ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্ণময় অন্তর্যাত্রা

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২০ জুলাই ২০১৮

বর্ণময় অন্তর্যাত্রা

আলো-হাওয়াময় বর্ণময় প্রবাহ; এরই মধ্যে সামূহিক যাপন। ষড়ঋতুর দেশে প্রকৃতির বিচিত্র প্রণোদনা মানুষের ধমনীতে সঞ্চরণশীল রক্তকণিকায় নানা শিহরণ নিয়ে আসে। সেই কম্পন থেকেই সৃজন। জিএম জোয়ারদার নিসর্গ-সন্দর্শনে আকুল এক শিল্পী। এ দেশের আবহাওয়ার নিত্য পরিবর্তনশীল রূপ, অনেক আলো আর উষ্ণতায় সতত বিকাশমান প্রকৃতি তার মধ্যে শিল্পী-সম্ভাবনাময় বীজকে অঙ্কুরিত করেছে, মুকুলিত করেছে ও পুষ্পিত করেছে। কিন্তু এই মায়াময়, ছায়াময়, কখনও প্রখর কখনও শান্ত প্রকৃতিকে আমরা অবলোকন করি কীভাবে? আমাদের চোখ কি সত্যিই বিলি কেটে রূপকে খুঁটিয়ে পাঠ করে, না কি এক সদা চঞ্চল বর্ণপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে হৃদয় অনুভব করে চলে নিসর্গের লীলা? এই দ্বিবিধ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হয় জিএম জোয়ারদারের শিল্পকর্মের দিকে তাকালে। তবে এ কথা সত্য যে যত না ফর্মের সাংগঠনিক বাঁধুনিতে এ শিল্পীর আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তার চেয়ে বেশি তিনি বর্ণের প্রবাহে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। স্নাত থাকতে চেয়েছেন তিনি রঙিন জলধারায়; দৃষ্টিকে ভর করে মন্ত্রচালিতের মতো নিজেকে প্রবহমান রেখেছেন রঙিন প্রফুল্ল প্রকৃতিতে। জিএম জোয়ারদার মূলত শান্তিপ্রয়াসী মনের সঙ্কেত প্রবিষ্ট রাখতে চেয়েছেন তার কাজ। প্রকৃতির চিরায়ত রূপ- যা আমাদের মনে মহৌষধির মতো শুশ্রƒসার প্রলেপ দিয়ে সত্তাকে সুখ দেয় তা-ই এ শিল্পীর আরাধ্য। তবে কেবলই কালচিহ্নহীন অনন্তের সংবেদনায় জোয়ারদার সন্তুষ্টু থাকতে পারেননি। তিনি শুনেছেন প্রকৃতির কান্না সভ্যতার মৃত্যু সংবাদ। লোভ আর আধিপত্যের কারণে মানুষ কীভাবে আজ কার্বনে পোড়াচ্ছে সবুজ প্রকৃতি; এসব বোধও উজিয়ে প্রকাশ করেছেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সী এই শিল্পী। জোয়ারদারের কাজের বিশ্লেষণী অভীক্ষায় যাওয়ার আগে দুটি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা সঙ্গত বলে আমার মনে হয়েছে। তার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিসর্গলগ্ন জীবনই যাপন করে থাকেন। নগর যতই মহানগরে পরিণত হোক না কেন মানুষ তৃষ্ণা মেটানোর জন্য যায় নদীমাতৃক দেশের জলধারার কাছে, ঔষধি খোঁজে এ দেশের শ্যামলিয়াম, শান্তি পায় উদার সমতল ছেয়ে থাকা নীল আকাশের দিকে চেয়ে। তার মধ্যে রোমান্টিক চেতনা জাগর হয় আসন্ন সন্ধ্যার কুহকী আবেশে অথবা চন্দ্রালোকিত রাত্রির মায়া তাকে ভিন্ন প্রান্তরে নিয়ে যায়। চন্দ্রাহত হৃদয় অনুভব করে প্রেম ও মরমি জাগরণ। প্রথাগত পেইন্টিং মাধ্যম আজ অচল মুদ্রা বলে গণ্য করেছে পশ্চিমকেন্দ্রিক শিল্পচর্চা। তবে নতুন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতেও মেধাবী শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে গত শতকের শেষার্ধে এবং এই নতুন শতকেও। কিন্তু পশ্চিমের বাইরের মহাদেশের বেশিরভাগ দেশেই শিল্পীর কাছে পেইন্টিং মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশে শিল্পবিদ্যা লাভের প্রধান প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এ অনুষদে বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও পেইন্টিং বিভাগের প্রতি বহুকাল ধরে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ সচল রয়েছে। প্রায় বছর তিরিশ আগে জিএম জোয়ারদার এ বিদ্যায়তন থেকে স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন এবং ছাত্রজীবন থেকেই মনোনিবেশ করেছেন চিত্রকলার অন্যতম