ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ২০ জুলাই ২০১৮

বই ॥ অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা

হুমায়ূন মালিকের উপন্যাসগুলোয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিষয়াঙ্গিকে অভিনবত্ব বিশেষ করে প্রতীক, রূপক, জাদু ও অধিবাস্তবতার মধ্য দিয়ে তার মিথ ও ইতিহাসের ব্যবহার লক্ষণীয়। অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা (২০১৩) সেই ধারাবাহিকতারই ফসল। এই উপন্যাসের উপজীব্য কী উপন্যাসের শেষাংশে লেখক এক বাক্যে নিজেই তা বলেনÑ ‘এ গ্রিন ওশানের কোন এক দ্বীপের নিরেট সত্য এক ইতিহাস।’(পৃ:Ñ৯৬) কিন্তু সে ইতিহাস শোষণে-শাসনে-ষড়যন্ত্রে এমনই বিদঘুটে, এতটাই এবড়ো-থেবড়ো আর বৈকল্যে ঠাসা যে বাকি দুনিয়ার কারও কারও কাছে তা এক অবাস্তব ফ্যান্টাসি।’ এই ইতিহাস এবং ফ্যাক্টকে ফ্যান্টাসিধর্মী এক ফিকশনে রূপদানে লেখকের পারঙ্গমতা আমাদের কৌতূহলি ও আকৃষ্ট করে। লেখক যদিও বলেন, এ হচ্ছে শ্যাম নামক এক দ্বীপ-রাষ্ট্রের ইতিহাস। কিন্তু শেষ বিচারে এটি শুধু কোন একক রাষ্ট্রের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেশজ ঘটনাগুলো হয়ে পড়ে বৈশ্বিক তাৎপর্যে সমুজ্জ্বল। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য পীড়িত মানুষ, পরিবেশ প্রতিবেশের বিপর্যয়, দেশীয় অর্থনীতিতে নব্য সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নব্য ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ, অস্থিতিশীল রাজনীতি, দুর্নীতি, ঘুষ, মসনদ দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সে সুযোগে সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ পরোক্ষ হস্তক্ষেপÑ এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের এক চলমান ইতিহাস। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বি-উপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনাতাপ্রাপ্ত দেশসমূহের চিত্র কি এর বাইরে? গত শতাব্দীর শেষ দশকে পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে যে নয়া-বিশ্ব-ব্যবস্থার উদ্ভব হয় এবং তারই ফলে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক মহাশক্তিরূপে উত্থান, তার তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আধিপত্য বিস্তারের নীলনক্সাÑ এ সবই উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে অভিনব আঙ্গিকে। সাম্রাজ্যবাদ এসেছে নয়ারূপে, অতিজাতিক-বহুজাতিক কর্পোরেশন এবং তাদের দোসর বড় বড় অর্থনৈতিক সংস্থা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর আছর করে তাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে কর্পোরেট স্বার্থের ছাঁচে গড়ে তোলে খনি-খামার-শিল্পকারখানা। শেষ বিচারে এটি রাজনৈতিক ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে যায়। যখন দেখি ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, পতিতাবৃত্তি, জন্মনিয়ন্ত্রণ, কারখানার বর্জ্য, নকল ওষুধের বাজারিকরণ, বিজ্ঞাপনী সংস্কৃতি, মাইক্রো ক্রেডিটের যাঁতাকল ইত্যাদি সামাজিক প্রপঞ্চগুলো এক দক্ষ আর কৌশলি বর্ণনায় হয়ে ওঠে জীবন্ত তখন মনে হয়, এ হচ্ছে রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাঁচে সামাজিক ইতিহাসের এক সার্থক রূপায়ন। তবে এসব বিষয় দেহে শিরা-ধমনি তথা রক্তসংবহন তন্ত্রের মতো থাকে শিল্পসম্মতভাবে উপন্যাসের বিষয়াঙ্গিকে গোপন। এক্ষেত্রে সুকৌশলে রূপায়িত বিভিন্ন