ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভল্টের স্বর্ণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে-

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৮ জুলাই ২০১৮

ভল্টের স্বর্ণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে-

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব স্বর্ণকার সোনা পরীক্ষা করে ৪০ শতাংশ সোনা বলে মত দিলে সেটি ভুলে প্রত্যয়নে ৮০ শতাংশ লেখা হয়। যার ফলে শুল্ক গোয়েন্দার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাড়া করা মেশিন নিয়ে সোনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এটি আমলে নেয়নি। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা মানতে নারাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে প্রতিবেদন সরাসরি প্রত্যাখান করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদন তাদের নিজেদের। তবে তদন্ত চলাকালীন সময়ে আমাদের সঙ্গে তাদের বিষয়গুলো নিয়ে বিরোধিতা ছিল। তখন আমরা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে সোনার মান পরীক্ষা করাতে আণবিক শক্তি কমিশনের নাম প্রস্তাব করি। তবে তাতে সংস্থাটি রাজি হয়নি। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুরে কা- শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ হয় একটি জাতীয় দৈনিকে। তার ব্যাখ্যা দিতে জরুরী সংবাদ সম্মেলন ডাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক এস এম রবিউল হাসান বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার বরাত দিয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে তা সঠিক নয়, বস্তুনিষ্ঠ নয়। তবে এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দৈনিকে প্রতিবাদ পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা ধাতু বদলে যাবার কোন সুযোগ নেই। তবে এখানে শুল্ক গোয়েন্দা অনুমতি নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করে। ওই সময় তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধী হয়। সংস্থাটি ভাড়া করা মেশিন নিয়ে সোনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আসে। ফলে এটি তাদের নিজস্ব প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্র্ডের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা তার প্রতিটি অংশ ব্যাখ্যা করে জবাব দিয়েছি। গত ১১ জুলাই তা এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে। সোনার মান পরীক্ষার পদ্ধতির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ম্যানুয়ালি সোনার মান পরীক্ষা করে শুল্ক গোয়েন্দা কে সোনা গ্রহণের প্রত্যয়পত্র দেয়া হয়। তবে সেখানে কিছু ক্লারিক্যাল মিসটেক ছিল। আমাদের নিজস্ব স্বর্ণকার সোনা পরীক্ষা করে ৪০ শতাংশ সোনা বলে মত দেন। তবে সেটি ভুলে প্রত্যয়নে ৮০ শতাংশ লেখা হয়। পরে বিষয়টি বেরিয়ে আসে। তখন শুল্ক গোয়েন্দার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আমাদের এ সংক্রান্ত প্রত্যয়পত্রও দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণকারও পরে সেটি সংশোধন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলছে, শুল্ক গোয়েন্দা একটি ভাড়া করা মেশিন দিয়ে সোনার মান পরীক্ষা করিয়েছে। আমরা এটি আমলে কেন নেব। সেটি তাদের বিষয়। তবে তারা আমাদের প্রস্তাবে তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে যেতে রাজি হয়নি। রাষ্ট্রের জিম্মাদার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে কোন অনিয়ম হয়নি। শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত একটি সোনার চাকতি এবং একটি কালো প্রলেপযুক্ত সোনার রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই চাকতি এবং আংটি যথাযথ ব্যক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র দেয়। তবে দুই বছর পর পরিদর্শন দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২ ক্যারেট) সোনা পায়। আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট)। ধারণা করা হচ্ছে ভল্টে রাখার পর এগুলো পাল্টে ফেলা হয়েছে। এতে সরকারের ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শুল্প গোয়েন্দারা ডিজিটালি সোনার মান পরীক্ষা করে জমা করতে আসেন। তবে আমরা ম্যানুয়ালি করি। তবে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। জাপান থেকে একটি মেশিন ৪ কোটি টাকা দিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেটি অনেক সময় ভুল প্রতিবেদন দিচ্ছিল। তাই মেশিনটি ফেরত দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাচিত স্বর্ণকার আছেন। তিনি যাচাই বাছাই করে সোনার মান নির্ধারণ করে দেন। কেন একজন স্বর্ণকারের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য, এর আগে এমন পরিস্থিতি হয়নি। এখন বিষয়টি নিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা হবে। তবে শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদন কতটা গ্রহণযোগ্য সেই প্রশ্ন রয়েছে। তাদের নিজস্ব কোন মেশিন নিয়ে তারা আসেনি। আমরা আণবিক শক্তি কমিশনে সব সোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে শুল্ক গোয়েন্দা সারা দেয়নি। শুল্ক গোয়েন্দার বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিদর্শন দল প্রতিটি রসিদের অনুকূলে জমা হওয়া সোনা যাচাই করেছে। তাতে দেখা গেছে, সোনার অলঙ্কার এবং সোনার বারে ক্যারেটের তারতম্য করা হয়েছে। ২৪ থেকে ২০ ক্যারেটের ৯৬০ কেজি সোনার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে ভল্টে ১৮ ক্যারেট হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। কম ক্যারেটে নথিভুক্ত থাকায় নিলাম বা অন্য উপায়ে বিক্রির সময় অতিরিক্ত ক্যারেটের বিপরীতে প্রাপ্য টাকা থেকে সরকার বঞ্চিত হবে। সোনার ক্যারেটের তারতম্য ঘটানোর কারণে সরকারের ১ কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৬ টাকা ৬৭ পয়সা ক্ষতির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ভল্ট খুবই সুরক্ষিত। সেখানে ৬ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। চাইলেই কেউ ঠুকতে পারেন না। এমনকি গবর্নরও প্রবেশ করতে পারেন না। একটি চাবিতে ভল্ট খোলা যায় না। তাই প্রতিবেদনে প্রকাশের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিষয়গুলো স্পষ্ট করা যেত।
×