ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইসমত আরা জুলী

নিরাপদ সড়কসহ পরিবহনেও নিরাপত্তার দাবি ছাত্রীদের

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ১০ আগস্ট ২০১৮

নিরাপদ সড়কসহ পরিবহনেও নিরাপত্তার দাবি ছাত্রীদের

বিংশশতাব্দীর রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায়ও জন্ম হয়েছিল একজন প্রীতিলতার, একজন ইলামিত্রের। একজন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলেন আর আরেকজন কৃষক ও আদিবাসী সাঁওতালদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা কিন্তু তারপরও আমরা ভাবি ‘মেয়েরা পারবে তো’? কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আদলে আমরা আমাদের ভেতরের সত্তাটিকে এভাবেই লালন পালন করে থাকি, আমাদের চিন্তাভাবনাও নির্দিষ্ট ছকেই সাজানো থাকে। ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দু’জন ছাত্রছাত্রী গত কয়েকদিন আগে দুটি বাসের বাস চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকার রাজপথ বিদীর্ণ করেছে আমাদের হৃদয়। সে ঘটনার জের ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে রাজধানী, আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য অংশেও। এর মধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে থেকে বলা হয়েছে তাদের সব দাবি মেনে নেবার কথা এবং আহ্বান এসেছে তাদের রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফিরে যাবার। কিন্তু কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রতিটি দাবির বাস্তবায়ন চায় এবং আন্দোলনের ফসল ঘরে না উঠিয়ে ঘরে ফিরবে না বলে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গত আট দিনে আমাদের চোখের সামনে উঠে এসেছে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থার অবিশ্বাস্যরকমের দুর্বলতা এবং সীমাহীন দুর্নীতির কথা। ছাত্রছাত্রীরা চালু করেছে সমান্তরাল একটি ট্রাফিক ব্যবস্থা যে ব্যবস্থার কাছে নতজানু হয়েছেন মন্ত্রী, আমলা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে। অনিয়মকে নিয়ম বানানো এই ট্রাফিক ব্যবস্থা কার্যত যে অচল তাই প্রমাণ করে দিল ছাত্রসমাজ। এই সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছে ছাত্রীরা মানে আমাদের মেয়েরাও। তারাও ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালকের ও গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে কখনওবা রিক্সাকে এক লাইনে চলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করছে। এরই মধ্যে একটি ছবি যেটাতে মেয়ে তার বাবার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করছে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই সামাজিক আন্দোলন যেটা শুধু ছাত্রসমাজের একার দাবি না সতেরো কোটি মানুষের দাবি তা বড় আকারে রূপ নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলেছি কয়েকজন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে যারা এ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে। জেনে নিলাম তাদের আন্দোলনের খবরা-খবর। প্রথম প্রশ্ন ছিল সরকার সব দাবি মেনে নেবার ঘোষণা দিয়েছে এবং তাদেরকে ঘরে ফিরে যাবার জন্য বারবার অনুরোধ করছে এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া কি? একজন কলেজছাত্রী বলল, আসলে আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাই যে অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয় কিন্তু পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়িত হয় না। তাই দাবিগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলল এটা যদি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো হয় আশ্বাস দেবার পর বিশ্বাস ভেঙে দেয়া সে আশঙ্কার কারণে আমরা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে তা না দেখা পর্যন্ত আমাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাব। আরও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলল আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা না করার জন্য সরকারের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি। এই দাবি আজ সারাদেশের মানুষের দাবি সবাই রাস্তায় চলাচলে নিরাপত্তা চায় তাই এ আন্দোলন পুরোপুরি সফল না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়ব না। পরের প্রশ্নটি ছিল দিনের পর দিন এ আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে এবং পরিবহন মালিক শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করেছে পরিবহন শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছে এ ব্যাপারগুলো তারা কিভাবে দেখছে এবং এর প্রতিকার কি? ওরা সবাই বলেছে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা যেন ছাত্রসমাজকে প্রতিপক্ষ মনে না করে একটা নিয়মনীতি তৈরি হলে সেটার সুফল তারাও ভোগ করবে। পরিবহন ব্যবস্থা যেহেতু পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে তাই সাধারণ জনগণকে তারা এই আন্দোলনে পাশে পেতে চায়। একটা ভাল কাজ করার জন্য সবার কিছুটা কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক বলে তারা মনে করে। এরপরের প্রশ্ন ছিল দেশের প্রায় নিয়মনীতিহীন ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে। আনতে চেয়েছি কেন স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরেও আমরা এই ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নিয়মকানুন প্রয়োগ করতে পারিনি? তারা সবাই বলেছে এর পেছনের কারণ হচ্ছে এই সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তারা উল্টো প্রশ্ন করেছে, স্বাধীনতার এত বছর পরও কেন রাস্তায় এ্যাম্বুলেন্স অথবা জরুরী চলাফেরার জন্য একটা ইমার্জেন্সি লেনই করা সম্ভব হয়নি? এর কারণ তারাই বলেছে, সদিচ্ছার অভাব জবাবদিহিতার অভাব সর্বোপরি দেশের প্রতি সত্যিকারের ভালবাসার অভাবই এর জন্য দায়ী। ইচ্ছে করলে সুন্দর একটি ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে তা আমাদের ছাত্রসমাজ মাত্র কয়েকদিনেই বুঝিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে একজন স্কুলছাত্রী প্রশ্ন করেছে, আমরা ছোট হয়ে যদি এতসব বুঝতে পারি তাহলে বড়রা কেন এতবছর বুঝতে পারেনি? ওরা সবাই এটাও বলেছে যে বাসে চলাচলের সময় বাসের ভেতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে চলাচলের সময় তারা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার অথবা অন্য যাত্রীদের দ্বারা মেয়েরা যেন যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়নের শিকার না হয় সেজন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। এখন মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় এবং চাকরি ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে তরতর করে। এই অগ্রযাত্রা যেন অনিরাপদ গণপরিবহনের কারণে বাধাগ্রস্ত না হয় এটা তাদের বিশেষ চাওয়া। আন্দোলনের সামনে থাকা এই মেয়েদের কাছে সবশেষে জানতে চাইলাম, মেয়ে হিসেবে এ ধরনের সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে তারা কোনরকম বাধার সুম্মখীন হয়েছে কিনা? তারা কেউ কেউ বলেছে একেবারে কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি। কয়েকজন বলেছে, বাসায় না জানিয়ে তারা এসেছে কারণ জানলে তারা আসতে পারত না। অনেকের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন কিংবা বাবা মা নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে তাদেরকে এ ধরনের সমাবেশে আসতে দিতে চায় না। কিন্তু তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে তাদের সঙ্গে থাকা সহপাঠী, জুনিয়র, সিনিয়র ছেলেরা তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখছে সবসময়। তবে তারা সবাই মনে করে তারা ছেলেদের চেয়ে আলাদা কিছু না এবং তাদের সঙ্গে সমানতালে তারা রাজপথের আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করেছে।
×