ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপ...

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ২০ জুলাই ২০১৮

বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপ...

বাংলায় এখন ঘোর বর্ষাকাল। সপ্তাহ তিনেক বাকি শরতের। বর্ষার কালো মেঘ, দাপুটে বৃষ্টি- নোনা জলের সমুদ্র হয়ে মিঠাপানির নদীর বাঁকে কিংবা শহরের ঘিঞ্জি গলি পথ বা রাজপথ তুলনামূলক একটু অলস, একটু অসার- বাংলায় বর্ষার এমন প্রভাব আবহমান কাল ধরে। বাংলার চিরাগত এই রূপ এবার বদলে দিয়েছে ফুটবল খেলার সব থেকে বড় আসর ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮। আমাদের জীবনে, যাপনে এমন কি দেহের অভ্যন্তরে শিরা-উপশিরায় ফুটবলের উন্মাদনার স্রোত আপদমস্তক কাঁপিয়েছে। গুনে গুনে আজ পাঁচ দিন বিশ্বকাপের একুশতম আসর গত হয়েছে। এখনও আমাদের হাইপার টেনশন স্বাবাভাবিক হয়নি। বলতে গেলে শেষ দুই মাস সমান উত্তেজনায় আমাদের কেটেছে ফুটবল যুদ্ধের গড়িমায়। যে কারণে বর্ষার ভিজে হাওয়া আমাদের সিক্ত করতে পারেনি। এটা কেবল রূপক অর্থে ব্যাখ্যা নয়! অনেকটা বস্তুবাদের মতোই সত্য। আমাদের দেশ সুবিশাল এই পৃথিবীতে আয়তনে এবং জনসংখ্যায় তুলনামূলক ছোট। কেবল বাংলাদেশের একজন মানুষ হিসেবে গত দুই মাসের হাজারটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমাদের ভৌগোলিক সীমানা থেকে উল্লেখ করতে পারি, আর সারা পৃথিবীর হিসাব কষলে তো কয়েক খ-ের পা-ুলিপি হয়ে যাবে! কি উত্তর, কি দক্ষিণ কিংবা যদি আর কোন মেরু থাকত! কোন মেরুই বাদ যেত না ফুটবল খেলার এই উষ্ণতা ধারণের ক্ষেত্রে। সত্যই তো! যাবেই বা কেন খেলাটা যে ফুটবল। শীতল রক্ত উষ্ণ করার খেলা। কে না বোঝে কার না পছন্দ এই খেলা! পৃথিবীতে যত দেশ, যত জাতি আছে সবারই ইচ্ছা এই আসরে নিজেদের জার্সি এবং পতাকা তুলে ধরার। ফুটবলের অন্যান্য আসরের থেকে এই আসরে অংশগ্রহণ সর্বাধিক গর্ব এবং মহিমার অধ্যায়, বিশ্বজুরে আলোচিত হওয়ার অধ্যায়। বিশ্বকাপ ছাড়াও আরও অনেক আঞ্চলিক বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট বছরের কোন না কোন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোপা আমেরিকা, ইউরো কাপ কিংবা অলিম্পিক ফুটবল ছাড়াও অন্য যে কোন প্রতিযোগিতামূলক খেলার আসর- রং, রূপ বা জৌলসে বিশ্বকাপ ফুটবলের কাছে মলিন। যে কারণে বিশ্বকাপ এলেই আমাদের চোখ বড় হয়, কান খাড়া হয় এবং আবেগের প্লাবনে ভেসে যায় বুক। আমাদের হৃদয়ে একুশতম বিশ্বকাপ তারিখ, ভেন্যু, দেশ এবং সময় সবই আমাদের আগে থেকেই ছিল জানা। পছন্দের দলও ছিল বহু আগে থেকেই ঠিক করা। জুন মাসের ১৫ তারিখ শুরু হবে ফুটবল বিশ্বকাপের একুশতম আসর। তার আগেই সিরিয়াল দিয়ে লম্বা গজ কাপড়ের পতাকা এবং জার্সি আমাদের গায়ে এবং বাড়ির ছাদে সমানে শোভা পেয়েছে, কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত বহুতল ভবন প্রিয় দলের পতাকার আদলে সজ্জিত করা হয়েছে। মাইলকে মাইল মোটরগাড়ি শোভাযাত্রা ছিল নিত্য ঘটনা। ভাবলে অবাক হতে হয় চার বছর পর পর এই খেলা নিয়ে যে উন্মাদনা, আনন্দ-ফুর্তি দেখা দেয় তা যে কোন উৎসবকে হার মানায়। গ্রামের ছোট বাজারের