ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ কোটা আন্দোলন আসলেই রাজনৈতিক!

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২২ জুলাই ২০১৮

অভিমত ॥ কোটা আন্দোলন আসলেই রাজনৈতিক!

কোটা সংস্কার আন্দোলনের বর্তমান হালচাল আমাদের দেশের উগ্র বামপন্থী আর উগ্র ডানপন্থীদের এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি কোটা সংস্কারের আন্দোলন নিয়ে কথা বলছি না। কথা বলছি, আন্দোলন নিয়ে রাজনীতির। দেশের বামপন্থা রাজনীতির অংশটাকে আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রগতিশীল বলে ধরে নেই। কিন্তু আমাদের ইতিহাস সাক্ষী দেয়, বামপন্থার একটি অংশ উগ্রতার কারণে ভেতরের সূক্ষ্ম পার্থক্য ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে মোটাদাগে যে অবস্থানের জানান দেয়, তা শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের ভাবনায় মদদ জোগায়। রাজনীতির সরলরেখার বিপরীত দুই মেরুতে অবস্থানকারী ডান-বাম বক্রাকার হয়ে তখন এক বিন্দুতে মিলিত হয়। এমনটা আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও ঘটেছে। শুধু আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। যে কারণে স্বাধীনতার মতো চূড়ান্ত বিষয়টি উভয়ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে। এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর দিকে নেতৃত্বে আমার পরিচিত এক ছোট ভাই ছিল। যে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাঙ্গেও যুক্ত। আন্দোলন কিছুদিন চলার পর যখন নেতৃত্বের প্রয়োজন হলো তখন তাকে নেতৃত্ব দানে অনেকে অনুরোধ করে। সে দ্বিধান্বিত হয়ে পরামর্শের জন্য আমার কাছে আসে। আমি তখন তাকে বলি, ‘সময়ের প্রয়োজনে হয়ত এই আন্দোলনের সামাজিক ন্যায্যতা তৈরি হয়েছে, তবে রাজনৈতিক ন্যায্যতা আসেনি। সামাজিক আবেদনের কারণে একজন ছাত্র হিসাবে তুমি আন্দোলনে যেতে পার। তবে রাজনৈতিক ন্যায্যতার প্রশ্নে তুমি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পার না।’ কিছু ক্ষেত্রে এই দাবির সামাজিক ন্যায্যতা ছাত্রসংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগও উপেক্ষা করতে পারেনি। তাই আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা না করাটা ছিল সংগঠন হিসাবে তার রাজনৈতিক কৌশল। আমি একজন ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে তাকে আন্দোলনে যেতে অনুৎসাহিত করলেও একজন সাধারণ ছাত্র হিসাবে তাকে আন্দোলনে যেতে বারণ দেই নাই। কারণ আমি চেয়েছিলাম আন্দোলনটি যদি অরাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে তার সামাজিক আবেদন মেটাতে পারে তাহলে হয়তো ছাত্রসমাজের সামগ্রিক মানসপটে এক ধরনের পরিবর্তন হবে। আন্দোলনের প্রারম্ভিক যাত্রায়, আমার ধারণা ছিল নব্বইয়ের দশকের পরে এই আন্দোলন হয়ত এমন কোন আন্দোলন হতে যাচ্ছে যা তার চরিত্রে কোন রাজনৈতিক রং না লাগিয়ে অদ্ভুত, সুন্দর ও প্রাণবন্তরূপে আমাদের সামনে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু কাল ব্যতিরেকে দেখি, এই ভাবনা এক বিশাল ভ্রম। আন্দোলনের শুরুটা প্রাণময় ছিল কিন্তু তা শৃঙ্খলিত ছিল না যুক্তির বন্ধনে। অরাজনৈতিক কোন আন্দোলন অনেকদিন চালালে যা হয় আর কি। বিশেষ করে, নেতৃত্বের দুর্বলতা। আর এসব দুর্বলতার সুযোগেই তার উপর ভর করে রাজনৈতিক প্রেতাত্মা। সেই প্রেতাত্মারা আন্দোলনের চরিত্র নষ্ট করে নিজেদের ফায়দা নেয়ার জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে। তারই উদাহরণস্বরূপ, এই আন্দোলনকে পুঁজি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে শুধু হামলাই নয়, হানাদার বাহিনীর কায়দায় লুটতরাজ চালানো হয়েছে। আন্দোলন যাতে কারও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার না হয়, সে কারণে বর্তমান সরকারপ্রধান সংসদে ছাত্রসমাজের দাবি বিবেচনা করে কোটা প্রথা বাতিল করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা আসার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে তাদের দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে আশার সঞ্চারণা দেখে অনেকে আন্দোলন বন্ধ করে পড়ার টেবিলে ফিরে যায়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও কিছু শিক্ষার্থী প্রজ্ঞাপনের দাবিতে মাঠে থেকে যায়। এরা কারা? এরা কেন সুপরিকল্পিতভাবে মাঠে থেকে গেল? কারণ এদের উপর থেকে শিখানো হয়েছে যে ৪৬ বছর ধরে চলা একটা সিস্টেমে সরকার চাইলেই হুট করে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারবে না। সরকার পর্যালোচনার জন্য যে সময় নেবে সেই সময়ের মধ্যে এটাকে আরও বেশি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। তারেক রহমানের পরিচালনায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার প্রযোজনায় এই দৃশ্যের পরিবেশনায় ছিল দেশীয় জামায়াত-বিএনপির এজেন্টরা। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছে ছদ্মবেশী শিবির (যেহেতু ছাত্রদলের নেতারা বয়স ও ছাত্রত্ব বিবেচনায় অছাত্র) এবং এটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য পার্শ্ব চরিত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রেখে তাদের সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা যদি না-ই হবে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের অরাজনৈতিক আন্দোলন কেন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিল। সেটার স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মামুন আহমেদের সঙ্গে তারেক রহমানের কথোপকথন থেকে। আবার এই আন্দোলনের ব্যানারে বঙ্গবন্ধু এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করে মিছিল করা হয়েছে। এটা যে উপর থেকে শিখিয়ে দেয়া কৌশলও হতে পারে, সেটাও ভাবছে কেউ কেউ। বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করে যে কেউ আন্দোলন করতে পারে। এটা যেমন সত্য। বঙ্গবন্ধুকে তো এদেশের রাজনীতিতে একটা গ্রুপ রাষ্ট্রের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না, এটাও সত্য। তাহলে এই শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের আগে সব রাজনৈতিক দলের কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা নৈতিক দায় ছিল বলে আমি মনে করি। সেটা তারা করেছে বলে আমি শুনিনি। তেমনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ছবিও যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তিনি সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়ার পরও যারা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাঁর ছবি ব্যবহার করে আন্দোলন করেছেন তাদের সন্দেহের চোখে দেখার অবকাশ থেকেই যায়। দু’টা জায়গা থেকেই স্পষ্ট যে ছবির ব্যবহার ভেতর থেকে ধারণ করে নয় বরং রাজনীতির কূটকৌশল হিসাবে। কোটা সংস্কারের দাবির সঙ্গে দ্বিমত করছি না। একটা গণতান্ত্রিক দেশে বুঝে হোক, না বুঝে হোক যে কোন নাগরিক তার দাবি জানাতে পারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা আফসোসের জায়গা তৈরি হয়, যে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামছে তারা কখনও এদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার আন্দোলন করেনি। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে এমন একটা আন্দোলন দেখলে হয়ত আশান্বিত হতে পারতাম। এবার আসি ঈদের পরে আন্দোলন প্রসঙ্গে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন নামে কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে যে গ্রুপটি বড় সেটির ওয়ালে পোস্ট এবং মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায় এটাকে সরকারবিরোধী প্লাটফর্ম হিসাবে কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। কোন আন্দোলন বা দাবি আদায় করতে হলে নেতৃত্বে যারা থাকে তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। যাতে এতে কোন ধরনের রং না লাগে। সেক্ষেত্রে হয় এই পেজ পরিচালনাকারী এডমিনদের স্ক্রুটিনির দুর্বলতা ছিল, না হলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এটাকে সরকারবিরোধী প্লাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই গ্রুপের ওয়ালে পোস্টগুলোতে বা মন্তব্যে ছাত্রলীগকে যেভাবে আগে থেকে শত্রুভাবাপন্ন করা হয়েছে, তা ছিল খুবই লক্ষণীয়। আবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ খানের ভিডিও বার্তায় কথা বলার ধরন ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। এই বক্তৃতার পরে ছাত্রলীগের কেউ কেউ ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আন্দোলনের রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অংশকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগ কখনই কোটা আন্দোলনবিরোধী কোন ‘অফিসিয়াল’ বিবৃতি দেয়নি। আবার ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে গত দুই মাস ধরে সাংগঠনিক তোড়জোড় চলছে। বরং ছাত্রলীগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করেছে। তাই স্পষ্টভাবেই বলা যায়, কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ কখনোই দাঁড়ায়নি। কেউ যদি ব্যক্তিগত কারণে কারও বিরুদ্ধে যায় সেটার দায়ভার একান্তই তার ব্যক্তিগত। তবে এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে কোন আন্দোলনে সমর্থন দেয়া বা বিরুদ্ধ মত উপস্থাপন করা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। জোর করে আন্দোলন দমন যেমন ফ্যাসিবাদী আচরণ আবার জোর করে আন্দোলনে সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও ফ্যাসিবাদী আচরণ। এই আন্দোলনের কিছু কিছু কর্মীদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী আচরণের একটা ছাপ দেখা গেছে। সর্বশেষ যে কথাটা বলতে চাই, সেটা হলো- আন্দোলনটা যতটা না রাজনৈতিক বিষয়, তার চেয়ে বেশি আমলাতান্ত্রিক। এই বিষয়টা স্পষ্টভাবে আন্দোলনকারীরা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ৪৬ বছর ধরে চলা বিষয়ে আকস্মিক হাত দিলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেবে বৈকি! লেখক : ছাত্রনেতা
×