ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

ঐতিহ্যের ধারক শতরঞ্জি

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২২ জুলাই ২০১৮

ঐতিহ্যের ধারক শতরঞ্জি

আসবাবের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রয়োজন ঘর সাজানো ভিন্ন ভিন্ন শতরঞ্জি। ঘরের সৌন্দর্যে একটু বাঙালীয়ানা ভাব ফুটিয়ে তুলতে শতরঞ্জির ব্যবহার হতে পারে ঘরের প্রধান আকর্ষণ। শুধু মেঝেতেই নয়, দেয়াল সাজাতেও ব্যবহার করা যায় যুগোপযোগী বিভিন্ন ধরনের শতরঞ্জি। রংপুর জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্য হচ্ছে শতরঞ্জি। এয়োদশ শতাব্দীতে শতরঞ্জির প্রচলন ছিল। রাজা-বাদশাহদের গৃহে এর ব্যাপক কদর ছিল। মোঘল স¤্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ত্রিশ দশকের জমিদার জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সে সময়ে শতরঞ্জি রাজা-বাদশাহ্, বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। ব্রিটিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এখানকার তৈরি শতরঞ্জি সমগ্র ভারতবর্ষ, বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে ‘শতরঞ্জি বুনন’ সবচেয়ে প্রাচীনতম। মজার ব্যাপার হলো, এ পণ্য উৎপাদনে কোন প্রকার যান্ত্রিক ব্যবহার নেই। কেবলমাত্র বাঁশ এবং রশি দিয়ে মাটির ওপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোন জোড়া ছাড়া যে কোন মাপের শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। এর সৌন্দর্য ও টেকসই উল্লেখ করার মতো। বর্তমান সভ্যতায় কারুশিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে যা শতরঞ্জির জন্য অত্যন্ত শুভ। বর্তমানে বিদেশেও এর চাহিদা বাড়ছে। ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রফতানির করে আয় হয় ২০ হাজার ডলার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘আইকা’ বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী আমদানি করে তা ইউরোপের চাহিদা পূরণ করেছে। চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ‘আইকা’ ছাড়াও বিবি রাসেল ও কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। রংপুরের নিভৃত পল্লীতে উৎপাদিত শতরঞ্জি সামগ্রী ঢাকার বেশ কয়েকজন রফতানিকারকের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। যার ফলে নতুন নতুন রফতানির বাজারও আবিষ্কৃত হচ্ছে। বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়াসহ প্রায় ৫৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ২০১৬ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে ৫ কোটি ডলারের বেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোয় শতরঞ্জির চাহিদা বেশি। ডিজাইনে বৈচিত্র্য থাকার কারণে শৌখিন পণ্য হিসেবে এগুলোর বেশ বাজার রয়েছে উন্নত দেশে। এমনকি বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড নামক একটি বে-সরকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরির পাঁচটি কারখানা। বর্তমানে এসব কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে রফতানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রফতানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এই রংপুরের উৎপাদিত শতরঞ্জির মাধ্যমে। রংপুরের অজপাড়া গা নিসবেতগঞ্জ থেকে যে আজ শতরঞ্জি রফতানি হচ্ছে তা নয়। নতুন উদ্যামে বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি। নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি পল্লী যেন এক বিশাল কারুপণ্যে পরিণত হয়েছে। নিসবেতগঞ্জের অধিকাংশ বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা উঠানে টিনের ছাউনির নিচে নিপুণ হাতে চলছে কারুকাজ খচিত শতরঞ্জি বোনার কাজ। যেখানে পূর্বে হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই ইত্যাদি নামের নকশা সংবলিত শতরঞ্জি তৈরি হতো সেখানে এখন আরও রং বেরং এর বাহারি নকশার শতরঞ্জি উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জে স্থাপিত কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড কারখানার ভবনটি সাততলা। প্রধান উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিমের এই কারুপণ্যের কারখানায় তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি। প্রায় তিন লাখ বর্গফুটজুড়ে কারখানাটি তৈরি। দিনে-রাতে দুই শিফটে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করেন। এটি রংপুর অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য। একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই শিল্প আবার জেগে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে হাতেগোনা কয়েকজন পুরনো কারিগরকে সংগঠিত করে নতুন করে এর যাত্রা শুরু“হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রফতানি বাণিজ্যে শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ রফতানি করে থাকে কারুপণ্য। সে জন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া জাতীয় রফতানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে। প্রতিবছর উত্তরোত্তর শতরঞ্জির রফতানি বৃদ্ধি, বিসিকের গঠনমূলক উদ্যোগ, শতরঞ্জিশিল্পের সঙ্গে জড়িত সবার নিরঙ্কুশ প্রচেষ্টা। সব মিলিয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় পথেই অগ্রসর হচ্ছে শতরঞ্জিশিল্প। ফিরে পাচ্ছে তার ঐতিহ্য।
×