ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাইসা আহমদ লিসা

রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই পথ চলা

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ১০ আগস্ট ২০১৮

রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই পথ চলা

অপরাজিতা : জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার, শিক্ষা... লিসা : আমার জন্ম রাজশাহীতে। বাবা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ মা খানম মমতাজ আহমদ। একেবারেই সাংস্কৃতিক পরিম-লে আমার জন্ম বলেই গান, বিষয়টি আমার কাছে খুব সহজাত ছিল। এটার জন্য আলাদা কোন পরিবেশের প্রয়োজন হয়নি। জন্মাবধি বাড়িতে গানের চর্চা দেখে আসছি। বাড়িতে বাবাই মূলত গানের মানুষ ছিলেন। তার কারণেই গানের চর্চা চলত। তিনি ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। আমি যতদূর আমার স্মৃতিকে নিতে পারি মনে পড়ে, সাদা ফরাশ বিছানো, সেখানে গান হয়েছে সারারাত। আমি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার ভাই ডাঃ ইমতিয়াজ আহমদ উনিও গান করেন। তিনি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। ইংলান্ডে থাকেন। অপরাজিতা : সঙ্গীতের গুরু এবং যাকে আদর্শ মানেন... লিসা : বাবার কাছেই মূলত আমার প্রথম গান শেখা। এরপর বাবার সহকর্মী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বালার অধ্যাপক, এখন স্বনামধন্য লেখক গোলাম মুর্শিদ, ওনার কাছে শিখতে শুরু করি। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নিয়েছি ওস্তাদ রবিউল হোসেন এবং ওস্তাদ অমরেশ রায় চৌধুরীর কাছে। অপরাজিতা : আপনার কর্মময় জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনাকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করে? লিসা : আজকে আমি যেটুকু হতে পেরেছি সেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনেকটাই। তাঁর গানের ভেতর দিয়ে জগতটাকে দেখেছি, জেনেছি। যেটুকু রুচিবোধ হয়েছে, মানুষকে ভালবাসতে শিখেছি, প্রকৃতির প্রতি যে প্রেমের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের দর্শন কাজ করে। তাঁর গানের ভেতর দিয়ে জগত সংসারটাকে অনুধাবন করা যায়। মন খারাপ কিংবা আনন্দঘন মুহূর্তে যদি গীতবিতান খুলি কোন না কোন একটা গানের সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যক্তি জীবনের ঘটনা রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে তাঁর অনুভূতির সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায়। তখন একটা নির্ভরতা কাজ করে। মনে হয় যেন, কী করে তিনি আমার মনের কথা জানলেন? অপরাজিতা : আপনি ছোটবেলা থেকেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হকের সান্নিধ্য পেয়েছেন, এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন। লিসা : আমার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। ১১ বছর বয়স থেকেই সেইভাবে ওয়াহিদুল হকের সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি গান শিখিয়েছেন, প্রকৃতি চিনিয়েছেন, বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করেছেন। গানের ভাবার্থ বুঝিয়েছেন। শুধু যে রবীন্দ্রনাথের গান তা নয়, পঞ্চকবির গানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এই গীতিকবিদের গানের দ্বারাও আমি প্রভাবিত হয়েছি। অপরাজিতা : সময় এবং পরিস্থিতি ভেদে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভাবের ভিন্নতা... লিসা : মানুষের জীবন ধারার সঙ্গে অভিজ্ঞতাগুলো যে একটু একটু করে এগিয়ে যায় এটা তারই প্রকাশ। ছোটবেলায় সুরটা ভাললাগে গানের কথা হয়ত বুঝতে পারে না। গানের সুর, বাণী, তাল, লয়, ছন্দ সব মিলিয়ে যে একটা ছবি আছে সেটা যদি কেউ গ্রহণ করতে পারে এবং গাইবার ভেতর দিয়ে যদি তা ব্যক্ত করতে পারে নিশ্চয় শ্রোতার কাছে তা অন্যরকম শোনায়। কারণ যখন আমার ১১ বছর বয়স তখন যেভাবে গাইতাম নিশ্চয় এখন সেভাবে গাইব না। এর মাঝের সময়টাতে কতকিছুই তো যুক্ত হয়েছে। উপলব্ধিগত পরিবর্তন হলে সেখানে তো গুণগত পরিবর্তন হবেই। অপরাজিতা : রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর-বাণীর প্রাধান্যতা... লিসা : রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বড় মাপের কম্পোজার। তাঁর গান বেহালা, পিয়ানো কিংবা বাঁশি যেটাতেই বাজুক না কেন, পরিষ্কার করেই বলা যায় এটা রবীন্দ্রনাথের গান। যদি বাণী নাও থাকে সুর শুনেই বোঝা যায় এটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। তিনি বাউল গান, ভাঙ্গা গান, কর্ণাটকি সঙ্গীত, রাগাশ্রিত গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু সবকিছু মিলে তাঁর গান যে নিজের সৃষ্টি তা পরিষ্কার ভাবেই বলা যায়। বাণী প্রধানত অবশ্যই। তিনি যে বাণীটাকে বলতে চেয়েছেন তার একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন সুরটাকে। এটা তো আবৃত্তি