ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজিব ওয়াদুদের ছোটগল্প ॥ বাঁক ও বিন্যাস

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২০ জুলাই ২০১৮

নাজিব ওয়াদুদের ছোটগল্প ॥ বাঁক ও বিন্যাস

নাজিব ওয়াদুদ গল্প লেখেন, স্বদেশ, স্বকাল আর একেবারে নিজ অভিজ্ঞতার জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে। যেন এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। তার গল্প পাঠ ও পর্যালোচনা করে আমরা যা পাই, তা যেন আমাদের চারপাশের চেনা মানুষ, প্রকৃতি সময় আর সমাজের কথা। চরিত্রগুলো যেন এই প্রকৃতি জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষজন। গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ যেন গল্প লেখেন এই অঞ্চলের, সমাজ আর সময়চিত্রকে চিহ্নিত করতে। আমরা তার কসাই গল্পটা যদি পাঠ করি দেখতে পাব একটা গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের জীবন চিত্র। কিন্তু জীবন তো বহমান নদীর স্রোতের মতো এত সরলরৈখিকভাবে প্রবাহিত হয় না। জীবনের বাঁক থাকে, বাঁধা আসে আবার জীবন তার নিজের মতো করে বিন্যস্তও হয়। তাই বোধকরি লেখক আমাদের তার কসাই গল্পের মধ্য দিয়ে এক হারেজুদ্দীনের গল্প শোনাতে গিয়ে তিনটি গল্প একসঙ্গে গেঁথেছেন। এই গল্পে আমরা একই সঙ্গে পাচ্ছি হারেজুদ্দীনের সুন্দরী মেয়ে নছিমনের গল্প, রক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত পুত্রের গল্প এবং পুত্র¯েœহে লালিত দুইটা বলদের গল্প। আমরা কসাই গল্পের শুরুতে দেখছি নছিমনের বিয়ের আয়োজন। বিয়ের জন্য পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা যোগাতে হাঁপিয়ে ওঠা পিতা, এই টাকা যোগাড়কে সামনে রেখেই আমরা হারেজুদ্দীনের পুত্রের গল্প শুনতে পারছি। শুনতে পারছি, রক্ষী বাহিনী স্কুলের মাঠে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে হারেজুদ্দীনের পুত্রকে খুন করার বয়ান। তার অপরাধ সে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। কী করতে চায়? হারেজুউদ্দীন সহজ সরল মানুষ, অতশত বুঝে না; তবে তার ছেলের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে। হারেজুদ্দীনের পুত্রের গল্পে এসে আমাদের মনে জিজ্ঞাসা জাগে, গল্পকার কী হারেজুদ্দীনের সরলতা নিয়ে পাঠকেও ফাঁকি দিতে চাচ্ছেন? ছেলেটা দেশের জন্য কী করতে ছেয়েছিল। প্রশ্ন আসতে পারে গল্পকার আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস শোনাবার দায়িত্ব নেন নাই। দায়ত্ব নিয়েছেন গল্প নির্মাণের। আবার তার বিপরীত কথাটাও আমরা বলতে পারি, গল্পের বিষয়ে যখন ইতিহাস আসবে তখন শিল্পের দায়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের দায়টাও সমান তালে সামলাতে হয়, তবেই শিল্পের পরিপূর্ণতা আসে। আবারও কসাই গল্পে ফিরে আসা যাক, এত বাঁকের মধ্যেও গল্পটা শেষ পর্যন্ত দুইটা বলদের গল্প, যে বলদ দুটোকে হারেজুদ্দীন তার সন্তানের মতো করে লালন পালন করেছে। সেই বলদকে বিক্রি করতে হচ্ছে মেয়ের যৌতুকের টাকা মিটাতে। কিন্তু সেই বদলকে তিনি কোন কসাইয়ের কাছে বিক্রি করবেন না, বিক্রি করতে চান কোন গিরস্তের কাছে যারা তার বলদ দুইটাকে তার মতোই পরম মমতায় লালন পালন করবে। হ্যাঁ, তিনি তাই করলেন। গরু বিক্রি করলেন হারু কবিরাজের কাছে। কিন্তু এই পুঁজিবাদী সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্কটাই যেখানে মুনাফার শৃঙ্খলে বাঁধা সেখানে এক হারেজুদ্দীনের পশুপ্রেমের মূল্য কোথায়! হারু কবিরাজ থেকে গরুর দাম আনতে গিয়ে হারেজুদ্দীন দেখে তার পুত্র¯েœহে পালিত বলদের ছাল চাড়ছে কসাই! গল্পটা পড়তে গিয়ে আমরা তারাশঙ্করের বিখ্যাত গল্প কালাপাহাড় ধলাপাহাড় গল্পের সাদৃশ্য খুঁজে পাই। এই সাদৃশ্যের ব্যাপারটা সাহিত্যের জগতে অপরাধ কিংবা নতুন কিছু নয়। একটা মহৎ সাহিত্য নতুন একটা সৃষ্টিকে অনুপ্রাণিত করবে এটাই তো স্বাভাবিক। যেভাবে কালিদাসের শকুনতলা পাঠে অনুপ্রাণিত