ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

শৈলজারঞ্জন মজুমদার ॥ আত্মার আত্মীয়

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২০ জুলাই ২০১৮

শৈলজারঞ্জন মজুমদার ॥ আত্মার আত্মীয়

শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তাঁকে নিয়েই আজকের কথা। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ বা বর্র্তমান বাংলাদেশে যে ক’জন প্রখ্যাত সঙ্গীতপ্রেমী বা সঙ্গীতজ্ঞ কিংবা সঙ্গীতশিল্পী জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুবনের তারকা শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নাম অপ্রতিরোধ্যভাবে সামনে এসে পড়ে। তাঁর জীবনী অনেকেই হয়ত জানেন। তিনি জন্মেছিলেন নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে। সেই নিরিখে আমরা একই মাটির সন্তান। তাঁকে নিয়ে কিছু কথা বলার আগে জেনে নেই তাঁর এগিয়ে যাওয়া জীবনের কিছু কথা। ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই তিনি তদানীন্তন নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জ থানাধীন বাহাম গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল এলাকার জমিদার। স্বভাবতই আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন শৈলজারঞ্জন। বাবা রমণী কিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন নেত্রকোনা মহকুমার সেই সময়ের এক ডাকসাইটে উকিল। মায়ের নাম সরলা সুন্দরী মজুমদার। সবার চেনা প্রখ্যাত লেখক-সাহিত্যিক শ্রী নিরোদ সি চৌধুরী (কিশোরগঞ্জ) ছিলেন তার বাবার মামাত ভাই। শৈলজারঞ্জনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি ঠাকুরমার কাছে। সঙ্গীতপ্রিয় পরিবারে বেড়ে ওঠা শৈলজারঞ্জন যৌবনের শুরুতেই কবিগুরুর ভক্ত হয়ে ওঠেন। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর ছিল যাতায়াত। ১৯১৮ সালে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। যতদূর জানা যায়, শৈলজারঞ্জন তাঁর কাকা নিরোদ সি চৌধুরীর বাড়িতেই প্রথম রবিবাবুর গান শোনেন। এরপর শুরু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর নিয়মিত পদচারণা। ১৯৩২ সালে তিনি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীতে যোগ দেন রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে। এক পর্যায়ে সরাসরি কবিগুরুর সান্নিধ্য লাভ এবং কালক্রমে তাঁর সৃষ্ট ‘সঙ্গীত-ভবনের’ দায়িত্ব নিয়ে অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। আজ শৈলজারঞ্জনের জীবন আলেখ্য আঁকার মানসে এ লেখার অবতারণা করছি না। তাঁর মতো এত বড় একজন মানুষের জীবন নিয়ে লেখার অনেকেই আছেন। সে তুলনায় নিশ্চিত আমি নিতান্তই বেমানান। তাঁর জীবনের সবকিছু জানা বা দেখার সুযোগও আমার হয়নি। তবে শৈলজাবাবুর জীবনের শেষ পর্বে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে তাঁকে জানার ও দেখার সূত্রে সৃষ্টি হওয়া কিছু স্মৃতির পাতা আজও উজ্জ্বল। আজ তাঁর জন্মদিনে সেগুলোর মাঝেই কিছুটা ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টায় বিনম্র এ লেখা। শৈলজাবাবুকে নিয়ে আমার স্মৃৃতিপটে এখনও অনেক কিছু অমলিন। বার বার তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নাড়া দেয় মনকে। তখন নিবিষ্ট হই অতীতের সেসব স্মৃৃতি রোমন্থনে। আজ এদিনে আমাদের পরিবার ও নেত্রকোনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শৈলজারঞ্জনের বেশকিছু সময়ের পানে ফিরে তাকানোর ইচ্ছেটাকে সামলাতে পারছি না। যতদূর মনে পড়ছে, ১৯৭৪ সালে শৈলজাবাবু একবার তাঁর জন্মভিটা মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে এসেছিলেন। বন্যার কারণে সেবার তিনি তাঁর বাড়ি অবধি যেতে পারেননি। পরের বছর ১৯৭৫ সালে তিনি আবার আসেন মোহনগঞ্জে। সময়টা সম্ভবত চৈত্রের শেষভাগ বা বৈশাখের সবে শুরু।’ মোহনগঞ্জে আমাদের বাসা তখন একতলা বিশিষ্ট এক দালানবাড়ি। বাড়ির সম্মুখভাগ ও দুই পাশ কাটা-মেহদীর গাছের প্রাকৃতিক দেয়ালে ঘেরা। মনে পড়ে, ফুলগাছের পাতা ছাঁটার বড় কাঁচি নিয়ে ওই কাটা-মেহদী গাছের দেয়ালটাকে নিয়মিত ছেঁটে সুন্দর করে রাখতাম। এখন বাড়িটির সেই অবয়ব আর নেই। সেখানে এখন পাকা দেয়ালে ঘেরা এক দ্বিতল ভবন। যা বলছিলাম, সেই চৈত্র-বৈশাখের এক সকালে সম্ভবত বেলা ১১টার পর রোদ গায়ে জড়িয়ে মেঠোপথ ধরে হেঁটে চলেছেন শৈলজাবাবু তাঁর জন্মভিটার পানে। ধবধবে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিধানে। যেন এক রাবীন্দ্রিক মানুষ হেঁটে চলেছেন। সঙ্গে সঙ্গী রয়েছেন তিন-চারজন। আমার বাবা আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ পেশায় ছিলেন ডাক্তার। পরে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এবং গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন মোহনগঞ্জ এলাকায় রিক্সাও চলত না। তাই আমার বাবা হেঁটে অনেক সময় বয়োবৃদ্ধ রোগীদের দেখতে যেতেন তাদের বাড়িতেই। এটি তিনি করতেন তাঁর পেশাগণ দায়িত্ববোধ থেকেই। যেদিনের কথা বলছি সেদিনও ঠিক এমনিভাবে এক রোগীকে তার বাড়িতে দেখে ফেরার পথে বাবার দেখা হয় শুভ্র সফেদ ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কেন যেন বাবা প্রণাম জানিয়ে নম্রভাবে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। উত্তরে তিনি কেবল বলেন, ‘আমি শৈলজা।’ গন্তব্য কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার জন্মভিটা বাহাম গ্রামে, সেখানে যাব।’ আমার বাবাও তখন তাঁর সঙ্গে বাহাম গ্রামে যেতে চাইলেন। তিনি বাবার পরিচয় জেনে রাজি হলেন এবং বলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, চলেন আমাদের সঙ্গে।’ জন্মভিটা বাহাম গ্রামে পৌঁছেই শৈলজারঞ্জন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁর বাড়িতে তখন উদ্বাস্তুরা বাস করিছল। তারপরও সেই বাড়িতে বসবাসকারীরা তাঁকে ডাবের পানি পান করিয়ে আতিথেয়তা করেন। জন্মভিটার মাটি নিজ কপালে মেখে তিনি বলেছিলেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ কণ্ঠে আফসোসের সুর এনে তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমি নিজের জন্মভূমি থেকে কতদূরে অবস্থান করছি!’ নিজ জন্মভূমিতে আচমকা দীর্ঘদিন পরে এসে শৈলজা বাবুর এই অনুভূতি ও কথাগুলো জেনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা এখন প্রয়াত। নিজ জন্মভিটা থেকে ফেরার পথে শৈলজা বাবুকে আমাদের বাসায় চা পানের আমন্ত্রণ জানালে তিনি রাজিও হন। দুই তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে নিজ জন্মভিটাতে আসতে গিয়ে বোধকরি তিনি বেশ ক্লান্তই ছিলেন। তাই সহজেই আমার বাবার প্রস্তাবে রাজি হন। আমাদের বাসায় এসে বাসার বারান্দায় থাকা একটি কাঠ ও বেতের তৈরি আরাম কেদারায় গা এলিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘কি শান্তির জায়গা। আমার তো ফুরফুরে বাতাস ঘেরা এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।’ যদিও শৈলজা বাবুর থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল স্থানীয় ডাক-বাংলোয়। তারপরও তাঁর মন থেকে বেরিয়ে আসা ইচ্ছেটি জেনে আমার বাবা সুযোগটি হাতছাড়া না করে তাঁকে অনুরোধ করলেন আমাদের বাসায় থাকতে। তিনিও রাজি হন। শৈলজাবাবু সম্ভবত দুই রাত্রি আমাদের বাসায় অবস্থান করেছিলেন। আমার মা ওই দুই দিনেই তাঁর খুব ভক্ত হয়ে ওঠেন। আমার মায়ের বাবা ও শৈলজা বাবুর জন্ম একই সালে। সেজন্যই বোধকরি আমার মা পরম পিতৃশ্রদ্ধায় তাঁর সেবা করার চেষ্টা করছিলেন। শৈলজা বাবু আমার বাবা ও মাকে একসময় বলেন, ‘আমি তোমাদের আপন মানুষ, তোমাদের আপনি বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে হয় না।’ এ কথা শুনে মা-বাবা দু’জনই আনন্দে উচ্ছ্বসিত। মার কাছ থেকে জানতে পারি ওইদিনই বিকেলে বাসার সামনের খোলা জায়গায় ‘স্পন্দন’ ও ‘ছায়ানটের’ স্থানীয় শিল্পীদের এনে আমার বাবা শৈলজা বাবুর সম্মানে এক বিনম্র সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। পরদিন মোহনগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলেও তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। অনাবিল আনন্দে মুখরিত দুটি দিন ফুরিয়ে গেল। দুদিন পরে আমাদের বাসা থেকে শৈলজারঞ্জন বাবু ট্রেনে করে নেত্রকোনা হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন এবং সেখান থেকে কলকাতা। তিনি ফিরে যান কিন্তু রেখে যান মুখর স্মৃতিতে মাখা দুটি দিন। সেবার কলাকাতায় ফিরে যাওয়ার পর শৈলজারঞ্জন বাবু পত্রের মাধ্যমে নিয়মিত আমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এরপর তিনি আরেকবার বাংলাদেশে আসেন। ১৯৮৬ সালের শেষভাগে। সেবারও তিনি নেত্রকোনা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি ৮৬ বছরের একজন বয়োবৃদ্ধ। তাঁর পক্ষে ট্রেনে চেপে মোহনগঞ্জে যাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি আমার বাবার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যেতে চাইছিলেন না। বাবা এটি জানতে পেরে আমাকে, আমার ছোট ভাই (কনিষ্ঠ) সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে ভোর ৫টার ট্রেনে চেপে মোহনগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা আসেন। উদ্দেশ্য ডাকবাংলোয় শৈলজা বাবুর সঙ্গে সাক্ষাত। নেত্রকোনা ডাকবাংলোয় এসে শৈলজা বাবুর পদ স্পর্শ করে আমার বাবা, আমি ও আমার ছোট ভাই শ্রদ্ধা জানাই। তিনি তখন খুব একটা ভাল দেখতে পেতেন না। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে এসেছিল। এ যাত্রায়ও আবার আমার বাবাকে কাছে পেয়ে শৈলজা বাবু বলেন, ‘ডাক্তার আমি জানতুম তুমি না এসে পারবে না, আর তুমি না এলে আমি যেভাবেই হোক তোমাকে দেখতে তোমার বাড়িতে যেতুম।’ কি অপূর্ব বচন! এ যেন মাতৃভূমির প্রতি, জন্মভিটার প্রতি এক অকপট টানের প্রতিফলন। অমি বিস্মিত হই। এবারই আমি তাঁকে প্রথম দেখি। আমাকে ও আমার ছোট ভাই সোহেলকে পাশে বসিয়ে সোহলের শরীর ও মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন- ‘ফুলবাবু তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ, রীতিমতো একজন ভদ্রলোক।’ ১৯৭৫ এ শৈলজা বাবু যখন আমাদের বাসায় দুদিন অবস্থান করছিলেন তখন সোহেল ছয় বছরের শিশু। ওকে তিনি সেসময় ‘ফুলবাবু’ বলে ডাকতেন। এক পর্যায়ে, তিনি আমাকে বলেন, ‘তুমি কি কর?’ বললাম, আমি সবেমাত্র ওকালতি পেশায় যোগ দিয়েছি। একথা শুনে তিনি দু’হাত তুলে আমায় আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। আমিও উকিল হয়েছিলাম, বাবারও ইচ্ছে ছিল আমি ওকালতি করব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আমি গুরুদেবের টানে সঙ্গীতের দিকেই চলে গেলাম।’ আমাকে লক্ষ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থনা করি তুমি অনেক বড় একজন উকিল হও।’ কিছুক্ষণ পরে শৈলজা বাবু এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে প্রাতঃরাশ সেরে সকাল নয়টার দিকে ডাকবাংলো থেকে বিদায় নেই। সেটিই ছিল শৈলজা বাবুর সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। তাঁর সঙ্গে আমাদের কিছু ছবি আছে যা ওসব অমল প্রাপ্তিমাখা সময়কে বিস্মৃত হতে দেয় না। এভাবেই শৈলজারঞ্জন মজুমদার আমাদের পরিবারের খুব কাছের একজন মানুষ হয়ে ওঠেন। আমাদের মনের গহীনে তাঁর অবিরাম বসবাস। আমাদের আত্মার আত্মীয় ছিলেন তিনি। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন তিনি আমার বাবার সঙ্গে পত্রে যোগাযোগ রেখে গেছেন। দীর্ঘদিন পরে শৈলজারঞ্জন বাবু তাঁকে লেখা আমার বাবার একটি পত্র তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ ছেপেছেন। এটি করতে গিয়ে তিনি তাঁর বইটিতে লিখেছেন- ‘মোহনগঞ্জে যে বাড়িতে ছিলাম সেই বাড়ির গৃহস্বামী ডাঃ আখ্লাকুল হোসেইন আহমেদ সস্ত্রীক আমাকে যেভাবে আদর-আপ্যায়ন করেছেন তা কোন দিন ভুলবার নয়। প্রায় দীর্ঘ দশ বছর পরে তার একটি চিঠি পেয়েছি, তিনিও আমায় ভোলেননি। তাঁর চিঠির খানিকটা তুলে দিলাম।’ আত্মজীবনী গ্রন্থে এই কথাগুলো বলে তিনি তাঁকে লেখা আমার বাবার চিঠিটি তুলে ধরেন- মোহনগঞ্জ তাং ২৮-১১-৮৪ পরম শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় মজুমদারবাবু, প্রথমে আমার সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। বহুদিন পর আপনার ঠিকানাটা পেয়ে আপনার চেহারা ও মোহনগঞ্জে অবস্থানকালীন একদিনের কর্মতৎপরতা সবই চোখে ভেসে উঠছে। অনেকদিন যাবতই আপনার খবর নেব ভেবেও ঠিকানার অভাবে পারিনি। যাহোক, আজ শুধু আপনি কেমন আছেন, কি করছেন জানার জন্যই আমার এ চিঠি। আমার স্ত্রী, ছেলেময়ে সবাই আপনার কথা মনে করে। আপনার আমার বাসায় রাত্রিযাপন আমাদের জন্য উল্লেখযোগ্য দিন হয়ে থাকবে। দয়া করে আপনার একখানা ছবি পাঠালে ছেলেমেয়েরা স্মরণ করার সুযোগ পাবে। জন্মভূমিতে আর একবার আসার ইচ্ছা আছে কি-না? আপনার মঙ্গল কামনা করি। ইতি- আপনার ¯েœহের ডাঃ আখ্লাকুল হোসেইন আহমেদ ‘ছায়নীড়’ মোহনগঞ্জ জিং- নেত্রকোনা, বাংলাদেশ। শৈলজারঞ্জন তাঁর এ বইতে আরও লিখেছেন, ‘ইচ্ছে ছিল আবার একবার জন্মভূমিতে যাব কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে সে ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হয়েছিল। মনে পড়ে, তিনি বারবারই বলেছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, ‘আপনারে আর ছাড়ুমই না।’ উত্তরে বলেছিলাম- ‘আমার গ্রামের বাড়িতে উদ্বাস্তু, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়?’ উত্তরে জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ছাইড়্যা দ্যান। আমি আপনারে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডেমিসিল দিমু।’ তিনি বলেছিলেন, আপনার জায়গার অভাব হবে না। সে আমিও আমার অন্তরের অন্ত:স্থলে উপলব্ধি করেছি।’ [সূত্র : ‘যাত্রাপথের আনন্দগান,’ পৃষ্ঠা- ১৪৫ ও ১৪৬] বঙ্গবন্ধুর নির্মম মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শৈলজাবাবুর মতো বহু মনীষীর শত পূতভাবনা, উপলব্ধি ও আকাক্সক্ষা মৃত্যুবরণ করেছে। এখনও শৈলজারঞ্জন বাবুর বাহাম গ্রামের বাড়িটির ব্যাপক অংশ উদ্বাস্তুদের দখলে। এই উদ্বাস্তুদের বিকল্প আবাসন এর ব্যবস্থা করে সেখানে তাঁর নামে একটি একাডেমি করা যায় কি-না তা ভেবে দেখার জন্য যথাযথ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন ও স্থানীয় প্রশাসন সে লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন। সাজ্জাদুল হাসান আমার মেজ ভাই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব। সম্প্রতি সেও শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মভিটা পরিদর্শন করেছে। এটি স্থানীয় জনমনে এক আশার সঞ্চার করেছে। তারা ভাবছে ও প্রত্যাশা করছে সম্ভবত সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় শৈলজা বাবুর বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা সম্ভব হবে। সেখানে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত হবে যা সবাইকে তাঁকে চেনার ও জানার সুযোগ করে দেবে। শৈলজারঞ্জনের জন্মভিটায় তাঁর নামে একটি একাডেমি করে সেখানে বিশুদ্ধ সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চার আয়োজন নেত্রকোনা জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে। আর সেই সঙ্গে মোহনগঞ্জ হয়ে উঠবে দুই বাংলার রবীন্দ্রপ্রেমীদের এক সেতুবন্ধন ও মিলনক্ষেত্র। আমাদের আত্মার-আত্মীয় কবিগুরুর পরম ¯েœহাস্পদ ও আস্থাভাজন বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার অন্যতম ধারক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের গতকাল ছিল ১১৮তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। শৈলজাবাবু চিরকাল আমাদের অন্তরে বিরাজিত থাকবেন।
×