টানটান, রসঘন আখ্যানের মধ্যে নান্দনিক সৌন্দর্যই প্রধান হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদের করালগ্রাসে নিপতিত রাষ্ট্রসমূহের পাঠকসমাজ শ্যামদ্বীপের পটভূমিতে খুঁজে পেতে পারেন নিজ নিজ মাতৃভূমির নির্মম আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে। একইসঙ্গে এ উপন্যাসে মালিক বলিষ্ঠভাবে তোলে ধরেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালো চেহারা, যা তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এমনকি প্রথম বিশ্বে মাথা তোলা এর স্বরূপটিও এখানে উন্মোচিত। এমন এক বাস্তবতার মধ্যে মানব চরিত্র ও আচরণের জটিল কুটিল গ্রন্থির উন্মোচনও এখানে লেখক করেন বিশেষ দক্ষতায়। আখ্যানের শুরু বামপন্থী নেত্রী রোজালিনের রেল কর্মকর্তা সান জিসানকে খোঁজার মধ্যে দিয়ে। শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যার সঙ্গে রোজালিনের পরিচয় এবং প্রেম, যে প্রেম গতানুগতিক নয়, বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী, দুজন ভিন ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও যা এক সময় বিয়ের সম্পর্কে গড়ায়। প্রচলিত বিধি বা ধর্মমতে না হওয়ায় সে বিয়ের খবর জানে না কেউ, তার দলের সদস্যরাও। দেশপ্রেমিক অথচ জনসমর্থনহীন এক রাজনৈতিক দলের নেত্রী সেÑ এক সামাজিক-রাজনৈতিক বিপর্যয়ে যার সদস্যরাও কিনা সুযোগ সন্ধানী হয়ে পড়েছে বলে তার সন্দেহÑ তো তার পক্ষে করণীয় কী থাকে? এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে যখন রোজা হাসপাতাল, পরে জাতীয় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে রহস্যজনক এক বন্দীদশায় এবং জিসানের সন্তান গর্ভে ধারণ করে বেকায়দায় পতিত তখন তার প্রথমেই যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে সান জিসানের সঙ্গে। রেলের সৎ কর্মকর্তা সান জিসান, যে কিনা তার সততার জন্য ডিজি থেকে শুরু করে তার পিএ ইরিনার এবং শেষাবধি রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়ে ততক্ষণে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার। তারপর জিসানের আত্মা ও রোজার চোখ দিয়ে দেখা সরকারের অনাচার, দমনপীড়ন, দুর্নীতি, সরকার এবং বিরোধীদের ক্ষমতা দখলের নোংরা খেলা, জেনারেলদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, যার পরিণতিতে সামরিক ছত্রছায়ায় এক পুতুল সরকারের ক্ষমতারোহন বেশ কৌশলে তুলে আনেন লেখক। হয়ত শেষাবধি সামরিক জান্তাই কুক্ষিগত করত ক্ষমতা। কিন্তু সুপার পাওয়ার মার্টিনের আশীর্বাদ না থাকায় তার সরাসরি ক্ষমতা দখল করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয় না। কারণ মার্টিনের এখন আর পুতুল সরকারের মাধ্যমে নয় সুকৌশলে দ্বীপটাকেই চাই আপন করায়ত্বে, সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে তার নীলনক্সা বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছে অনেকদূর। তবে সুঈয়ের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে জেনারেলরা, বলা ভাল, সেনাবাহিনী প্রধান ডান্ডি এবং তার বশংবদরা ক্ষমতার আস্বাদ গ্রহণে ব্যর্থ হয় না। তারপরও ঘটে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান, ক্ষমতার আসে অবিমৃশ্যকারী জেনারেল গিরগিট। এবং সেও ঊষার প্রেসিডেন্ট মার্টিনের মন জয়ের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কিন্তু মার্টিন তার লক্ষ্যে অটল। এবং তিনি সফল হনÑ ‘অবশিষ্ট বিদ্রোহী শ্যাম সেনাটির বুলেটে আর