মাধ্যম পেইন্টিংয়ে। এ দেশের দ্বিমাত্রিক পটের চিত্রধারায় সবচেয়ে চর্চা হয়ে থাকে বাস্তববাদী শৈলী। তবে এ শৈলী পশ্চিম থেকে আগত হলেও এ দেশে এসে তার রূপ বদলে গিয়েছে। বিষয়টা অন্যভাবেও বলা যেতে পারে; বাস্তববাদের বীজ ভিন্ন ভূগোলে ভিন্নভাবে ফলেছে। বাস্তববাদী শৈলীতে যে বিদ্যার্থীরা শিল্পচর্চা করেন তাদের বেশিরভাগই আবার ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পরীতির রঙের আকর্ষণ খুব দ্রুত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে একটা দো’আশলা ভাষার জন্ম নেয় তাদের চিত্রপটে। এতে মিশে আছে বাস্তববাদের দৃঢ় বস্তুরূপের সঙ্গে ইম্প্রেশনিজমের রঙের চাল। জোয়ারদার শিল্পচর্চার মধ্য গগনে এসে বাস্তববাদ পূর্ণতা উপেক্ষা করেছেন। তিনি বর্ণের স্বাধীন সচলতা আর জ্যামিতিকতা-স্পষ্ট গড়নে কোন এক শুদ্ধতা অন্বেষণ করে চলেছেন। তার চিত্রপটে আর বস্তুপৃথিবীর চেনা রূপ প্রচল নিয়মে পাঠ করা যায় না। তার জমিনে এখন কেবলই বর্ণের স্বরটি উপস্থিতি। যদিও বিষয়ের প্রয়োজনে তিনি দু-একটি ছবিতে বাস্তববাদনিষ্ঠ থেকেছেন। চিত্রপটে বর্ণের বিচরণের মধ্য দিয়ে শিল্পীর মনোভঙ্গি অনুধাবন করা যায়। কেননা কব্জিতে ধরা তুলি তো আসলে তুলি, কব্জি বা রঙের কথা বলে না, বলে তা শিল্পীর মনের কথা, তার মনের বিচিত্র বেগ ও আবেগের কথা। আবেগের স্বভাবই মানুষ। চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্মে তা বিশেষভাবে পরিস্ফুট। জোয়ারদার প্রধানত প্রকৃতিমুগ্ধ কবি। আর সব সৃজনপথের পথিকের মতো তিনিও জেনে গেছেন প্রকৃতিতে সব আছে। সব আছে মানে ওই যে মনের বেগ ও আবেগ, তা অনূদিত করার বর্ণমালা প্রকৃতি সঞ্চয় করে রেখেছে। বর্ণকে জোয়ারদার সুরের সমীপে নিবেদন করেছেন। রং দিয়ে রচনা করেছেন স্বরগ্রাম। তার ছবিতে আমরা কেবলই রং পাঠ করি; স্বর ও সুরের মতো। এ কথা খাটে তার বেশিরভাগ জল রঙের কাজের ক্ষেত্রে। মেঘের মতো, বাতাসের মতো, জলের মতো নিত্য পরিবর্তনশীল উর্মিল রূপ তিনি বর্ণে বর্ণে প্রকাশ করেছেন। রং অমিশ্র। লাল, হলুদ, নীল, সবুজের সঙ্গে স্পষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টালাপ চলে জোয়ারদারের কাজে। শিল্পী স্বচ্ছতা প্রয়াসী। ইম্প্রেশনিস্টরা যে গাঢ় ও উজ্জ্বল বর্ণে মনের স্ফূর্তি জানান দিয়ে গেছেন, এ শিল্পীর চাল আরও মিহি। সিল্কি বর্ণ পর্দার প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাত আছে। এ দেশের প্রকৃতির ডাকটাই এ রকম। মেঘ-বৃষ্টি, আলো-ছায়া, ঠা-া-গম, মুহুর্মুহু বদলে যায় এ দেশের প্রকৃতি। আমাদের মনও সেভাবে তৈরি। জোয়ারদারকে প্ররোচিত করেছে এই প্রকৃতির ইশারাসমূহ। অপর পক্ষে এই শিল্পী কতগুলো গড়নপ্রধান কাজ করেছেন। এখানেও তিনি শুদ্ধতা অর্থাৎ গড়নকে পরিশ্রুত রাখতে চেয়েছেন। এ ধারার কাজে জ্যামিতিক হিসাব মেনে প্রাকৃতিক গড়ন ও মানুষের তৈরি নানা কাঠামো এবং স্থাপত্যের গড়নের সঙ্গে সঙ্গতি খোঁজার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যদিও এসব ছবিতে বর্ণের আধিপত্য রয়ে গেছে। নিজের মনোভঙ্গির কথা জোয়ারদার ছবির নাম দিয়েও জানান দিয়েছেন। একটি ছবির নাম দিয়েছেন তিনি ‘শুদ্ধ বিমূর্ত’। এ থেকে বোঝা যায় প্রকৃতির অধরা মাধুরী বর্ণে ও রূপে শিল্পী তালাশ করেছেন। তবে সহসা যখন দেখি তার বর্ণে অনূদিত হচ্ছে না মাধুর্য, বরং কর্কশ টেক্সার একটা বাধাগ্রস্ত মনের খরবেগের কথা বলছে এবং শিল্পী ছবিটির নাম দিয়েছেন ‘বুড়িগঙ্গা নদীর কান্না’ তখন বোঝা যায় শাশ্বত বাংলা নয় শুধু সমকালের দুঃসংবাদও হয়েছে শিল্পীর উপজীব্য। অবশ্য শাশ্বতের কল্যাণী স্রোত ধ্বংসোন্মুখ হওয়ার জন্যই শিল্পীর এই কান্না। এভাবে জোয়ারদার কঠিনে- কোমলে তার মনোপ্রকৃতিকে বর্ণে বর্ণে বর্ণিত করেছেন। তবে তিনি প্রধানত মধুময় উজানের যাত্রী।
×