ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হালদা সংরক্ষণে মেকং নদীর নীতি অনুসরণীয়

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২২ জুলাই ২০১৮

হালদা সংরক্ষণে মেকং নদীর নীতি অনুসরণীয়

হালদাকে আঁকড়ে থাকা প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারসহ জড়িয়ে আছে বিশ হাজার মানুষের জীবিকায়ন। নদী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত: পরিবেশগত। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি মাছের ওজন সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মণ পর্যন্ত হয়। এসব মাছ ডিম দেয় একসঙ্গে ৫ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত। বর্তমানে হালদা নদীতে মিঠা পানির ডলফিনসহ ৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত এই হালদা। আগে হালদার যে পরিমাণ মাছ ও ডিম পাওয়া যেত এখন তার এক চতুর্থাংশও মেলে না। হালদা সম্পর্কে জ্ঞাতব্য আমরা জানি হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের নিকট কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। পানির উৎস মানিকছড়ি, ধুরং, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, লেলাং, বোয়ালিয়া, চানখালী, সর্ত্তা, কাগতিয়া, সোনাইখাল, পারাখালী, খাটাখালীসহ বেশকিছু ছোট ছোট ছড়া। নদীটির গভীরতা স্থান বিশেষ ২৫ থেকে ৫০ ফুট। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে- হালদায় এক সময় ৭২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কালপরিক্রমায় পাঙ্গাশ, ঘনি চাপিলা, কইপুঁটি, বাণী কোকসা, ঘর পুঁইয়া, গুইজ্জা আইর, বুদ বাইলাসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জানা গেছে, ১৯৪৫ সালে শুধু হালদা থেকেই ৫০০০ কেজি রেণু সংগ্রহ করা হতো। এক সময় হালদায় ২০-২৫ কেজি ওজনের কাতলা, ১২-১৫ কেজি ওজনের রুই এবং ৮-১০ কেজি ওজনের মৃগেল পাওয়া যেত যা এখন কালেভাদ্রে চোখে পড়ে। মৎস্য অধিদফতরের সংকলন-২০১৩ থেকে জানা যায়- হালদা থেকে ১৯৪৫ সালে সংগৃহীত ডিম ১,৩৬,৫০০ কেজি এবং ৬৫ বছর পর ২০১১ সালে সংগৃহীত ডিম ১৩০৪০ কেজি। প্রাকৃতিক এগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রির অপর নাম হালদা হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি হিসেবেও পরিচিত। জনশ্রুতি আছে- হালদা নদী থেকে প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হতো। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। হালদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুযায়ী, হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি মাছ থেকে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তাই অপার সম্ভাবনাময় এ নদীকে ঘিরে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে জাতীয় অর্থনীতিতে শত কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। জেনে রাখার মতো বিষয় হলো- ডিম থেকে উৎপাদিত রেণুু পোনা থেকে মাছ হিসাবে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে হালদা নদী চার ধাপে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, হালদায় বর্তমানে মাছ যে পরিমাণে ডিম ছাড়ে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ডিম ছাড়ে কাতলা মাছ। ১৮ থেকে ২০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ ডিম দেয় প্রায় ৪০ লাখ। একটি মা মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। ১ম ধাপে ডিম থেকে রেণু বিক্রি করে, ২য় ধাপে ধানী পোনা বিক্রি করে, ৩য় ধাপে আঙ্গুলি পোনা বিক্রি করে, ৪র্থ ধাপে এক বছর বয়সে মাছ হিসাবে বাজারজাত করে। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি ধাপে ৪০ শতাংশ মৃত্যু হার বাদ দিয়ে হিসাব করলে একটি মা কাতলা মাছ প্রতিবছর হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই হিসেবে হালদার প্রতিটি মা মাছকে একেকটি প্রাকৃতিক এগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রি বলেও অভিহিত করছেন হালদা গবেষকরা। একক নদী হিসেবে হালদার অবদান সবচেয়ে বেশি একক নদী হিসাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান সবচেয়ে বেশি। এ নদীকে যদি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা যায়, তাহলে অবদানের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব। হালদা নদী ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু, রেণু থেকে মাছ হিসেবে খাওয়ার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাত চার ধাপে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। হালদার একটি মা-মাছ কাতলা মা-মাছ তৃতীয় বছর বয়স থেকে পরিপক্বতা লাভ করে ডিম দেয়া শুরু করে। একটি মা-মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে (স্তরে) আয় করা যায়। একই পদ্ধতিতে এক বছরের চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮২১ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ। সঙ্কটে বিরল বৈশিষ্ট্যের নদী হালদা হালদাকে বলা হয় পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র্র হিসেবেও হালদা বিশ্বজুড়ে পরিচিত হলেও দখল, দূষণ, লবণাক্ততা, রাবার ড্যাম নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে হালদা নদী এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে, শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকে সৃষ্ট দূষণের কারণে সেখানে কার্প জাতীয় মাছ রুই, কাতল, মৃগেল ও কালিবাউশ ডিম ছাড়ার হার কমে গেছে। নদীতে লবণাক্ততাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে, সুপেয় পানি সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। হালদা নদীর উজান এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণের কারণে পানির প্রবাহ অনেক কমে গেছে। যদিও এবছর মা মাছ ডিম ছাড়ার প্রথম দিনেই প্রায় ২২হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন হালদার জেলেরা যা গত এক দশকের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। হালদা সংরক্ষণে প্রয়োজন মেকং নদীর নীতি অনুসরণীয় হালদাকে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেকংয়ের সঙ্গে। মিয়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে একটি সমন্বিত নদী কমিশন গঠন করে মেকং নদীতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে তাদের সারা বছরের মাছের চাহিদা পূরণ করছে। জানা গেছে, মেকং নদীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সমন্বিত নদী কমিশনের যৌথভাবে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদী থেকে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এরফলে নবেম্বর থেকে মে পর্যন্ত মাছ ধরার জন্য মেকং নদী উন্মুক্ত করে দিলে জেলেরা নদী থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করে। হালদা নদীকে নিয়েও মেকং নদীর মরত একটি পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জাতীয় মৎস্য অর্থনীতিতে একক নদী হালদার অবদান আরও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছাবে। আমাদের প্রশ্ন- আমরা কেন দেশের অভ্যন্তরের মাছের খনি হালদা, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীতে বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ শিকার বন্ধ করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পারছি না। রুই জাতীয় মাছের পরে হালদার অন্যতম প্রধান মাছ হচ্ছে গলদা চিংড়ি। তবে হালদার গলদা চিংড়ির রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। গবেষকদের মতে, একটি পরিপক্ক গলদা চিংড়ি এক সঙ্গে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার ডিম ছাড়ে। জানা গেছে, কর্ণফুলীর মুখ থেকে মাদারীখালের মুখ পর্যন্ত জেলেরা গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা গলদা চিংড়ি খামারগুলোতে সরবরাহ করে।
×