প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার পথে বিশাল পতাকা! প্রায় দোকানের চালে আলাদা আলাদা পতাকা, চায়ের দোকানে ফুটবল ভক্তরা টেবিল চাপরে শক্ত গলায় হাঁকছে এবার হবে! দেখিয়ে দেবে, গেল বারের মতো এবার আর নয়। এবারের টিম দেখেছ, কোচ কে জান? কার দোকানে কত বড় কিংবা কার বাড়িতে কত বড় টিভি আছে, এমন রঙ্গ ব্যঙ্গ এবং উত্তেজনাকর প্রাক আবহাওয়া গ্রামীণ জনপদ হয়ে শহুরে পাত্থরে জীবনে চার বছর পর পর সমান ধারায় প্রবহমান। অন্য বারের তুলনায় এবারে খেলা দেখার সময়টা ছিল বেশ স্বাছন্দ্যের। অফিস শেষ করে বিকেল থেকেই পরিবার পরিজন কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুটবলে জমে ক্ষির হতে দেখা গিয়েছে। সত্যি বলতে কি শহুরে যান্ত্রিক জীবন বা ফ্যাকাসে গ্রামীণ জীবন কিংবা দ্বান্দ্বিক রাজনৈতিক জীবন সবক্ষেত্রে ফুটবল বিশ্বকাপের রঙিন আভা ছিল দারুণ চমকপ্রদ! বাস্তবতা এমন ছিল যেন যা হোক না কেন পরে দেখা যাবে, আগে বিশ্বকাপটা উপভোগ করে নিই! এটা যদি মোহ হয়ে থাকে তার পরও মানুষ সচেতন থেকে মোহাবিষ্ট হয়েছে। এই যেমন বিশ্বকাপকালীন-দেশ, সমাজ, রাজনীতি, দুর্নীতি, পারিবারিক কলহ এক কথায় সব ধরনের অশুভ কালো ছায়া আমাদের খুব একটা তাড়িত করেনি বরং সব ধরনের কালো ছায়া ঢাকা পড়েছিল খেলার রঙিন পাতায়। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে একটা গল্প বলি, বন্ধুর দেশের বাড়ি হওয়ার সুবাদে গল্পটা জেনেছি, দেশের উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রাম। বর্ষা এলে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ী ঢল কিংবা ফারাক্কা-তিস্তার পানির তোড়ে প্রায় বছর এই সময়ে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মোগলকাটা কুড়িগ্রামের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজারের নাম। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মোগলকাটা নদী। নদীর নামেই এই বাজার। ছোট নদীতে এখন অনেক পানি। ক্ষেতে মানুষজন এখন কম যায় কারণ বেশিরভাগ জমি পানির নিচে, শুষ্ক মৌসুম ছাড়া মাঠে সকলের একসঙ্গে কাজ করা হয়ে ওঠে না। যে কারণে গত মাসখানেক ধরে মোগলকাটা বাজারে সকাল-সন্ধ্যা মানুষের আনাগোনা বেশি। এই বাজারের ব্যবসায়ী খোকন মোল্লা বয়স চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ হবে দুই মেয়ে-এক ছেলে। বাজারে একটা মুদিদোকন ছাড়া আর কোন আয়ের পথ তার নেই। গেল বৈশাখে সুদে লাখখানেক টাকা স্থানীয় সমিতি থেকে নিয়ে দোকানে মাল তুলেছেন। গ্রামীণ চর্চা দোকান থেকে বাকি নেয়ার কারণে, টাকা খাটিয়েও ব্যবসায় ভাল করতে পারছে না। যে কারণে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, সংসারের বাজার এবং সমিতির সুদ-আসলের টাকা এসবের কোন কিছুই ঠিকঠাক মেটাতে পারছে না। সংসারে অশান্তি। এসবের ভেতরে থেকেও খোকন মোল্লা ভীষণ আমুদে চরিত্রের এবং একজন পাগলাটে ফুটবলপ্রেমী। গত সাতটা বিশ্বকাপ ধরে সে মনেপ্রাণে আর্জেনটিনাকে সর্মথন করে আসছে। জীবন সংসারের সকল বাস্তবতা তাকে নিমজ্জিত করলেও ফুটবল খেলা তাকে উজ্জীবিত করে। এবার সে আগেই ঠিক করে রেখেছে খেলা শুরুর আগে একটা বড় টেলিভিশন কিনবে। তাতে