ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় মৎস্যমেলা খামারবাড়িতে

ফরমালিনমুক্ত দেশী জাত- জীবন্ত ছোটাছুটি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২২ জুলাই ২০১৮

ফরমালিনমুক্ত দেশী জাত- জীবন্ত ছোটাছুটি

মোরসালিন মিজান ॥ বিশাল আকারের রুই মাছ। বাজারে গেলে সে তো কতই দেখা যায়। কিন্তু প্রমাণ সাইজের মাছটি নড়াচড়া করছে, লাফ দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে একটু পর পর, জল ছিটিয়ে আশপাশে জড়ো হওয়া মানুষজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, এ দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে কি? অন্তত শহর ঢাকায় দৃশ্যটি দুর্লভ। এখানে বরফকুঁচির ওপর শক্ত হয়ে শুয়ে থাকা মাছের সংখ্যাই বেশি। কৃর্ত্রিম উপায়ে যৌবন ধরে রাখার এই চেষ্টা দেখে ক্রেতারাও অভ্যস্থ। তাই মৎস্যমেলায় জীবন্ত মাছ দেখে তাদের চোখ ছানাভরা। কেউ কৌতূহল নিয়ে দেখছিলেন। কেউ ব্যাগ ভরে কিনছিলেন। তবে কেনাকাটার সুযোগ বেশি রাখা হলে মেলাটি বাজারে পরিণত হয়। তাই এবার এ ধরনের স্টলের সংখ্যা কম। মূল স্টল ও প্যাভিলিয়নে মাছ চাষ পদ্ধতি, পোনা উৎপাদন, জাত উন্নতকরণ প্রক্রিয়া, মাছের খাবার, ওষুধ, গবেষণা তথ্য, নানা প্রকল্পের মডেল ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখতে দেখতে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ ও সেক্টরটি নিয়ে সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে কী ধরনের কাজ হচ্ছে, তা সম্পর্কে একটি ধারণা নেয়া যায়। বর্তমানে সারা দেশেই চলছে মৎস্য সপ্তাহ। এ উপলক্ষে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে মৎস্যমেলার আয়োজন। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ প্রাঙ্গণে শুক্রবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে চলছে রাত ৯টা পর্যন্ত। পাঁচ দিনের মেলায় অংশ নিয়েছে মোট ২৪টি প্রতিষ্ঠান। স্টল ও প্যাভিলিয়ন সংখ্যা ৩৫টির মতো। প্রথমেই চোখে পড়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্যাভিলিয়নটি। এখানে অনেকগুলো কাচের চৌবাচ্চা। জলভর্তি চৌবাচ্চায় ছোটাছুটি করছে নানা জাতের মাছ। স্টলের দায়িত্বে থাকা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, এসব মাছ নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা করেন তারা। গবেষণার ফল হিসেবে মহাশোল, টেংরা, গুলশা, কৈসহ বেশ কিছু মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত প্রজনন কৌশলের মাধ্যমে জাত উন্নত করা হয়েছে। একেবারে নতুন গবেষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বাঁওড় অঞ্চলে মাছ চাষের জন্য খাঁচাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তারা। এ পদ্ধতিতে বাঁওড়ের কোন বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করে অন্য মাছ চাষ করা যাচ্ছে। মেলায় মৎস্য অধিদফতরের একাধিক প্যাভিলিয়ন। এসবে বিভিন্ন প্রকল্পের মডেল উপস্থাপন করা হয়েছে। কাঁকড়া ও কুঁচে চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া হচ্ছে আগ্রহীদের। গবেষণা কর্মকর্তা সমীর সরকার জানান, বিদেশে কাঁকড়া ও কুঁচের প্রচুর চাহিদা। তাই এই চাষে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করছি আমরা। দেশের ৩৫ উপজেলায় এ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিতে কাঁকড়া ও কুঁচে চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি। সামুদ্রিক মাছের খোঁজখবর দিচ্ছে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের একটি স্টল। এখানে একশ’র মতো মাছ। সমান সংখ্যক কাচের বৈয়ামে ভরে রাখা হয়েছে। কেমিক্যালের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা মাছ দারুণ কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। নামগুলোও বিচিত্র। এই ধরা যাকÑ রূপবান, রঙ্গিলা, তাপসী, হাঙ্গর, রাজকাঁকড়া, সবুজ চেউ, রাঙ্গা চইক্কা, দাঁড়কুটা, চাশা চিংড়ি, লইট্টা...। বিচিত্র না নামগুলো? স্টলের কর্মী আবু জাফর আহমেদ জানান, প্রকল্পের কর্মকর্তারা বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্র চষে বেড়ান। এ প্রক্রিয়ায় ২৯৮ প্রজাতির মাছ, ২৩ প্রজাতির চিংড়ি, ৬৬ প্রজাতির কাঁকড়া ও ১২ প্রজাতির মোলাস্ক শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কয়েকটি স্টলে শুধু পোনা মাছের প্রদর্শনী। সাদিয়া মৎস্য হ্যাচারির স্টলে গিয়ে দেখা যায়, কাচের চৌবাচ্চায় এ্যাকুরিয়ামে ভিয়েতনাম কৈ শিং মাগুর পাবদা গুলসা ও শোল মাছের পোনা কিলবিল করছে। সারা দেশেই পোনা সরবরাহ করে বলে জানান মুক্তাগাছার ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক। মাছের খাবার এবং ওষুধ সম্পর্কেও তথ্য দেয়া হচ্ছে মেলায়। এসবের বাইরে, আগেই বলা হয়েছে, মেলায় রয়েছে ফরমালিনমুক্ত তাজা মাছ কেনার দারুণ সুযোগ। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ ধরনের স্টলের সংখ্যা কম হলেও, নানা জাতের টাটকা মাছ পাওয়া যাচ্ছে এখানে। সরকারী প্রতিষ্ঠান মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের স্টলে আছে ৪০ থেকে ৪৫ জাতের মাছ। স্টলের কর্মী সাদেক সরকার জানান, রাজশাহী নাটোর ফেনী চাঁদপুর ভোলা বরিশালসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল থেকে এসব মাছ সংগ্রহ করা হয়। উপকূলীয় এলাকায় কর্পোরেশনের নিজস্ব মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রও রয়েছে। উৎসগুলো থেকে মাছ সংগ্রহ করে ফরমালিন পরীক্ষা শেষে বিক্রির উদ্যোগ নেয় কর্পোরেশন। ঢাকায় প্রতিদিন ৩টি ভ্রাম্যমাণ গাগিতে করে মাছ বিক্রি করা হয়। এখন কেনা যাচ্ছে মেলা থেকেও। ফিশ বাংলা নামের একটি স্টলে কথা হয় শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে। নাম আশরাফ। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। বেশ অকপট। তিনি জানান, অনলাইনে মাছের ব্যবসা করেন তিনি। তার ওয়েব সাইটে গিয়ে মাছ অর্ডার করা হলে মুহূর্তেই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয়। বিদেশ থেকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনেক প্রবাসী অর্ডার দিয়ে থাকেন বলে জানান। তিনি বলেন, আমেরিকায় অবস্থান করেও, কোন সন্তান চাইলে বাংলাদেশে থাকা মায়ের কাছে মাছ পাঠাতে পারবেন! এখানেই শেষ নয়, অনলাইনভিত্তিক মাছ বিক্রয়কারী আরেক প্রতিষ্ঠান হেলদি ফুড লিমিটেড মেলায় আগতদের মাছ ভেজে খাওয়াচ্ছে! সামুদ্রিক মাছ দিয়ে সুস্বাদু খাবারও তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাতেমা পারভিন পুতুল জানান, তারা সামুদ্রিক মাছ কেটে রান্নার প্রস্তুত করে অনলাইনে বিক্রি করেন। বিক্রিও ভাল বলে জানান তিনি। সব মিলিয়ে ঢুঁ মারার মতো একটি আয়োজন। কেন্দ্রীয় মৎস্যমেলা মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে।
×