ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে সংস্কারের এই যাত্রা কি সফল হবে

প্রকাশিত: ০৭:২০, ১৮ জুলাই ২০১৮

সৌদিতে সংস্কারের এই যাত্রা কি সফল হবে

সৌদি আরবের সমাজ জীবনে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত ২৪ জুন থেকে সৌদি নারীরা নিজেদের গাড়ি নিজেরাই চালানোর আনুষ্ঠানিক অধিকার পেল। এই অধিকার প্রাপ্তি অত স্বচ্ছন্দে এসে ধরা দেয়নি। ধর্মীয় রক্ষণশীলদের তরফ থেকে প্রবল বাধা এসেছে। এক ধর্মীয় নেতা তো হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন মহিলাদের গাড়ি চালাতে দিলে অনৈতিকতা এবং সতীত্বের অভাব দেখা দেবে। আরেকজন বলেছিলেন মেয়েরা গাড়ি চালানোর ক্ষমতা রাখে না কারণ তাদের বুদ্ধি পুরুষের অর্ধৈক। আরেকজন বিজ্ঞানকে টেনে এনে মন্তব্য করলেন মেয়েরা গাড়ি চালালে তাদের ডিম্বাশয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের এসব যুক্তি ও আপত্তি ধোপে টিকেনি। সৌদি নারীরা এখন গাড়ি চালাচ্ছে। এই অধিকার লাভের মধ্য দিয়ে, তারা তাদের মুক্তির পথে এক ধাপ এগোল। আরও কিছু প্রতিবন্ধকতারও অপসারণ অবশ্যই দরকার। যেমন পুরুষদের অভিভাবকত্ব। মেয়েরা পড়াশোনা করতে বা বিদেশে যেতে পারবে কিনা সেটা ঠিক করবে পুরুষরা। এটা এখনও আছে যা নারীদের জন্য খুবই অবমাননাকর। তবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর ব্যাপারটা সৌদি সমাজে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক। এই পরিবর্তন অবশ্য রাজপথ থেকে আসেনি। এসেছে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ থেকে। সিনেমা চালু হয়েছে। প্রকাশ্যে সঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে। নৈতিকতার তদারককারী পুলিশ রাজপথ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যুবরাজ তেলের ওপর থেকে অর্থীনিতির নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছেন। তারই অংশ হচ্ছে সমাজে এই উদারীকরণ। তবে এসব পরিবর্তন আনলেও যুবরাজ আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন। পাশ্চাত্যের সব রাজনৈতিক মত ও পথের লোকেরা সৌদি আরবকে মোটেও পছন্দ করে না। না করার কারণ এ দেশের কঠোর শরিয়তী সাজা, নারীদের প্রতি হীন আচরণ ও ওয়াহাবী মতাদর্শ এই ওয়াহাবী মতবাদ থেকেই দেশে দেশে জিহাদী আদর্শ ও জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠেছে। সৌদি আরবের প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা রিয়াদের তুলনায় দুবাইয়ে কাজ কারবার করতেই বেশি পছন্দ করে। অন্য আরব দেশের মানুষ সৌদিদের ধনী, অলস ও উদ্ধত বলে উপহাস করে থাকে। তার পরও সৌদি আরবের ভাগ্য নিয়ে বিশ্ববাসীর গভীর আগ্রহ আছে কারণ এর সঙ্গে তাদের মৌলিক স্বার্থও জড়িত। দেশটি বৃহত্তম তেল রফতানিকারী দেশ এবং উপসাগরীয় অঞ্চল, আরব অঞ্চল ও ইসলামী বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। এমন একটি দেশে সংস্কার কার্যক্রম সফল হলে বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত একটি অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিস্তার ঘটবে এবং অর্থনীতি হয়ে উঠবে গতিশীল। সৌদি আরব অধিকতর স্বাভাবিক হলে ইসলামী বিশ্বও সংযত, সহনীয় হবে। ধর্মান্ধদের অর্থ সরবরাহ কমে আসবে বলে জঙ্গী তৎপরতাও হ্রাস পাবে। কিন্তু সংস্কার তো চাট্টিখানি কথা নয়, এর জন্য সৌদি আরবের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তেল থেকে প্রাপ্ত আয় সরকারের মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি। তেলের দাম যদিও বাড়তির দিকে তথাপি বিশাল বাজেট ঘাটতি সামাল দিতে দেশটিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যত সুফলই অর্জিত হোক না কেন, মাথাপিছু জিডিপি গত কয়েক দশক ধরে একই অবস্থায় আছে। সৌদিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারের সহজ ধরনের আরাম-আয়েশের কাজে নিয়োজিত তেল সম্পদের কারণে দেশটির শোচনীয় রকমের অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি ঢাকা পড়ে আছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বুঝতে পেরেছেন যে একটা পরিবর্তন দরকার। তবে সংস্কারের কাজটাকে তিনি অযথা গুরুভার করে ফেলেছেন। ইয়েমেনে তিনি হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। এই যুদ্ধ ইয়েমেনীদের বুভুক্ষা ও মহামারী যেমন নিয়ে এসেছে তেমনি সৌদি নগরীগুলোতে ডেকে এনেছে ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ। গত বছর সৌদি আরব লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটক করে অযথা নিজেকে কলঙ্কিত অবস্থায় ফেলে। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জল, স্থল ও আকাশপথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেশটি কাতারকে একঘরে করার চেষ্টা করে। পরিণতিতে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে বিভাজন সৃষ্টি হয়। আরবদের নিজেদের স্নায়ুযুদ্ধের বিস্তার ঘটায় এ থেকে ফায়দা তুলে নিচ্ছে ইরান ও অন্য শত্রুরা। সংস্কারের কাজে হাত দিলেও সৌদি যুবরাজ কিন্তু স্বদেশে উত্তরোত্তর নিপীড়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন শিরñেদের ঘটনা বেড়েছে। আরও বেশি সংখ্যয় জেলে পোরা হচ্ছে বিরুদ্ধবাদীদের। তাদের মধ্যে এমন মহিলারাও আছেন যারা গাড়ি চালানোর অধিকার দাবিতে প্রচার অভিযান চালিয়েছিল। যুবরাজের নেতৃত্বে সৌদি আরব এখন আরব বসন্ত ও গণতন্ত্রের আশার বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব শুরু করেছে। যুবরাজের বেসরকারী খাতকে প্রসারিত করার উদ্যোগও অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত। এমনকি বিনোদনের কাজটাও সরকারী সংস্থার দ্বারা পরিচালিত। দেশের উত্তর-পশ্চিমে ‘নিওম’ নামে অত্যাধুনিক নগরী নির্মাণের মতো যেসব বিশাল বিলাশ প্রকল্পের ওপর তিনি তার দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করেছেন সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ার যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। কারণ যুবরাজ সৌদি আরবেক গোটা বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত, ব্যবসায়বান্ধব, দক্ষ প্রশাসনের অধীন এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে সহনশীল না করেই এটা করতে যাচ্ছেন। এর পরিণতি শুভ হওয়ার নয়। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×