ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মলয় বিকাশ দেবনাথ

ভাষা ও সংস্কৃতির তিনি

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১০ আগস্ট ২০১৮

ভাষা ও সংস্কৃতির তিনি

‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’(স্বদেশী সমাজ, দ্বিতীয় খ-: বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃ.৬৩৪)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীর পরিস্ফূটন ঘটেছিল এই বঙ্গদেশে। আমরা পেয়েছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ধরে রাখতে পারিনি। অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। হায় অভাগা জাতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে যখনই পরিকল্পনা মতো সাজাচ্ছিলেন ঠিক তখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দোসরেরা কালছায়ায় লেপণ করল। সৃষ্টি করল কলঙ্কজনক ৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এরপর শুধুই পিছিয়ে পরা। এরই ধারাবাহিকতায় সিরিজ বোমা হামলা, উদীচী বোমা হামলা, শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা, আহছান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। সঙ্ঘবদ্ধ এই চক্র আজও সক্রিয়। আজ আবারও আগস্ট মাসেই কোমলমতি বাচ্চাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে সামাজিক বিপর্যয় ঘটাতে উন্মত্ত। কিন্তু মানুষ আজ যথেষ্ট সচেতন। নীল নক্সার বাস্তবায়ন জাতি আর এই বাংলায় হতে দেবে না। প্রতিহত করে দেখিয়েছে। মাতৃভাষা রক্ষায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি মানুষের অধিকার রক্ষায় নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। আবার দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তাঁর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তৃতা, সাক্ষাতকার এবং রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় তিনি সর্বস্তরে বাংলা চালুর এই পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমিতে শহীদ দিবস (ভাষা শহীদ দিবস) উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় আসলে শুরুতেই বাংলা ভাষা চালু করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বলেন, ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এছাড়াও তিনি লেখক, কবি এবং নাট্যকারদের মুক্তমনে লেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যই সাহিত্য। এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন। দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সংবাদ পাঠালেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স কম ছিল। সেদিন আবেদিন স্যার যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হাশেমকে আমি চিনি। ও ছয় দফার লোগো এঁকে তার সঙ্গে ষড়ঋতুর যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল তা আমার মনে আছে।’ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম ঋতুবৈচিত্র্যের শিক্ষা আমি আবেদিন স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। তারপর সংবিধানের নক্সার কাজ শুরু হয়। আমাদের উপদেষ্টা ছিলেন জয়নুল আবেদিন। লন্ডন থেকে শিল্পী আবদুর রউফকে আনা হয়েছিল লেখার জন্য, প্রধান নক্সাবিদ ছিলাম আমি এবং আমার সঙ্গে সহকারী ছিলেন শিল্পী জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী এবং আবুল বারক আলভী। এটি আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।’’ শাহাবুদ্দিনের ‘বঙ্গবন্ধু-২’-এ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরবর্তী দৃশ্য উঠে এসেছে। নিজ বাড়ির দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়েছেন হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটি। তাঁর শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে লাল-সবুজ রক্ত। যেন বঙ্গবন্ধুর গায়ে নয়, ঘাতকের বুলেট আঘাত করেছে বাংলাদেশকেই। শিল্পীর আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও পরিশীলিত চর্চায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। যে বিশালত্ব উপলব্ধি করেছিলেন বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। জাতির পিতার গতিময় ব্যক্তিত্ব উঠে এসেছে তাঁর তুলিতে। অন্যদিকে কাইয়ুম চৌধুরী কয়েকটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে নিজস্ব শিল্প চারিত্র্যে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রধানত নক্সাধর্মী বা ডিজাইনিক বৈশিষ্ট্যকে শিল্পকর্মে প্রয়োগ করে থাকেন; উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আঁকা ছবিতে তেল রঙের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি সজীব হয়ে উঠেছে। মানবিক, প্রকৃতিবান্ধব, মা, মাটি, মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পীদের তুলিতেই ফুটে উঠেছে । ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘বাঙালীর সাংস্কৃতিক মুক্তি ৬-দফায় সন্নিবেশিত বাংলার মাটিতে জাতীয় একাডেমি হইবেই’। ২৪ জানুয়ারি সঙ্গীতশিল্পীদের সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এ ঘোষণা করেন এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের যথোচিত ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, শিল্প-সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে, লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে। তাঁর অভিমত ছিল, জনগণই সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনদিন কোন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। তিনি নিজে সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সংগ্রাম করেছেন। এই জনগণ কেবল শহরে থাকে না, গ্রামে এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের বিষয়েও তিনি মনোযোগ দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণ সচেতন শিল্পী-সাহিত্যিককে উদ্বেলিত করেছিল। আর তিনি নিজে নিবিড় জনসংযোগের মধ্য দিয়ে ‘রাজনীতির কবি’ হয়েছিলেন বলেই তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আলোড়িত হয়েছে। বাঙালীর ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল একনিষ্ঠ ভালবাসা। বাংলার নদী, বাংলার জল, বাঙালীর খাবার, গান, বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে সর্বদা মুগ্ধ করত। শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শুনে তিনি লিখেছিলেন- ‘নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতে ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১১১)। ১৯৭৩ সালে ফরাসী দার্শনিক আর্দে মার্লো ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- ‘তাকে আর শুধু একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভাবা যায় না। তাকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি, শস্যক্ষেত্রের মাঝে।’ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার, পুঙ্খানুঙ্খভাবে স্থান পেয়েছে (পৃ. ৯১-১০০, ১৯৬-২০৭)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন শিল্পী, তার শৈল্পিক চেতনার বাস্তবায়ন ঘটেছে প্রতিটি কর্মে। বঙ্গবন্ধুর শৈল্পিক চেতনার বিভিন্ন দিক খুঁজে পাওয়া যায় তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি বিশ্লেষণ করে। এখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও অন্যান্য ঘটনা স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উদার পরিবেশ, মননশীল পারিবারিক মূল্যবোধ, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠেছেন। আত্মজীবনীতে বলেছেন- ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকেই আমি সব কাগজই পড়তাম’ (আত্মজীবনী, পৃ-১০)। বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত, কবিতা, সাহিত্য প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানী দোসরদের বিরুদ্ধে বাঙালীর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র জš§-শতবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়। একই বছর প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখ সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন এবং জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শিল্প সাহিত্য নিয়ে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। তার ভাষায়- ‘মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। জনগণ হলো সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনদিন কোন সৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।’ (দৈনিক বাংলা, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪)। বঙ্গবন্ধু তার সব সাংগঠনিক কার্যক্রমে শিল্পী-সাহিত্যিকদের যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই প্রথম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। বঙ্গবন্ধু শিল্প-সংস্কৃতির চেতনাসম্পন্ন উপযুক্ত নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সর্বজনীন শিক্ষা প্রসারে ‘কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু দেশের সৃজনশীল শিল্পী ও তাদের পোষ্যদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি দেশ গড়ায় ইতিহাস, সংস্কৃতি তথা আমাদের শেকড়কে অবলম্বন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে অনেক শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন, তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছিল রবার্ট পেইন, জর্জ বার্নার্ডশ, বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলী, মাও সেতুং স্বাক্ষরিত গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণকালে একই গাড়িতে করাচি আসার পথে উর্দুভাষী কয়েকজন পাকিস্তানীকে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২১৭)। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২২৮)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গিয়েছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ডশ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলোতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যতœ করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মা’র সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা (পাকিস্তানীরা) নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ হাসিনা : শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪, পৃ. ৭০-৭১)। বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কেবল সাধারণ মানুষ কিংবা কৃষক-শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবে স্বীয় শ্রেণীর শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তা ছাড়া আগেই বলা হয়েছে, তিনি সাহিত্যের একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করে ঢাকায় আনেন। ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবির বাসায় যাওয়ার সময় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সব সময়ই কাছে নিয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, সমরজিৎ রায়চৌধুরী প্রমুখ কবি ও চিত্রশিল্পী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক ছবি রয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের মাঝেও তাঁকে দেখা গেছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।’ অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণ-এ আছে, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্মথ রায়কে বাম পার্শ্বে ও তাঁকে দক্ষিণ পাশে বসিয়ে সেদিন নানা অন্তরঙ্গ কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি অসুস্থ কবি হুমায়ূন কাদির, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহাকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন প্রেরণ করেন এবং একটি কবিতা লেখার জন্য দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কবি আল মাহমুদকে জেল থেকে মুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন নাটকের একজন সুহৃদ। টেলিভিশন ও মঞ্চনাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর ও সেন্সর প্রথা সহজতর করেছিলেন। এমনি একজন মহান নেতা যিনি ব্যস্ত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হয়েও শিল্পের নান্দনিকতাকে উপলব্ধি করেছিলেন। সে সাথে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ও সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শিল্পের যে দ্রুত উন্নয়ন কেবল তাঁর বদৌলতেই সম্ভব হয়েছিল। আজ তাঁর আদর্শে বেড়ে ওঠা তাঁরই সুযোগ্য কন্যা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। তাই প্রত্যাশা সঠিক স্বর্ণময় গৌরবের ইতিহাসকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রবংশের কাছে পৌঁছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।
×