ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানের নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের লড়াই

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ২১ জুলাই ২০১৮

 পাকিস্তানের নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের লড়াই

অনলাইন ডেস্ক ॥ ১৩ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন নাইয়াব আলী। স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীরা যৌন নির্যাতন করেছেন। ছেলেবন্ধু ছুড়েছে অ্যাসিড। এমন দুর্দশা নিয়ে জীবনটা শুরু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নাইয়াব আলীর। তবে জীবনপথে একটুও দমে যাননি তিনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। বর্তমানে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের একজন প্রার্থী তিনি। অনাদর-অবহেলায় পড়ে থাকা, বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার আদায়ে লড়বেন। বিবিসি অনলাইনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাইয়াব আলী বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম, রাজনৈতিক শক্তি ও দেশের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশ হওয়া ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়।’ ২৫ জুলাই থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে এবার তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন দেশটির তৃতীয় লিঙ্গের চারজন প্রার্থী। এর মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণ আরও জোরালো হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভাগ্যে জোটে শুধুই বিদ্রূপ আর ঘেন্না। শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ তাঁদের নাগালের বাইরে। বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘হিজড়া’ বলা হয়। যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। মুঘল আমলে তাঁরা শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, এমনকি বিচারালয়ের উপদেষ্টা নিযুক্ত হতেন। তবে উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থানের পর থেকে তাঁদের দুর্ভোগ শুরু হয়। ব্রিটিশরা তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়কে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করে। সে সময় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘হিংস্র’ বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পুরোপুরি অস্বীকার করা হয় তাঁদের মৌলিক নাগরিক অধিকার। তবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানই সবচেয়ে বেশি অগ্রসর বলে মনে করেন ট্রান্সজেন্ডার হাইট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক উজমা ইয়াকুব। কারণ, পাকিস্তানই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নাগরিক অধিকার দিয়েছে। গত বছর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পাসপোর্ট দেওয়া শুরু করেছে দেশটি। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো এই সুবিধা প্রচলন করা হয়নি। চলতি বছরের মে মাসে পাঁচ লাখ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে একটি আইন পাস করা হয়। গত মার্চে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে প্রথম সংবাদ উপস্থাপনা করেন মারভিয়া মালিক। পাকিস্তানের কোহিনুর টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন তিনি। অবশ্য এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য স্বর্গস্থান পাকিস্তান। এই সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও কুসংস্কার অব্যাহতই আছে দেশটিতে। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে অনেকেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আশ্রয় নেন গুরুর কাছে। একজন গুরুর নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে তাঁরা আশ্রয়, খাবার ও নিরাপত্তা পান। মারিয়া খানও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তিনি বলেন, যখন বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়, কোনো দলে আশ্রয় নেওয়াই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। ১০ বছর বয়সে ভাইবোনের উপহাসে ও প্রতিবেশীদের অত্যাচারে বাসা থেকে পালান তিনি। মারিয়া বলেন, ‘এসব দলের মধ্যে থাকা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করেন। এখানে কেউ কাউকে উপহাস করে না, মারে না বা অত্যাচার করে না। কারণ, এখানে সবাই একই রকম।’ মারিয়া খানের আরও একটি পরিচয় রয়েছে, তিনি এবার খাইবার পাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক আসনে নির্দলীয় প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। এ সম্প্রদায়ের অনেকে মনে করেন, বর্তমান সময়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনের ওপর হুমকি বেড়েছে। নাইয়াব আলী বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এখন হত্যা করা হয়। এর আগে মারধর, অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটলেও এখন হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। স্থানীয় সমাজকর্মীদের তথ্যমতে, গত তিন বছরে ৬০ জনেরও বেশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় খুন করা হয়েছে। কিছুদিন আগেও সেখানে তালেবানের প্রভাব ছিল ভালোই। তাঁদেরই একজন আলিশা। ২০১৬ সালে স্থানীয় একটি দল ২৩ বছরের সমাজকর্মী আলিশাকে গুলি করে। আলিশা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। কারণ, হাসপাতালে নেওয়াপর তাঁকে পুরুষ না নারী ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই মৃত্যু হয় আলিশার। মারিয়া খান জানান, সম্মান রক্ষার্থে পরিবারের হাতেই জীবন দিতে হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে, যা তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের পরিবারই আমাদের হত্যা করতে খুনি ভাড়া করে। মানসেরাতে আমার বাসায় দরজায় অনেকগুলো গুলির চিহ্ন আছে।’ স্থানীয় হাজারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক মারিয়া ভোটের প্রচারে প্রচুর সমর্থন পাচ্ছেন। বহু লোক এগিয়ে এসে চাঁদা দিচ্ছেন তাঁকে। জিতলে এলাকায় পানীয় জলের সমস্যার সমাধান করতে চান তিনি। পাকিস্তানের নির্বাচনে এনএ-৫৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নাদিম কাশিশ। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে লড়াই করছেন পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ইমরান খান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসির সঙ্গে। রাজধানী ইসলামাবাদে তাঁর নির্বাচনী এলাকা পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংসদ, সুপ্রিম কোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে এই অঞ্চলে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারকর্মী এবং সাবেক মেকআপশিল্পী, নাদিম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সমস্যা তুলে ধরতে রেডিওতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক আইন সত্ত্বেও পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক দল তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার আদায়ে কাজ করতে চায় না, আমরা তাদের এজেন্ডাতে নেই। এই কারণেই আমি সংসদে বসতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যানার, ফেস্টুন, পরিবহন এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী প্রচারাভিযানে ব্যয় করার মতো অর্থ আমার নেই। আমি তাই আমার রেডিও প্রোগ্রামের মাধ্যমে বার্তা দিয়ে প্রচার চালাচ্ছি।’ সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক স্তরের মানুষদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংকট ও উদ্বেগের বিষয়গুলো উত্থাপনের জন্য কাশিশকে আসন্ন আইন পরিষদে তাঁদের সম্প্রদায়ের ‘প্রতিনিধি’ হিসেবে দেখছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সম্প্রদায়। সূত্র- বিবিসি বাংলা
×