করেছে মহাকবি গ্যাটেকে দ্য ফাউস্ট লিখতে। আমরা শিল্পের ভাব বিনিময় নয়, বরং ভাবনার বির্নিমাণ নিয়ে কথা বলতে পারি যেখানে সবচেয়ে বেশি ফাঁকিবাজিটা থাকে। সেই সূত্রে আমরা এবার আলোচনায় আনতে পারি লেখকের আরও দুটি খুন গল্পটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে লেখা গল্প। গল্পটা পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয় এই তো যেন গল্প নয়, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। এ দেশের বুর্জোয়া ছাত্র সংগঠনসমূহের নষ্ট রাজনীতি কিংবা রাজনীতির নামে দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ এমন কোন অপরাধ নেই যা তারা প্রতিমুহূর্তে করছে না। আর নাজিব ওযাদুদ-এর শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে গল্পটা আমরা দেখলাম। এই যেন ছাত্র রাজনীতিকেও আরেক ধাপ ছাপিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক বিপতœীক অধ্যাপক, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে চান, এই ভিসি হতে গিয়ে যিনি জড়িয়ে পড়েছেন বর্তমান ভিসির সঙ্গে দ্বন্দ্বে। তিনি আবার একটা পীরের মুরিদ, একই সঙ্গে একসময়ের তুখোড় বামপন্থী ছাত্রনেতা এবং তাত্ত্বিক। আমার দেখছি অধ্যাপক তার অনুগত ছাত্রদের দিয়ে ভিসিপন্থী এক ছাত্রকে খুন করাচ্ছেন আবার নিজে হাতে খুন করছেন তার তরুণী প্রেমিকা শিরিনকে। অধ্যাপকের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের ফলে শিরিন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে বিয়ে করতে পিড়াপিড়ি করতে থাকে, মিলনকালীন সময় শিরিনকে হত্যা করেছে অধ্যাপক। তার আগে আমরা দেখছি ছাত্রহত্যায় জড়িত থাকার ব্যাপারটা শিরিন জেনে যাচ্ছে। দুটি ঘটনা পাশাপাশি হয়ে যাওয়ায় আমরা ঠিক বুঝতে পারি না, কোন কারণটা শিরিনের জন্য কাল হলো। তদরূপ আমরা বুঝতে পারি না, এই ধর্ষকামীপ্রবৃত্তির অধ্যাপকের পাঠকের মাঝে বামপন্থী পরিচয়টা এভাবে তুলে ধরার কারণ কি? এটা তো সহজ কথা যে আস্তিক হওয়া আর ধার্মিক হওয়া এক কথা নয়। ঠিক তেমনে মার্কসবাদী তথ্যজ্ঞানী হওয়া আর ব্যক্তি মানুষ মার্কসবাদী হওয়া এক কথা নয়। তা ছাড়া এই সত্য কার অজানা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হবার মতো পদের জন্য তারাই শুধু দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে যারা শাসক শ্রেণীর রাজনীতির অংশ। বামপন্থীরা তো ক্ষমতার মসনদে বসার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি। তবে কী লেখক গল্পটা লেখেছেন তার রাজনৈতিক মকসুদ হাসিলের জন্য? প্রসঙ্গ ক্রমে আমরা তার জীয়নকাঠি গল্পটার কথা বলতে পারি গল্পে আমরা দেখছি একটা একান্নবর্তী পরিবারের শিশু-কিশোর বসে গল্প করছে, গল্পের বিষয়বস্তু তাদের ছোট কাকা, ছোট কাকা শহীদ হয়েছে, কী ভাবে? জিহাদ করতে গিয়ে! এই জিহাদ শব্দের আমরা বাংলাতে বুঝি ধর্মযুদ্ধ। কখন কোথায় এই ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে? কার বিরুদ্ধে? গল্পকার ধর্মযোদ্ধা বলতে কোন অশুভ শক্তিকে ইঙ্গিত করছেন এটা আমদের কাছে স্পষ্ট নয়। তো, খনন গল্পটা একটা পারিবারিক গল্প, যে গল্পের মধ্যে আমরা দেখছি একটা প্রাচীন বনেদি পরিবারের ইতিহাস, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ দুজন বৃদ্ধের কথা, অতঃপর প্রাচীন দালান ধসে পুরো পরিবারের চাপা পড়ার কাহিনী। এই দালান ধসে পড়ার ঘটনাকে আমরা একটা বার্তা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই তো দেখতে পারছি, এই পুঁজিবাদী সমাজে প্রতিমুহূর্তে কত একসময়ের কৃষিনির্ভর বনেদি পরিবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আবার অর্থনীতির চোরাপথ দিয়ে গড়ে উঠছে নব্য ধনিক শ্রেণী। গল্পকার এই গল্পে তার গল্প বুননের প্রবণতাকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন নতুন এক রূপে, শেষ পর্যন্ত পাঠকের সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন একটা ঘর। আমরা এমনই আরেকটা মনোযোগী গল্পের কথা বলতে পারি কান্না-হাসির উপাখ্যান। খনন গল্পটা যদি আমাদের শেষাবধি একটি ঘরের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করায়, তবে কান্না-হাসির উপাখ্যানটি করাবে এক বন্ধা নারীর মাতৃত্বের আকাক্সক্ষার প্রতি। সহজ সরল বর্ণনার মধ্য দিয়ে গল্পের সূচনা এবং এক টানে পড়ে ফেলা সম্ভব। কোন বাঁক নেই, বাঁধ নেই যেন বিন্যাসটাই সব কিছু। গল্পে আমরা দেখছি হাফেজ ম-ল আর তার আত্মভোলা একমাত্র সন্তান মফেজকে নিয়ে যারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাফেজ ম-লের বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে রফিজা। রফিজার বিয়ে হয়েছে বেশ ক’বছর হয়েছে। এখনো সন্তান হচ্ছে না, এই নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। এই আক্ষেপ শুধুই মাতৃত্বের আকাক্সক্ষা থেকে। সাধারণভাবে আমরা যেভাবে দেখি সন্তান উৎপাদন করতে ব্যর্থ হলে নারীরা যে ধরনের সামাজিক নিপীড়নের মুখোমুখি হয়, রফিজার জীবনে তার বিন্দুমাত্র নেই। হতে পারে এটা ব্যতিক্রম একটা উদাহরণ! ১৯ বছরের তরুণ হাফেজ ম-লের একমাত্র সন্তান মফেজের সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে পাড়ার মসজিদের মৌলভী সাহেবের পরামর্শ রফিজকে বিয়ে করানোর উদ্যোগ। আমরা এরই মধ্যে অবশ্যই দেখছি সন্তানের আকাক্সক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠা রফিজা ভাইয়ের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিচ্ছে তার প্রথম সন্তান যেন রফিজাকে দেয়। সেই চিন্তায় রফিজা ননদকে বিয়ে দিল ভাইয়ের কাছে। সুখী সংসার বলতে যা বুঝি আমরা নতুন দাম্পত্য জীবনে তাই দেখছি। কিন্তু বিয়ের বছর দেড়েক সময় অতিক্রম হওয়ার পরও যখন নতুন সংসারে সন্তান আসছে না তখনই শুরু হলো নতুন শঙ্কা। রফিজার মতো মফেজও কী তবে...? না এই শঙ্কা গল্পকার খুব বেশিদূর যেতে দিলেন না, একদিন পুরো সংসারে আনন্দ আর তার সমস্ত পাঠককে বিস্মিত করে মফেজের স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। পাঠক বিস্মিত হলো এই কারণেই যে দেড় ফর্মার মতো এই দীর্ঘ কাহিনী পাঠ করে আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, গল্পটা কোথায়? যদি আমরা এটাকে গল্প বলি, তবে প্রশ্ন আসে ঘটনার সঙ্গে গল্পের পার্থক্য কোথায়? না আমি চমকের কথা বলছি না, চিত্রময়তা দিয়েও ভাল গল্প নির্মিত হতে পারে, যার উদাহরণ আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পসমূহ। কিন্তু এই গল্পে সেই চিত্রময়তাও বা কোথায় যা পাঠ করে একজন পাঠক শেষ পর্যন্ত এক ভাবনার অকুল সাগরে ভাসবে। আমরা লেখকের পদ্মাবতী গল্পটার কথা বলতে পারি, আমেনা নামে এক নারী যার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে। যে আবার সীমান্তে চোরাচালান করত। তারই বন্ধু হোসেন আলীর সঙ্গে আমেনা একই কারবারে যুক্ত। একই সঙ্গে দেখছি, কামনাময় নারী আমেনার সঙ্গে হোসেন আলীর সম্পর্কের ব্যাপারও। এই সম্পর্ক শুধু দৈহিক ক্ষুধা মেটানোর সম্পর্ক নয়। এক ধরনের প্রেমও। প্রেম আছে সেটা বুঝতে পারি হোসেন আলীর আমেনাকে বিয়ে করার আকুতি দেখে। কিন্তু হোসেন আলী সবাইকে বিস্মিত করে আমেনাকে বিয়ে না করেই একদিন আত্মহত্যা করলো। কেন? আমরা ঠিক বুঝতে পারি না কেন হোসেন আলীর এই আত্মহত্যা! গল্পকার সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে আমাদের এক ভয়ানক ঘোরের মধ্যে রেখে দেন। হতে পারে এটা গল্পকারের এক নতুন কৌশল। তবে পাঠক হিসেবে আমরা এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ি। আড়ালতাও শিল্পের এক নিপুণতা। যদি শিল্পী সেই আড়ালকে নির্মাণের মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেন। আমরা তার পাঠকরা আশা করি নাজিব ওয়াদুদ আগামী গল্প নির্মাণে এই দিকটা বিবেচনায় রাখবেন। সেই সঙ্গে এ কথাও স্মরণ রাখছি শিল্পী সমালোচকদের মুখাপেক্ষী নয়, বরং সমালোচকরাই শিল্পীর মুখোপেক্ষী।
×