ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২০ জুলাই ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) একেক সময় অবাক বিস্ময়ে ভাবি কীর্তিমান লেখকেরা কি করে পাতার পর পাতা লিখে যান অবলীলায়! এ যেন বহমান নদীর জলধারার মতো। তরতরিয়ে চলে দিনের পন দিন। প-িত জওহরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন গঙ্গা নদীর কথা। এক অসাধারণ বর্ণনা সেটা। তিনি বলেছিলেন, কেমন করে গঙ্গা ভারতের দীর্ঘ ইতিহাসকে তার বুকে ধরে সেই সুদূর অতীত থেকে বয়ে নিয়ে চলেছে সযতনে বর্তমান হয়ে অজানা ভবিষ্যতের পথে। সেই বর্ণনা পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। বস্তুতপক্ষে, এই সকল ক্ষণজন্মা মানুষ, প-িত নেহরু যেমন, কত অনায়াসে লিখে যান নিজেদের জীবন কথা। আর আমরা ভাবতে ভাবতে ব্যাকুল হয়ে উঠি কি লিখব আর কি লিখব না। তাই মনে হয়, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, উচিত-অনুচিতের বাধা ডিঙিয়ে যা মনে আসে সেটাই লিখে যাব এই মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণে। নিজের কথা লিখতে গেলে কেবলই কি তা ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? আমার মনে হয়, চিন্তায় এবং বোধে কি আছে তাই তো ভাগ করে নেয়া উচিত আমার বন্ধুদের সঙ্গে। আমি নিশ্চিত একে বাহুল্য বলে ধরবেন না কেউ। স্বাধীন বাংলাদেশে, আমি হয়ত উল্লেখ করেছি এর আগে, জীবনের অভাব লক্ষ্য করিনি কোথাও। একটা গোটা জাতি অর্গলমুক্ত হলে কত উচ্ছল, উজ্জীবিত হয়ে ওঠে তা লক্ষ্য করেছিলাম ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরে। ঢাকায় এবং অন্যান্য জনপদে মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা ঢল যেন নেমেছিল। যেন এই প্রথম তারা সূর্যের আলোয় প্রাণ পেল সর্বত্র। নিজ চক্ষে দেখেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত সড়ক কিভাবে একেবারে নিজেদের প্রচেষ্টায় সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন গ্রামবাসী। মুখে কোন ক্লান্তির কিংবা পরিশ্রমের ছাপ নেই। কেমন করে ভাঙ্গা সেতু মেরামত করছেন উৎসাহ-উদ্দীপনায়। মনে হচ্ছে এই সকল কাজই যেন আনন্দের । এই যে অসাধারণ এক জীবনীশক্তি তাকে ধরে রাখতে পারিনি আমরা। স্বাধীনতার যে উদ্দীপনা, যে অন্তর্গত উচ্ছাস তা সময়ে ক্ষীণ হয়ে এসেছে এবং এক সময় মানুষ ভাবতে শুরু করেছে যেন গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যেই আবার প্রবেশ করল সে। ওই প্রাণোচ্ছলতাকে যদি ধরে রাখা যেত, ওই বন্যাকে যদি বইয়ে দেয়া যেত খরা লাঞ্ছিত দেশের নিষ্ফলা জমির ওপর তাহলে আজ আমরা সোনার ফসল ঘরে তুলতাম অবলীলায়। তা যে পারিনি এটা আমাদের প্রজন্মেরই দোষ। এসব ভেবে বড় মর্মপীড়া হয়। যে সব আদর্শ অথবা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম নির্দ্বিধায় সেই আদর্শ আজ ভূলুণ্ঠিত। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে ধ্বংসের পথে যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তখন নিজেদের জাগতিক চিন্তায় এমনই বিভোর ছিলাম যে কোন কিছু না করে দিব্যি হাত গুটিয়ে বসে থেকেছি। তাৎক্ষণিকভাবে অবচেতন মন থেকে আমাদের ব্যর্থতার যে বেদনা মনে আসে ততটুকুই হয়ত ভাবি আমরা আমাদের দেশ নিয়ে। অথচ এর বাইরেও বিশাল বড় একটা অধ্যায় অচর্চিত থেকে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে, সাদামাটা চোখে, আমরা দেখব যে কিছুদিন অন্তর একটা জনগোষ্ঠী তাদের বর্তমান নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলে অর্গল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। এর পেছনে কিছু পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ কারণ থাকে। যেমন ধরা