ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কি মানবতার চেয়ে বড়?

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২০ জুলাই ২০১৮

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কি মানবতার চেয়ে বড়?

গতকাল ১৯ জুলাই, ২০১৮ এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। তত্ত্বীয় বা লিখিত পরীক্ষা ২ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হয় ১৩ মে এবং ১৪ মে ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হয় ২৩ মে। এটা ভাল যে, সেই হিসাবে মাত্র ৫৮ দিনে ফল প্রকাশ করা হলো। ২০১৮ সালে ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার মাত্র ৬-৮ দিনের মাথায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সাম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ’। ১২ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের ২৫৭তম সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অথচ ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভর্তিকালীন দুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত সহজ ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার গাইড লাইন তৈরি করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটি সমন্বয় করে ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। কমিটিকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নীতিমালা সংক্রান্ত ধারণাপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার কথা ছিল। বড় দুঃখের বিষয় হলো ‘ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই’ পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে দৃশ্যত এমন ত্বরিত বৈঠক কিংবা কোন প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। বরং সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা যে হচ্ছে না তার কিছু আলামত দেখা যায় কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নেয়া নিজস্ব সিদ্ধান্তের নিরিখে। ৬ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচী শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাংবাদিকদের জানান, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতি থাকছে না। একইভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ৭৭তম সিন্ডিকেট (বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮) সভায় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি ঠেকাতে এমসিকিউ পদ্ধতি বা বহুনির্বাচনী প্রশ্ন তুলে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হয়ত তাদের জন্য ভাল মনে করে। তখন থেকেই সন্দেহ দেখা দেয় এ বছর আদৌ সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে কি না। বিষয়টি পানির মতো পরিষ্কার যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ পূর্ব থেকেই সংকল্পবদ্ধ ছিলেন এ ব্যাপারে। স্বায়ত্তশাসন শুধু একটি অজুহাত মাত্র। এ লজ্জা কার? কোথায় রাখি এ লজ্জা! খুব স্বপ্ন দেখেছিলাম এ-বছর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে। স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রায় ১৩ লাখ ১১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী ও তাদের ২৬ লাখ ২৩ হাজার অভিভাবক। যাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই নিম্ন মধ্যবিত্ত, ভূমিহীন কৃষক, মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করা মা, দিনমজুর, রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, জেলে, কুমার, কামার, শ্রমজীবী মানুষ! তাদের সন্তানদের কী হবে? কোথায় পাবেন তারা এত ফরম কেনার টাকা? অনেকেই একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে যেমন ভাবেন না তেমনি দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, খুলনা থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে সিলেট, সিলেট থেকে ঢাকা ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। এমনও হয় যে, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। আর অতিরিক্ত অর্থ খরচের বিষয়টি তো আছেই। হায়রে অভাগা শিক্ষার্থী আর তাদের উচ্চশিক্ষার অলীক স্বপ্ন! বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাদের প্রতিনিধি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যকে সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার অপারগতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন কি? এ ব্যাপারে যেহেতু কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে মহামান্য আচার্যকে অবহিত করা হয়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যকে পাশ কাটিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত আপনারা নিলেন কি করে? নাকি ভেবেছেন নির্বাচনের বছর সুযোগ নেয়া যেতেই পারে? সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমি নিজে যেহেতু একজন শিক্ষক, সেহেতু কিছু বলতে গেলে নিজের গায়েও কিছুটা লাগবে। তাই মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসি একাধিকবার বলা সত্ত্বেও বিষয়টি আলোর মুখ দেখল না। জীবনে দেখা বড় আশ্চর্য ও অবাক করার মতো বিষয়ের একটি হয়ে গেল এটি। মাত্র জুলাই মাস চলছে। যেহেতু বাছাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি মূল কথা। তাই এ বছরের এখনও অনেক দিন বাকি থাকায় সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এ ব্যাপারে অব্যাহত থাকলে একটি মাত্র দুই ঘণ্টার পরীক্ষার (এমসিকিউ ও লিখিত) মাধ্যমে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করা এখনও সম্ভব। আন্তরিকতার সঙ্গে শুধু আলোচনা শুরু করা দরকার। তাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, ঐতিহ্য, ব্রাহ্মণ্যবাদ রক্ষা করা সম্ভব। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের অভিপ্রায় মানে অলিখিত আইন, যা অখণ্ডনীয় বলে প্রতীয়মান হওয়াটাই কাম্য ছিল। অথচ কোন আলোচনাই হলো না এ ব্যাপারে। আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মিলে প্রায় ৩৯ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ জন মানুষের সঙ্গে আমরা ছিনিমিনি খেললাম। পূর্বের ‘গোল্লাছুট’ পদ্ধতিতেই ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আবার নাজেহাল হওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলাম। আমাদের উদাসীনতা, অমানবিকতা ও মনুষ্যত্বেবোধহীনতাই প্রকাশ পেল অবশেষে। ইতিহাস ক্ষমা করবে না আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের এমন সিদ্ধান্ত শোনার পর থেকে বিষণœ মনে একটি গানের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে ‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো, তার আকাশ কি মানবতার (আমার) চেয়ে বড়?’ লেখক : পিএইচডি গবেষক [email protected]
×