লিকাকে (পরিবর্তিত নাম শম্পা) দত্তক নেয় নেদারল্যান্ডসের অপর একটি নিঃসন্তান দম্পত্তি। এর পর থেকেই দুই বোনও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়। যায় দিন, যায় মাস, বছর ঘুরে কখন যে ৪০টি পার্বণ কেটে গেছে। আনোয়ারা নেদারর‌্যান্ডসে নাসিং-এ ¯œাতক ডিগ্রী নিয়ে একটি হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন। ছোটবেলায় নেদারল্যান্ডে গিয়ে পালক পিতা-মাতার কাছে বড় হতে থাকে আনোয়ারা। নেদারল্যান্ডের এক এলাকায় এক মেয়েকে দেখে তার মনে হয়েছিল তার ছোট বোন। আবার হারিয়ে ফেলে। ১৫ বছর চেষ্টার পর পালক বাবা-মা সহযোগিতায় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তার হারানো বোন শম্পাকে খুঁজে পায় আনোয়ারা। ১৯৯২ সাল থেকে আনোয়ারা বাংলাদেশে এসে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, শিকড়ের খোঁজ করছিল। এই সময়ে নিঃসন্তান আনোয়ারাও বাংলাদেশ থেকে আজিয়া ও মুন নামে দুই কন্যা শিশুকে দত্তক নেয়। আনোয়ারা প্রতিবারই বাংলাদেশে এসে তার শিকড়ের সন্ধানে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় পোস্টারিং করে এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিবারই ব্যর্থ ফিরে যান। এ বছর জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এসে বাবা-মা, স্বজনদের খোঁজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে যোগাযোগ করেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির পরিচালক হানিফ সংকেতের সঙ্গে। গত ৩০ মার্চ এ সংক্রান্ত একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি দেখছিলেন খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের দলিল লেখক শ্যামল কুমার দত্ত। তিনি ইত্যাদির পচিালক হানিফ সংকেতের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনোয়ারার ভাই ছুতু মিয়া (৫৫) এবং ছুলেমান নেছার (৬০) ডিএনএ রির্পোট নেদারর‌্যান্ডস পাঠান। আনোয়ারা বেগম নিশ্চিত হন ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছাই তার ভাই, বোন। গত রবিবার রাতে নেদারল্যান্ডস থেকে স্বামী থমাস, দত্তক দুই কন্যাসহ বাংলাদেশে আসেন আনোয়ারা। সোমবার দুপুরে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয় তার ভাই ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছার দেখা দেখির মাধ্যমে। আনোয়ারা জানায়, মা-বাবা নেই খারাপ লাগছে। তবে আমি আমার শিকড়ের সন্ধান পেয়েছি। এতে আমি অনেক খুশি। পরিবার ও শিকড় থাকা সবার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
×