ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধ তৃষ্ণার ইচ্ছাশক্তি অদম্য, স্বপ্ন তার আকাশছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২২ জুলাই ২০১৮

অন্ধ তৃষ্ণার ইচ্ছাশক্তি অদম্য, স্বপ্ন তার আকাশছোঁয়া

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দু’চোখের আলো নিভে গেছে তার এসএসসি পরীক্ষার আগেই। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও দমেনি সাদিয়া আফরিন তৃষ্ণা। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরেই আজ এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তৃষ্ণা তার অন্ধত্বকে জয় করেছে। জীবন সংগ্রামের কয়েক ধাপ পেরিয়ে তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত। হতদরিদ্র নাইট গার্ড পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি হতে চান শিক্ষক। তৃষ্ণা জনকণ্ঠকে, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও আমার স্বপ্ন এখন আকাশছোয়া। আমি কখনও চাইনি কারও ওপর নির্ভরশীল হতে। আর এজন্য অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা শিখছি। পড়া শেষ করে শিক্ষক হওয়ারও স্বপ্ন দেখছি। আমি অন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের হয়ে দৃষ্টান্ত রাখতে চাই।’ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের হতদরিদ্র নাইট গার্ড মিজানুর রহমানের প্রথম সন্তান তৃষ্ণা। ২০০৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার আগে চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করে। এরপর তাকে রংপুর, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সর্বশেষ ঢাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পিতার সহায় সম্বল বিক্রি করে ধরে রাখা যায়নি তার চোখের আলো। ওই বছরের শেষের দিকে তার দুই চোখের আলো নিভে যায়। দৃষ্টি হারানোর পর কখনও একা একা পড়ার সক্ষমতা হয়নি। সঙ্গে রয়েছে দারিদ্র্যের কশাঘাত। কিন্তু একটুও মনোবল হারায়নি সে। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা ব্যাপিস্ট চার্চ মিশনারিজ স্কুলে। অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজে। ২০১৫ সালে এ গ্রেড নিয়ে এসএসসি পাশ করার পর ভর্তি হয় বেগম বদরুন্নেছা মহিলা কলেজে। সেখান থেকে এ-গ্রেড নিয়ে নিয়ে পাশ করার পর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যায়নরত। চোখের আলো নেই তৃষ্ণার তবে কিভাবে সে তার বই পড়ত ? এ বিষয়ে সে জানায়, ‘অষ্টম শ্রেণী থেকেই আমি শিক্ষদের লেকচার ক্লাসে বসে রেকর্ড করতাম। তারপর সেগুলো শুনে মনে রাখার অভ্যাস করা শুরু করি। এছাড়াও বন্ধুদের দিয়ে পড়া রেকর্ড করিয়ে নিতাম। এসএসসি, এইচএসসি ও ভর্তি পরীক্ষার সময় এভাবেই আমি পড়া মুখস্থ করেছি। আমার বন্ধু-বান্ধবরাসহ শিক্ষক সবাই আমার পাশে থেকেছে। আর সেজন্যই হয়তবা এতদূর আসতে পেরেছি। তবে লেখাপড়া ভালভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য এখন প্রয়োজন একটি ল্যাপটপ। অর্থাভাবে একটি ল্যাপটপ কিনে দিতে পারছেন না পরিবার বলে আক্ষেপ করেন তৃষ্ণা। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করতে হয় তাকে। এইত ক’দিন আগেই রোকেয়া হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে এক রিক্সা তার পায়ের ওপর উঠিয়ে দিয়েছিল। সে জানায়, ‘ভাগ্যিস আমি পড়ে যাওয়ায় কয়েকজন মিলে আমাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে হলে দিয়ে আসে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’ এত সংগ্রাম করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে চলেছেন তৃষ্ণা। তার ইচ্ছা নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষার দায়িত্ব নেয়ার। লেখাপড়া শেষ করে তিনি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে একজন ভাল শিক্ষক হতে চান। মেয়ের চোখের চিকিৎসা প্রসঙ্গে পিতা মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০০৭ সালে ফার্মগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে ১৪ দিন ছিলাম। এরপর একজন বিদেশী ডাক্তার আসায় তাকে দেখালাম। শুরুতেই তিনি জানতে চাইলেন আমার সামর্থ্য কেমন? অন্তত ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা ব্যয় করার মতো সামর্থ্য আছে নাকি? আমি বললাম না। তিনি মাদ্রাজে নেয়ার কথা বলেছিলেন। বললাম আমার কোন সামর্থ নাই। বলল যে দেশে কত এমপি-মন্ত্রী আছে, এদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমাদের এলাকার এমপি সাহেবের কাছ থেকে আর যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কিছু পয়সা কড়ি পেতাম তার সঙ্গে জমাজমি যা আছে তাই বেঁচে না হয় বাইরে যেতাম। কিন্তু কোন দিক থেকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পেলাম না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও ওই ডাক্তার আমার হাত ধরে বলেছিলেন আপনার মেয়ের ট্রিটমেন্ট করেও ভাল হবে না। তার কাছ থেকেই অন্ধদের স্কুলের খোঁজ নিয়ে মেয়েকে সেখানে ভর্তি করলাম। নিজের দুই বিঘা জমি বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু চোখ ভাল হয়নি। এখন অনেক কষ্টে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। সমাজের বিত্তবানরা যদি তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিত তাহলে তার স্বপ্ন পূরণ হতো।’
×