যে সমস্যাই তার হোক! জুনের প্রথম সপ্তাহে সে পুনরায় সমিতি থেকে টাকা নিয়ে ওয়ালটনের একটা কুড়ি ইঞ্চি টেলিভিশন কেনে। খোকন মোল্লার স্ত্রী এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত করেনি কারণ সে জানত তার স্বামী বিশ্বকাপ ফুটবলের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। গত ষোলো জুনের কথা রাত বারোটায় গ্রুপ পর্বের ম্যাচ আর্জেন্টিনা বনাম নাইজিরিয়া। শেষ দুই ম্যাচে ফলাফল ভাল করতে না পারায় এই ম্যাচ ছিল আর্জেন্টিনার জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। জিতলে দ্বিতীয় রাউন্ড আর হারলে আসর থেকে বাদ। যে কারণে ওইদিন ভীষণ উদ্বেগ এবং উৎসাহ দুটোই খোকন মোল্লার ভেতর কাজ করছিল। নিজের ক’জন বন্ধু এবং বাজারের আরও কয়েকজনকে আগেই বলে রেখেছে আজ সে বাড়ি নয় দোকানে খেলা দেখবে। তার কথায় আরও আট-দশ জন রাজি হয়ে যায়, এক সঙ্গে খেলা দেখবে। অবাক করার বিষয় হলো খোকন মোল্লার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, যে ভাবেই হোক আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে! উপস্থিত কারও কাছ থেকে টাকা না নিয়ে নিজের পকেট থেকে তিনটা মুরগি আর দোকানের চাল-ডাল দিয়ে এক হাঁড়ি খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা করে। বাজারের বেশিরভাগ দোকান সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। দশটার দিকে দোকানেরে একপাশ বন্ধ করে রান্না শুরু করে, ভীষণ উৎসব উৎসব ভাব তার চারপাশে এবং মনের ভেতর। খেলা শুরু হতে হতে রান্নাও শেষের পথে। এদিকে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়াতে মোবাইল ফোনে না পেয়ে ছেলেকে নিয়ে বাজারে রওনা হয় খোকনের স্ত্রী। খেলা তখন টান টান উত্তেজনায় মেসি মাঝ মাঠ থেকে কিক করে সরাসরি জালে বল ঢুকিয়ে দেয় গোল... বলে চিৎকার করে খোকন আনন্দে কেঁদে ফেলে, তার টেলিভিশনের ওপর আকাশী রঙের জার্সি পরা মেসির বড় একটা ছবি ঝুলানো। বউ এসেছে স্বামীর খোঁজে কিন্তু যখন দু’জন-দু’জনার মুখোমুখি খোকন মোল্লার চোখ তখন ভেজা। গ্রামীণ মহিলা ভরা সভায় কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্বামীর এই রূপ দেখে সে লজ্জায় দাঁড়াতেও পারছে না। স্ত্রীকে দেখে খোকন বলে, ‘তোরে কইছিলাম না বউ মেসি আইজ গোল দেবে, ওই দেখ আবার দেখায়।’ এর মধ্যে কে যেন দুই প্লেট খিচুড়ি তার স্ত্রী এবং ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয়। খোকনের বয়ানে তার স্ত্রীর চোখও সে সময় জলে ভরে গিয়েছিল, আর্জেটিনার বিজয়ে না কি স্বামীর আনন্দে! সে হয়ত নিজেও জানে না, ওই মুহূর্তে সে ভুলেই গিয়েছিল কি রাগ নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল... এমনই নিষ্পাপ আবেগে গত এক মাস আমরা ফুটবলে মেতেছি জীবনের কঠিন বাস্তবতাও এই উন্মাদনার কাছে হার মেনেছে। আমাদের শহুরে জীবনে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রভাব বরাবরই ভীষণ পাগলাটে। এবারে বিদেশ থেকে প্রেস এসে নিউজ কভার করে গেছে। বোঝেন এবার কোথায় পৌঁচ্ছে ছিল শহুরে পাগলামি! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে অফিসপাড়া আতোশ বাজির মতো ঝলমল করত বিশ্বকাপের আলোচনা। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর বিদেশী পতাকায় ছেয়ে গিয়েছিল খেলা শুরুর বেশ আগে থেকেই। ওপর থেকে দেখে মনে হয়েছে প্রত্যেকটা শহর যেন এক একটা উৎসবের নগরী! মেসি, রোনালদো, নেইমার, সুয়ারেজ, কাভানি, মদ্রিচ, হ্যাজার্ড, লুকাকু, হ্যারি কেইনসহ অনেক উচ্চারণে কষ্টসাধ্য নাম শহরের গলি পথ হয়ে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কলরব সৃষ্টি করেছে দীর্ঘ একটি মাস। যে খেলা বা আসর নিয়ে আমরা মেতেছিলাম বিশ্বব্যাপী সেই খেলায় আমাদের সামর্থ্য বা অবস্থান ভুলেও মনে করিনি। তার মানে কোন ধরনের নেতিবাচক চর্চা আমাদের ঘায়েল করতে পারেনি। পছন্দের দল বা প্রিয় তারকা নিয়ে যে সব উগ্রবাদী, জীবনঘাতী কর্মকা- ঘটেছে সেগুলো রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে বিশ্বকাপের মাধুর্য নষ্ট করতে চাই না। কারণ, যে বা যারা ওই সব অসভ্য কাজ ঘটিয়েছে তারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে কোন পর্বে এসব কাজ ঘটাতে পারত বা আগামীতে ঘটাবে। কাজেই ওদের কর্মকা- লেখায় উল্লেখ করে খেলাকে বিতর্কিত করার কোন মানে আমি খুঁজে পাই না। বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপ চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আবেদন পৃথিবীব্যাপী সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। ফিফার তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা প্রমাণের খেলা অনেকটা সময় জুড়ে অগণিত ফুটবলপ্রেমীদের ভীষণভাবে কৌতূহলী করে। ফিফার সদস্য দেশ ২০০, এদের মধ্যে থেকে মাত্র ৩২টি দল চূড়ান্ত পর্বে খেলার সামর্থ্য অর্জন করে। এবার বলেন, কেন বিশ্বজুড়ে এই বিশ্বকাপের উত্তাপ। যদিও এ তথ্য নতুন কিছু নয়, তার পরও... দেখতে দেখতে একুশটি বিশ্বকাপ পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। ইতিহাসের সময় পেরিয়েছে প্রায় এক শ’ বছর! এই বিশ্ব উন্মাদনার একটু প্রাক আলোচনা করা দরকার তাহলে বিয়টা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথম বিশ্বকাপ হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়ের রাজধানী মন্টিভিডিওতে। প্রথমবার কোন কোয়ালিফায়িং পর্ব ছিল না, অনেকগুলো ইউরোপিয়ান দেশকে সরাসরি খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ফিফা। কিন্তু জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মন্টিভিডিও যেতে সে যুগে সময় লাগত দু’সপ্তাহ। তাই ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে এত দূর যেতে রাজিই হয়নি অনেক ইউরোপিয়ান দেশ। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪টি ইউরোপীয় দেশ গিয়েছিল তারা হলো : বেলজিয়াম, রোমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া আর ফ্রান্স। ব্যবস্থা হয়েছিল, একই জাহাজে চেপে একাধিক ইউরোপিয়ান দেশের খেলোয়াড়রা মন্টিভিডিও যাবেন। রোমানিয়া দলটি ‘এসএস কন্তে ভার্দে’ নামের জাহাজে উঠেছিল ইতালির জেনোয়া বন্দর থেকে। ১৯৩০ সালের ২১ জুন ফ্রান্সের ফুটবল দল জাহাজে উঠল ভিয়েফ্রাঁসে-সু-মে বন্দর থেকে। শুধু তাই নয়- সে