শেষ শ্যাম পাণ্ডাটির না খেয়ে মরণ সম্পন্ন হলে আবারও শুরু হয় দ্বীপবাসীর জন্য রিলিফসহ নানা কর্মসূচী। তা মানবমানের না হোক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্যাম সন্তানকে তো তাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, না হলে তেল-স্বর্ণ-কয়লা খনির বিপজ্জনক, স্বাস্থ্যহানিকর কাজগুলো করবে কে! আবার তাদেরই দিনে দিনে যাতে তেমন চোখ-কান-হাত-পা-চেতনা জন্মেÑ বেড়ে না ওঠে এবং তাতে দেখে, শুনে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, বাহুবলে, মেধাবলে সমস্যা না বাধায় তার জন্য সমান্তরাল বিশেষ সব প্রতিবন্ধী কর্মসূচী।’ (পৃষ্ঠাÑ ৯৫) এভাবে শ্যামদ্বীপের গরিব-দুঃখি-নিরন্ন মানুষেরা শোষণ ও নির্যাতনের এক ঘূর্ণাবর্তে আটকে থাকে। অবশ্য উপন্যাসটির শেষভাগে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী দল রোজাকে মুক্ত করে পৌঁছে দেয় এক পাহাড়ী জনপদে। এমন অস্বাভাবিকতার মধ্যে নিজের ভ্রƒণ সন্তানকে হারিয়েও সে এমন এক সন্তানের কামনা করে যে শ্যামদ্বীপের মুক্তির জন্য লড়বে। ‘হোক প্রচলিত ধর্মবিধিবদ্ধ বিবাহ বহির্ভূত মিলনেÑ চাই তার শুধু এক শ্যাম শিশু, বড় হয়ে যে শ্যামদের হয়ে শ্যামদ্বীপের জন্য লড়বে। তাকে তার গর্বেই জন্ম নিতে হবে তাও না। যে কোন শ্যাম নারীর গর্ভে জন্ম নিক দ্রোহী শ্যাম সন্তান।’(পৃ: ৯১) কিন্তু সেখানেও এক দ্বিধান্বিত আশা। এক্ষেত্রে নার্স টিনার সন্তান নিয়ে তার শঙ্কা তাকে সংশয়বাদী করে তোলেÑ ‘এই কর্মসূচীর মধ্যে টিনার সন্তানের কী হবে, রোজা উদ্বিগ্ন, আদৌ কি ও সুস্থ-স্বাভাবিক শিশু জন্ম দিতে পারবে! নাকি এর মধ্য দিয়ে তার যে শিশু জন্ম নিচ্ছে সে হবে কোন প্রতিবন্ধী কিংবা ওরা যেমনটি চায়Ñ ওদেরই পরিকল্পিত ছাঁচে! ’(পৃ: ৯৫)। উপন্যাসটিতে রোজা-জিসান আখ্যানের মতো আরও অনেক টান টান আখ্যান আছে যা কোলাজের কৌশলে থিমে সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত। এর মধ্যে সায়েন্স ফিকশনের কৌশলকে ব্যবহার করে লেখক মার্টিন ও তার গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকা-কে রূপায়িত করেন চমৎকারভাবে। পাঠক অনুসন্ধিৎসু হলে উপন্যাসটিতে অনেক তত্ত্ব, তথ্য, ঘটনা ও ইতিহাস পাবেন, কিন্তু এগুলো সরাসরি আসেনি, এসেছে আখ্যানের মধ্যে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। সাংকেতিকতার দুর্দান্ত প্রয়োগও লক্ষ্য করা যাবে এখানে। তার অন্যান্য উপন্যাসের মতো এ উপন্যাসটির ভিত্তিও সিম্বল ও নোটেশন। তার এমন শিল্প-কৌশল অনেক কিছু আড়াল বা দুর্বোধ্য করার প্রয়াস নেয়। তবে সচেতন পাঠকের কাছে শেষাবধি উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা এবং পটভূমি এক রহস্যময়তার মধ্যে ধরা দেয় এবং রেলের ডিজি, পরিচালক মি. ফিচেল বা সান জিসানের পিএ ইরিনা যারা টেন্ডারবাজি-ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করা যায়। জাতীয় তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ রক্ষা কমিটি, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, ড. ইউনুসকে যথাক্রমেও লেবার পার্টি, আন্নু, ড. সানোই-এর মধ্যে পরোক্ষ আদলে খোঁজা যেতে পারে। অনুরূপভাবে প্রেসিডেন্ট মার্টিন, প্রেসিডেন্ট সুঈ কিংবা বিরোধী নেত্রী ইরা মুন, প্রেসিডেন্ট তনয় নুঈ। এ উপন্যাসের ঘটনার বিস্তার বা সময়কাল সেভাবে সুনির্দিষ্ট নয়। তবে আখ্যান পাঠে বোঝা যায়, এর মূল পটভূমিতে ১/১১-এর পরের বাংলাদেশের দুই বছর মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে অধিবাস্তবতার আড়ালে। সে সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক নিখুঁত এবং কৌশলি বর্ণনা যা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এখানে সমুপস্থিত। রাজনৈতিক নেতাদের শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার, ব্যবসায়ীদের হয়রানি, উৎকোচ গ্রহণÑ তৎকালীন সময়ের অনুষঙ্গগুলো এখানে সাঙ্কেতিকতায় বিন্যস্ত। তবে এক্ষেত্রে কিছু অপূর্ণাঙ্গতাও লক্ষণীয়। লেখক আরও একটু উদার বা সাহসী হলে সামগ্রিক চিত্রপটটি আসতে পারত। নতুন দলগঠনের প্রচেষ্টা, মাইনাস টু ফর্মুলা ইত্যাদি এখানে ততটা গুরুত্ব পায়নি। আখ্যানে বিশ্বজনীন মর্ম আরোপের স্বার্থে হয়ত তা বর্জন করা হয়েছে সচেতনভাবে। এদিকে অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা উপন্যাসে সার্বজনীন রূপটি সুস্পষ্ট। কাহিনীর বিস্তার, আলেখ্য বর্ণনা একটি দেশ-কালের হয়েও চূড়ান্ত পর্যায়ে তা থেকে তার উত্তরণ ঘটে। বুকার বিজয়ী নাইজেরীয় লেখক চিনুয়া আচেবের এ ম্যান অব দি পিপলÑএর বঙ্গানুবাদ পাঠ করলে যেমন মনে হয় এ কোন বাংলাদেশী লেখকের রচনা তেমনি মালিকের অতিমানবের ঈশ্বরবাসনায় এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার যে কোন পাঠক তার দেশের আঙ্গিকে ঘটনার স্বাদ খুঁজে পাবে। মার্কেজীয় ঢঙের কিছু বর্ণনা রীতিও এ উপন্যাসে লক্ষণীয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক-এর সঙ্গে এ উপন্যাসের কিছু কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টিশীলতার সামঞ্জস্য বলে একটা কথা আছে। সরাসরি প্রভাব না থাকা সত্ত্বেও দুজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তির সৃষ্টির মধ্যে অভাবনীয় মিল লক্ষণীয় হতেই পারে। মার্কেজের সঙ্গে মালিকের সাদৃশ্যকে সেভাবে দেখা যেতে পারে। উপন্যাসটি পাঠে গতিহীনতার ক্ষেত্রে রিপোর্র্টিংধর্মী বয়ান আমার কাছে দায়ী বলে মনে হয়েছে। বেশকিছু জায়গায় উপন্যাস এগিয়েছে রিপোর্টিং ধাঁচে। যেমনÑ ‘এমন পর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস মেরে সভা ফুটো করতে গিয়ে বিপাকেÑ ছুড়ে মারা কাঁদানে গ্যাসের বোম ফোটার আগে শ্রমিক-পাবিক তা লুফে নিয়ে পাল্টা মারেÑ বুমেরাং। তারা জল-কামানে দাগানো রঙিন-গরম পানি অগ্রাহ্য করে। গুলি খেয়েও পুলিশের ওপর হামলে পড়েÑ ছিনিয়ে নেয় রাইফেল, কোমড় থেকে বুলেটের পেসেজ পর্যন্ত।’(পৃঃ ২৪-২৫) মালিকের নিজস্ব একটি ভাষারীতির প্রয়োগ সর্বদা লক্ষণীয়। তার অন্যান্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ স্বতন্ত্র ভাষা ভঙ্গিমায় প্রোজ্জ্বল। এ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিজস্ব ভাষারীতি নির্মাণ যে কোন লেখকের জন্য অপরিহার্যও বটে। কিন্তু ভাষা যদি হয় যোগাযোগের মাধ্যম তাহলে লেখককে তা নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে তার পাঠক। হুমায়ূন মালিককে এ বিষয়ে খুব বেশি সচেতন হতে দেখা যায় না। তার ভাষারীতি কিছু মাত্রায় হলেও অস্পষ্ট ও জটিল। বৈয়াকরণিক অসতর্কতাও লক্ষ্য করা গেছে দু-এক লাইনে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে অসমাপিকা ক্রিয়াকে সমাপিকা ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার, একইবাক্যে বিভিন্ন কালের সংযোজন পাঠককে বিভ্রান্তিতে ফেলবে। এদিকগুলো বাদ দিলে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে অতিমানবের ঈশ্বরবাসনাকে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
×