ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

খেলাপি ঋণ কমাতে বিকল্প পন্থা হতে পারে এডিআর

প্রকাশিত: ০২:১৮, ২১ জুলাই ২০১৮

খেলাপি ঋণ কমাতে বিকল্প পন্থা হতে পারে এডিআর

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে (এডিআর) বিকল্প পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বিদ্যমান অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ কে যুগোপযোগী ও সংষ্কার করাও একান্ত আবশ্যক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শনিবার ঢাকা চেম্বারে ‘খেলাপী ঋণ আদায়ে এডিআর’র ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (বিয়াক) এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করে। আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহীদুল হক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিল আলোচনায় মিডল্যান্ড ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহসান-উজ জামান এবং ইউএ্যাব-এর বোর্ড অফ ট্রাষ্টি’র বিশেষ উপদেষ্টা অধ্যাপক ইমরান রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিয়াক-এর চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড-এর ইভিপি ও হেড অফ লিগ্যাল ব্যারিষ্টার শাফায়াত উল্ল্যাহ। মূল প্রবন্ধে তিনি জানান, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কে বিকল্প পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের সামষ্টিক ব্যাংক ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপী ঋণ। তিনি ব্যাংক ঋণ বিষয়ক স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভ‚ক্ত করার আহবান জানান। তিনি বলেন, বিদ্যমান অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ কে যুগোপযোগী ও সংষ্কার করা একান্ত আবশ্যক। গোলটেবিল আলোচনার প্রধান অতিথি লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহীদুল হক বলেন, বর্তমানে আদালতে অর্থ ঋণ বিষয়ক মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেক্ষেত্রে মামলা জট কমানো ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিয়াক অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি আরো বলেন, গত ৭ বছর ধরে বিয়াক খেলাপি ঋণ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, মধ্যস্থতা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আমাদের অবশ্যই সকলের জন্য সমান আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং মামলা-মোকাদ্দমা জড়ানোর আগে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেওয়া গেলে অনেক ক্ষেত্রেই অহেতুক হয়রানি কমানো সম্ভব হবে। তিনি জানান, উন্নত দেশগুলোতে যেখানে ২ শতাংশ খেলাপী ঋণ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে ১০ শতাংশের অধিক খেলাপী ঋণ বিদ্যমান আছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে আইনের সংষ্কারের প্রয়োজন হলে, সরকার তা করতে অত্যন্ত আগ্রহী। তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সকল ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এ লক্ষ্যে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। বিয়াক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, সাম্প্রতি সময়ে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের দেশে একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানে সম্ভব হলে আমাদের দেশের আর্থিক খাতকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, এ লক্ষ্যে বিয়াক দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান সমূহের সক্রিয় ভাবে সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরোও বলেন, এডিআর কার্যক্রম কে আরো গতিশীল করার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরির খসড়া প্রণয়নের জন্য বিয়াক বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স নিবীড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ৮৮৫ বিলিয়ন টাকা। তিনি জানান, বর্তমানে আমাদের মোট ঋণের ১০.৭৮ শতাংশ খেলাপি এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯.৩১ শতাংশ। তিনি জানান, এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ খুবই কম যেমন; মালয়েশিয়ায় ১.৬ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১.৯ শতাংশ, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় ২.৯ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ২.৫ শতাংশ, শ্রীলংকা ২.৬ শতাংশ এবং নেপালে ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের উচ্চ হারের কারণে ভালো গ্রহীতাবৃন্দ প্রয়োজনীয় ঋণ পাচেছন না এবং উদ্যোক্তাবৃন্দ উচ্চ হারে ঋণ নিতে বাধ্য হচেছন। ডিসিসিআই’র সভাপতি খেলাপি ঋণ কমানো জন্য ব্যাংকসমূহে কর্পোরেট গর্ভানেন্স বাস্তবায়ন এবং সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন, ঋণ আদায়ে জিরো টলারেন্স নীতিমালা গ্রহণ, খেলাপী ঋণের সাথে সম্পৃক্তদের আইনের আওতায় আনায়ন এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উপর আরো বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। বিয়াক-এর সিইও মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী বলেন, ব্যাংকের তারল্যের সাথে খেলাপি ঋণের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আদালতের সরনাপন্ন হওয়ার পূর্বে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ধারাটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তভ‚র্ক্ত থাকা প্রয়োজন। তিনি এডিআরকে জনপ্রিয় করতে আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সহযোগিতা কামনা করে। লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিষয়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন বেগম অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ কে সংষ্কার এবং এর সাথে এডিআর’র কে অন্তভ‚র্ক্ত করার প্রস্তাব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সালমা নাসরিন বলেন, দেশের অর্থনীতির সুস্থ বিকাশের জন্য কার্যকর ব্যাংক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের বিষয়টি আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। তিনি আরো বলেন, বিয়াকের মত অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশ নারী বিচারক এসোসিয়েশন-এর সভাপতি তানজিনা ইসমাইল বলেন, ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া পুনঃবিন্যাসের বিষয়টিতে ব্যাংকসমূহের আরো মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এডিআর ও মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া সমাধান হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে এবং এর মাধ্যম আদালতে মামলার সংখ্যা হ্রাস পাবে। তিনি আরোও বলেন, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে ধংসের মুখে ধেলে দিতে পারি না। নির্ধারিত আলোচনায় সিটি ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল ওয়াদুদ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামদুদ রশিদ, ব্যারিষ্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান, ব্যারিষ্টার শিরীন শেখ মাইনুদ্দীন, ব্যারিষ্টার সাকিব মাহবুব, ব্যারিষ্টার মারগুব কবির, সিপিডি’র গবেষণা সহযোগী সৈয়দ ই্উসুফ সাদাত, ব্যারিষ্টার খন্দকার এম এস কাওসার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
×