যাক, এই উপমহাদেশ ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম নেয়ার কথা। পরোক্ষে ছিল প্রায় দু’শ’ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির পরিপন্থী ছিল। এই বিষয়গুলো বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে তাদের দখলদারি মনোভাব এবং সরাসরি অত্যাচার আমাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে তাৎক্ষণিকভাবে। এই অত্যাচার বোঝার জন্য শিক্ষা কিংবা সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়নি। সেই কারণে এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও ক্ষেপে উঠেছে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে যে তাহলে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা কেবল ভারতের স্বাধীনতা কামনা না করে কেন তাদের জন্য একটি পৃথক দেশের কথা চিন্তা করল। এর পেছনেও পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ কারণ ছিল বৈকি। ব্রিটিশ শাসন আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সামন্তবাদী শ্রেণী যারা সাধারণ কৃষকের ওপর দুঃশাসন চালিয়েছিল তারা ছিল বিত্তশালী হিন্দু জমিদার এবং শাসিতরা ছিল সাধারণ দরিদ্র মুসলমান। এখান থেকেই ক্ষোভের সৃষ্টি। এরপর উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ পার্টির হিন্দু বিদ্বেষ সাধারণ মানুষের অসন্তোষে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। অতএব তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষেপে উঠে তারা পাকিস্তান দাবি করে। তবে এই পরিবর্তন যে মানুষের ভোগান্তির চিরস্থায়ী সমাধান নয় এই বিষয়টি ক্রমেই আমরা অনুধাবন করি এবং তখনই স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি উচ্চারিত হতে শুরু করে। অবশেষে বাংলাদেশের জন্ম হয়। কিন্তু এই যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলো, এগুলো কখনই আমাদের চিরস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারেনা। আমার ধারনা, সর্বসাধারণের মাঝে একমাত্র শিক্ষার প্রসারই পারে রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে আসতে। যার দ্বারা আমাদের প্রতিটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব। দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরাজমান প্রতিক্রিয়াশীল সকল ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন না হলে, কেবল বাইরের পোশাক পরিবর্তন কি পতাকা পরিবর্তনে গণমানুষের নানাবিধ সমস্যার কোন সমাধান হয় না। ’৮০-এর দশক আমাদের নাট্যচর্চায় বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় বলে আমি মনে করি। ওই সময় আমরা সুসংহতভাবে নাট্যচর্চার একটি নিজস্ব চরিত্র নির্মাণে ব্রতী হই। আমরা নাটকের দর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করি। ওই সময়ে দেশে সামরিক শাসন বিদ্যমান ছিল। এই ধরনের শাসন-শোষণের প্রক্রিয়া আমরা এবং আমাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতি কর্মীরা সেই পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই দেখে এসেছে। ’৭০-এর গণআন্দোলনে বাঙালী অনুধাবন করেছিল যে তাদের মুক্তির একমাত্র পথ দেশের সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন। এই উপলব্ধি থেকেই ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উত্থান এবং পরবর্তীতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি। কিন্তু ওই দশকেরই মধ্যভাগে এই দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে, গণতন্ত্রকে জলাঞ্জলি দিয়ে আবারও সেই সামরিকীকরণের পথেই যাত্রা হলো শুরু। অতএব, আমাদের নাট্যকর্মেও এই বিষয়টি নানাভাবে স্থান পেয়েছিল। (চলবে)
×