জাহাজে আরও উঠলেন ফিফার প্রেসিডেন্ট জুল রিমে স্বয়ং, নেয়া হলো প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটি, এবং তিনজন রেফারিকে। পথে বার্সেলোনা থেকে সেই জাহাজে উঠল বেলজিয়াম দল। আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পর রিও ডি জেনিরো থেকে ব্রাজিল দলটিও উঠল একই জাহাজে। চৌদ্দ দিনের সাগর ভ্রমণ শেষে ৪ জুলাই এরা সবাই মন্টিভিডিও পৌঁছলেন। এর সঙ্গে তুলনা করুন এবারের বিশ্বকাপের- মস্কো থেকে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরের অস্ট্রেলিয়া বা আর্জেন্টিনা থেকে বিশ্বকাপ দলের বিমানে করে রাশিয়া পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ১৮-১৯ ঘণ্টা। তথ্য সংগৃহীত বিবিসি বাংলা। সেই ১৯৩০ থেকে ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ বিশ্ব মাতিয়ে আসছে। এবারের বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অনেকগুলো ঘটনা বিশ্বব্যাপী মানুষকে আলোড়িত করেছে এর মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দেশ ইতালির বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ না হওয়া। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই এই খবর ছিল আশাহতের মতোই। কেননা লুইজি রিভা, ফাবিও কান্নাভারো, রর্বাতো বেজিও কিংবা ফ্রান্সিসকো টট্টির দেশ ইতালি ফুটবল বিশ্বকাপের অলঙ্কার। সেই দেশ যখন রাশিয়া বিশ্বকাপে অনুপস্থিত তখন আলোচনা এবং গুরুত্ব দুটোই সমান হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৩য় স্থানের দল ন্যাদারল্যান্ডস শক্তিশালী চিলি, চেক রিপাবলিক, ঘানা, হাঙ্গেরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মতো আরও অনেক নামকরা দল এবারের আসরে নিজেদের পতাকা তুলতে ধরতে পারেনি। তবে গত কয়েক বারের মতো এবারও বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধা আগেই ধারণা করেছিল বিশ্বকাপ এবারো ইউরোপে থেকে যাবে কিন্তু জার্মানির মতো পরাক্রমশীল দল নিজেদের ৮৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সঙ্গে এশিয়ান ক্ষুদে মানব কোরিয়ানদের ধন্য ধন্য বলেছিল। বার্লিনের একাধিক পত্রিকায় যেভাবে যে ভাষায় খবরের শিরোনাম ছেপেছিল তা ছিল বিশ্ববাসীর কাছে আর এক নতুন চমক। একটা দুটো উল্লেখ না করলেই নয়। ‘বার্লিন এইজ’ নামে জার্মান দেশের এক পত্রিকা শিরোনামে লিখেছে ‘লিলিপুটদের কাছে গালিবারদের হার’ এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না, বার্লিনের আর একটা পত্রিকা শিরোনাম করেছিল, পুরো একটা কালো পৃষ্ঠা মাঝখানে একটা ঝুলন্ত ফাঁসির দড়ি, নিচে লেখা ঝুলে পড়... সারা পৃথিবীতেই এই শিরোনাম মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এভাবে উল্লেখ করলে অসংখ্য ঘটনা সামনে চলে আসবে আসলে মূল কথা হলো এই বিশ্বকাপ বিশ্বকে যেভাবে মাতিয়েছে তাতে করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধনী দেশের কোন রাজকীয় প্রাসাদের অন্দর মহল সমানভবে আলোড়িত করেছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিশ্বকাপ যদিও গত ষোলো বছর লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ যায়নি তার পরও মোস্ট ফেবারিট দলের কাতারে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের নাম খুব জোরের সঙ্গেই উচ্চারণ হয়েছে। ছোট ছোট পাস, শৈল্পিক ছন্দ এবং দৃষ্টিনন্দন শট লাতিন আমেরিকার ফুটবল মাহাত্ম্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে ইউরোপিয়ান পাওয়ার ফুটবলের কাছে এখন আর এই ক্লাসিক ফুটবল খুব একটা সফল হচ্ছে না। যে কারণে, নাভিশ্বাস তুলে নেইমার, মেসি, সুয়ারেজ কিংবা কাভানি করে করে চিৎকার করলেও চূড়ান্ত পর্বের অনেক আগেই গলার স্বর সংযোমিত করতে হয়েছে বিশ্বজুরে লাতিন ভক্তদের। আসরের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে এবারের বিশ্বকাপ ইউরোপীয় বিশ্বকাপ। স্বাগতিক দেশ রাশিয়া সবার আগে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে নিজের দেশ এবং সারা পৃথিবীর মনোযোগ কেড়েছে। তিন বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ভীষণভাবে চমকে দেয় টুর্নামেন্টের রানারআপ টিম ক্রোয়েশিয়া। এই নবীন দেশ বিশ্বকাপ খেলতে আসার বিশ বছরের মাথায় নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করে বিশ্ববাসীর মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে নিঃসন্দেহে লুকা মদ্রিচ, হ্যাজার্ডদের দল, বাকি ভালবাসা কুড়িয়েছে সে দেশের সুন্দরী ভদ্রমহিলা প্রেসিন্ডেটের বিনয়ী আচরণের সুবাদে। সত্যই ক্রোয়েশিয়ান খেলোয়াড়রা অভাবনীয় দিগি¦জয়ী ফুটবল খেলে বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছে অন্য দিকে বেলজিয়াম নিজেদের ইতিহাসে এবারের বিশ্বকাপ আসরে ৩য় স্থান করে নেয়ায় ব্রাইনা, লুকাকুরা হৃদয় নিংড়ানো সম্ভাষণ পেয়েছেন। কোন কোন জার্নালে পরিষ্কার লিখেছে এবারের বিশ্বকাপের সেরা দল বেলজিয়াম। কিন্তু ভাগ্য দেবতা তাদের সেই যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়ত করেনি! এদিকে এশিয়ার আর এক দল জাপান এবং তরণ ইল্যান্ড দল অভাবনীয় ভাল করেছে। সব ছাপিয়ে একুশতম বিশ্বকাপ জিতেছে ফরাসীরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে লাতিন আমেরিকার শক্তিশালী দল অর্জেন্টিনাকে যখন চার দুই গোলে নাস্তানাবুদ করে তখন ফরাসী খেলোয়াড়দের গতি, কৌশল এবং ক্ষিপ্রতা ফুটবল বিশ্বের নজর কেড়ে ছিল। পল পগবা, এমবাপের মতো অভিবাসী খেলোয়াড়দের রক্তজল করা পরিশ্রমে ফরাসীদের দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন পূরণ করেছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের হেড কোচকে নিয়ে আলোচনা ছিল ফাইনালের আগে এবং শিরোপা জেতার পরের বিশেষ পর্ব। ফ্রান্স যখন প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে সে বারের বিশ্ব সেরার দলের প্রধান ছিলেন এই ‘দেশমকে ভয় ক্রেসপোর’ এবারে বিশ্বসেরা দলের এই হেড কোচের কৃতিত্ব ফিফার ফুটবল ইতিহাসে বিরল! সব মিলিয়ে আরও অসংখ্য উল্লেখযোগ্য নিদ্রা হরণ করার মতো ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ বিশ্ব রঙে মাত করেছে... যে রং পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ-বেদনার অশ্রু হয়ে মোগলকাটা নদী হয়ে আফ্রিকার নীল নদে গিয়ে পৌঁছেছে।
×