নয়, যে সুর ছাড়া হবে। সুরের সঙ্গে বাণীর মেলবন্ধনে যে ভিন্ন কিছুর সৃষ্টি যা উপলব্ধিগত সেটাই তো সঙ্গীত। অপরাজিতা : রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাগের ব্যবহার... লিসা : কবিগুরু তাঁর গানে বিভিন্ন রাগের ব্যবহার করেছেন, নিজস্ব অঙ্গিকে। যেমন তাঁর গানে ভৈরবীর সুরের ব্যবহার এক একভাবে প্রকাশ পয়েছে। আবার ভাইরো, পূরবী, অথবা ইমনের ব্যবহৃত স্বরগুলো গানের কথার সঙ্গে এক্সপ্রেশন প্রকাশের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়েছে। তিনি হয়ত একটা স্বরের ভেতর দিয়ে গেলেন, যেটাকে ভাইরো বলা যায় অথবা পূরবী বলা যায় তারপরও দেখা যাচ্ছে তিনি সেগুলোর প্রয়োগ গানের ভাব প্রকাশের জন্য নিজের মতো করে করছেন। অপরাজিতা : বিশ্বকবির গানে প্রেম-পূজার যে মেলবন্ধন... লিসা : কবিগুরুর গানে প্রেম-পূজা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কিছু গানের ক্ষেত্রে এটা পৃথক করা কঠিন। কিছু গান আছে যেটাতে মানবপ্রেম বোঝা যায়। কিন্তু পূজা পর্যায়ের কিছু গান রয়েছে, যা কখনও কখনও মনে হয় প্রেম পর্যায়ের গান। আসলে রবীন্দ্রনাথ নিজের ভেতরেই ঈশ্বরের একটা আসন পেতেছেন। তিনি মনে করেন ঈশ্বর তাঁর নিজেরই অন্য একটা রূপ। যেমন ‘শুধু তোমার বাণী নয়গো হে বন্ধু’ গানটিতে ঈশ্বরকে তিনি বন্ধু হিসেবে দেখেছেন। এই দর্শন তো আমরা সব কবির কাছ থেকে পাই না। তাঁর গানে ঈশ্বর নেমে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে দেয়া নেয়ার যে সম্পর্ক সেই রূপে তিনি প্রকাশ পেয়েছেন। আবার অনেক গানে কৌতুকও আছে। অপরাজিতা : বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মানবতার ধস উত্তোরণে রবীন্দ্রসঙ্গীত কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে? লিসা : রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শিল্পী সমাজ তাঁর গান গেয়ে সবার ভেতরে উদ্দীপনা যুগিয়েছে। আমরা যদি মানবতার কথা বলি, পরস্পরকে ভালবাসার কথা বলি, সৌহার্দ্য আর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই তাহলে রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করতেই হবে। মানবিক সমাজ গঠন করার লক্ষ্যে আমরা যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত, তাঁর দর্শন, সমস্ত শিল্পকর্মকে অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে পারি, এবং তা যদি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, নিশ্চয় আমাদের অন্ধকার সময়ের অবসান হবে। অপরাজিতা : বর্তমান সমাজে নারীর অবস্থান এব রবীন্দ্র শিল্পকর্মে নারী ভাবনা... লিসা : যে যতই বড় পদে থাকুন না কেন নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তার একটা প্রভেদ তো আছেই। আমি নিজেকে নারী বললে হঠাৎ করেই একটু থমকে যাই। কারণ আমি এভাবে বড় হইনি। নিজেকে মানুষ ভাবতেই বেশি পছন্দ করি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের কিছুটা অবমূল্যায়ন করা হয়। এ বিষয়ে আমি বলব, ‘আমি আমার কাজ দিয়ে প্রমাণ করব যে আমি পিছিয়ে নেই।’ আমি মনে করি একটা মেয়ে যখন এগিয়ে যেতে চায়, শতবাধা থাকলেও তার এ প্রত্যয় থাকা উচিত যে, ‘আমি একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হব। আমি নারী এ বিষয়টি কোনভাবেই আমাকে পিছু টানতে পারবে না, কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না।’ মানবিক সমাজ গড়বার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়েরই সমান অধিকার। নারী যদি একজন মানুষ হিসেবে, সমাজের চালিকাশক্তির একটা বড় অংশ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় সেখানে রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরী। কবিগুরুর গীতিনাট্য চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা এক্ষেত্রে অনেক বড় উদাহরণ। চন্ডালিকায় জাতিভেদ, এবং মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির যে আচার সে বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। চিত্রাঙ্গদায় কুরূপা আর সুরূপা নারীর দৃঢ়তা আর কোমলতার প্রতীক। এ দুটির সমন্বয়ে যে একজন সার্থক নারী তা আমরা রবীন্দ্রসৃষ্ট কর্ম থেকেই জানতে পাই। অপরাজিতা : নারী হিসেবে আপনার জীবনে কোন প্রতিবন্ধকতা এসেছে কি? লিসা : আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষারভাব দেখেছি। আমি মনে করি, এটা তাদের স্পর্শকতারতা এবং ঈর্ষাকাতরতা ছাড়া আর কিছুই না। তবে এ বিষয়গুলো আমাকে খুব বেশি ভাবায় না। আমার খারাপ লাগে তাদের কথা ভেবে, যে তারা আসলে এ জায়গাটাতে যেতে চায়, সেটা হয়ত পারে না বা পারেনি। কখনও কখনও তারা তুলনা করে ফেলে। বিন্তু আমি তাদের প্রত্যাঘাত করি না। অপরাজিতা : কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? লিসা : মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চাই। যেখানে মানবতা আছে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই।
×