ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিটন আব্বাস

এক মমতাময়ী মা কাজী শেলী

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২০ জুলাই ২০১৮

এক মমতাময়ী মা কাজী শেলী

এই হলেন সত্যিকার সমাজকর্মী। সমাজের মা-রাষ্ট্রের মা। ১৫০ জন এতিম শিশুর মা হয়েছেন। যা বাংলাদেশে বিরল। এতিমদের প্রতেক্যের জন্মনিবন্ধন, বিবাহসনদে নিজেকে মা এবং স্বামী সাজ্জাদ আলমকে পিতা হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। এদের অধিকাংশ ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। এতিম কন্যারা বড় হয়েছে তাদের বিয়ে হয়েছে এবং তারা সুখে আছেন, এমনকি কর্মেও সমান পারদর্শী। তাদের কেউ কেউ ব্যাংকে চাকরি, কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়, সংগীত বিদ্যালয়েও পড়েছে। মহান এ কাজ করে চলেছেন শিরিন আক্তার। যাকে কাজী শেলী হিসেবেই সবাই চেনেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় কাজী শেলীর মধ্যে দরিদ্র অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তার ইচ্ছে ও স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কাজী শেলী ১৯৯২ এসএসসি পাস করেন ঢাকার কুর্মিটোলা স্কুল থেকে। ১৯৮৯ সালে স্কুল জীবনে আন্তঃথানা ভলিবলে চ্যাম্পিয়ন হয় শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সঙ্গে। তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি ও টঙ্গী সরকারী কলেজ থেকে স্নাতক এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৯৭ সালে মহাখালী কড়াইল বস্তিতে আরবান প্রজেক্টে স্যানিটেশন প্রোগ্রামে কাজ করেন। ২০০০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে সমাজকর্মী হিসেবে ময়মনসিংহের ১৩টি ইউনিয়নের বিভিন্ন নারী ও শিশুদের ওপর উন্নয়নমূলক কাজ করেনÑ সেই সময় প্রশিকার কাজী ফারুক, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনদের সঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির স্বাক্ষর অভিযানে স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মীর কাজও করেছেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম পদক্ষেপ কনসোর্ডিয়ামের সঙ্গে এইডস প্রোগ্রামে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে উত্তরবঙ্গের ৭টি জেলায় সচেতনতামূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৬ সালে শ্রীপুর গাজীপুরে পরিচালিত ব্রিটিশ হোম ফ্যামিলি ফর চিলড্রেন ‘শিশুপল্লী’তে প্যাট্রিয়াসিয়া কারের অধীনে সমাজকর্মী হিসেবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালে ফ্যমিলিজ ফর চিলড্রেন কানাডার একটি হোম যার দায়িত্বে ছিলেন সান্ড্রা সিম্পুন সেখানে তিনি সমাজকর্মী হিসেবে এভান্ডেন্ট চাইল্ডদের পুনর্বাসন প্রোগ্রামে কাজ করেন। তিনি ১৫০ জন এতিম ছেলেমেয়েদের আইনী অভিভাবক হন। ২০০৯ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন জারি করেন তখন ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন, কানাডার হোম ঢাকার উত্তরায় ১৫০ জন ছেলেমেয়ের বাবা-মা হয়ে জন্মনিবন্ধন করান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়ে। এসব ছেলেমেয়ের মধ্যে অনেকই ১২ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সীও ছিল। নিবন্ধনে প্রত্যেকের মা হিসেবে কাজী শিরিন আক্তার শেলী ও পিতা হিসেবে তার স্বামী সাজ্জাদ আলমের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে তিনি ও তার স্বামী আজও তাদের আইনী পিতা-মাতা। আজ সেই সব ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আজহারুল ইসলাম অকোপেশন থেরাপিস্ট হিসেবে ঢাকার মিরপুরে কাজ করছেন। আরেকজন মাসুম বিল্লাহ বেসরকারী চাকরি করেন। নার্গিসসহ ক’জন নার্স আছেন ঢাকায় বেসরকারী হাসপাতালে। রিমি, রিনা নামে দু’জন অকোপেশন থেরাপিস্ট, সাভার সিআরপিতে কর্মরত আছেন। এ রকম আরও অনেকে আছেন যারা সবাই ছোট ছোট কাজ করে স্বনির্ভর হয়েছেন। এ পর্যন্ত পাঁচজন মেয়েকে নিজে বিয়ে দিয়েছেন। তার মধ্যে দু’জন বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান গাজীপুর কেয়া কসমেটিক্সে ৮০০ জন বাকপ্রতিবন্ধীর মধ্যে তারাও কাজ করেÑ এর মধ্যে রাবেয়াকে বিয়ে দিয়েছেÑ রাবেয়া ও তার স্বামী দু’জনেই বাকপ্রতিবন্ধী। এ ছাড়া ৬০ জন ছেলেমেয়ের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে এ্যাকাউন্টও করে দেন কাজী শেলী সেখানেও পিতা-মাতা হিসেবে যথারীতি তারাই। এই হলেন সাহসিকা নারী মমতাময়ী সমাজমাতা শিরিন আক্তার কাজী শেলীর কাজ। এরপর তিনি ঢাকা থেকে স্বামীর কর্মস্থল চট্টগামে চলে যান গত ৩ বছর আগে। বর্তমানে চট্টগ্রাম সীতাকু- আবুল কাশেম রাজা হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি লাইব্রেরি এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের লাইফ টাইম সদস্য। ভবিষ্যতে এখানে কাজ করবেন বলে লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার্সও করছেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মনোনীত স্যাকাইপ প্রোগ্রামেরও সংগঠক তিনি। মানবতার এই মা ১৯৭৬ সালে ঢাকার খিলক্ষেতে কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও মা জান্নাতুল মেওয়া। দাদা কাজী আলী আহমেদ তার জন্মের পর মন খারাপ করেছিলেন। কিন্ত সেই মেয়েই তাদের পরিবারে উচ্চ শিক্ষিত এবং তার নামেই এখন এই পরিবার পরিচিত। তার আক্ষেপ দাদা তার কাজ দেখে যেতে পারেননি। পরিবারে মেয়ে যে অভিশাপ নয় আশীর্বাদ এখন তা প্রমাণিত হচ্ছে ঘরে ঘরে। কাজী শেলীও মনে করেন, মেয়ে ছেলে কিসের এত বিভেদÑউভয়ই মানুুষ। প্রত্যেকে স্ব-স্ব মেধা, যোগত্যা, দক্ষতা, মানবতা এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করলে দেশ ও মানুষ নিশ্চয় প্রাগ্রসর হয়। এনজিওর মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন ফলে ঢাকায় এই ১৫০ জন এতিম শিশুর মা হতে পেরেছেন এবং তাদের নাগরিকত্বও করাতে পেরেছেন এই জ্বলন্ত মহীয়সী। এই অবদান অসামান্য। তিনি মানবতার আধুনিক অগ্রদাত্রী। সত্যিকার মানবতার মা। শর.ষরঃড়হ৮৪@মসধরষ.পড়স
×